Published : 26 Dec 2008, 01:36 PM
লেখাটি নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য ভাঙা ও অপসারণের প্রতিবাদে ঢাকার চারুকলা অনুষদকে কেন্দ্র করে গঠিত 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর মতবিনিময় সভায় প্রচারিত বক্তব্যের ['বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন': আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষিত] সমালোচনা হিসাবে যৌথভাবে লিখিত। উল্লেখ্য, সভাটি ঢাকার দৃক গ্যালারিতে ১২ ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত হয়। — বি. স.
এই নাতিদীর্ঘ রচনাটিকে দেখা দরকার বিগত কয়েক মাস যাবৎ মহানগরের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সংমিশ্রণের প্রশ্নে আমাদের চলমান অস্বস্তির একটা প্রাথমিক দলিল হিসেবে। এই সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি-প্রণালীর মুখ্য অনুঘটক হিসেবে সাম্প্রতিক ভাস্কর্য-ভাঙা ও তৎপরবর্তী নাগরিক আন্দোলন এখানে স্মর্তব্য। রচনাটিতে একটি নথিকে কেন্দ্রীয়ভাবে তদন্ত করা হয়েছে। সেটা করা হয়েছে নথিটির গুরুত্ব বিবেচনা করেই, এবং সূত্রানুযায়ী অপরাপর প্রসঙ্গ এখানে পর্যালোচিত হয়েছে। আলোচ্য নথিটি অধুনা সংগঠিত 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর ঘোষণাপত্র হিসেবে ১২ই ডিসেম্বর ২০০৮-এ এই সংগঠনের মত বিনিময় সভায় — দৃক গ্যালারিতে — প্রচারিত। এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে বিমানবন্দরে ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার পর গড়ে-ওঠা নাগরিক আন্দোলনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ের লক্ষ্যে। তবে উল্লেখ করা দরকার যে, মতবিনিময় সভার দিন ঘোষণাপত্র হিসাবে পাঠ ও প্রচার করা হলেও কয়েকজন সহকর্মী নথিটিকে প্রাথমিক-পর্যায়ের আর তাড়াহুড়ো-করে-তৈরি করা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। পরবর্তী নথির জন্য আমাদের সাগ্রহ অপেক্ষা আছে। প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে ওই ভাস্কর্য ভাঙার (মতান্তরে অপসারণের) ঘটনার পর একাধিক মোর্চায়, এবং বিশেষভাবে চারুকলা চত্বরকে ঘিরে, নানান রকমের আন্দোলন সংঘটিত করবার প্রয়াস ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক প্রবাহের চিন্তকবর্গ নিয়ে চলছেন। পেশাগতভাবে হিসেব কষলেও এই বিষয়ে আমাদের অসম্পৃক্তি নৈর্লিপ্তিজনিত নয়।
'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন' আয়োজিত মতবিনিময় সভা
বাংলা? কেন?
'বাংলা' পদটিকে প্রায়শই দাবি করা হয়ে আসছে জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিস্থঃ একটা ধারণা হিসেবে যেখানে ভৌত পরিসরকে জাতীয়তা কিংবা ভাষাভাষিতার প্রশমনকারী হিসেবে প্রক্ষেপ করা হয়। এর অন্তঃসারশূন্যতা দেখার চেয়ে, ঐতিহাসিকভাবেই, ভণিতা হিসেবে একে দেখা কার্যকরী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রচারিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা ও চর্চা থেকেই তা অনুধাবন করা সম্ভব। 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর নামে কেন্দ্রীয় গুরুত্বের জায়গায় 'বাংলা' পদটি হাজির, এবং আমাদের আশঙ্কা, এটি ব্যবহৃত হয়েছে পদটির ক্রমাগত-সরলীকৃত ঐতিহাসিক নির্মাণের উপর দাঁড়িয়ে এবং জাতীয়তাবাদের বিতর্কটিকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে। আমাদের এই অনুধাবনের প্রেক্ষিত হচ্ছে বাংলা সম্পর্কিত বলবান পাবলিক ডিসকোর্স যেখানে 'হাজার বছরের বাংলা'র অতিকথন বাংলা পদটিকে উদ্ভাসিত করে।
এই বাংলা আধিপত্যশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে আমরা ঠাহর করি। আধিপত্যশীল ইতিহাস চর্চায় এবং এর সরল পাবলিককৃত জবানে 'হাজার বছরের' ইতিহাসের কথা বলা হয়। হাজার বছর তো দূরের কথা, বাস্তবে আকবরের সুবা বাংলা আর আজকের 'বাংলা' স্থান হিসেবেই এক এলাকাকে নির্দেশ করে না। 'বাংলা' অঞ্চলটি, এমনকি সীমানার দিক থেকেও, অনেক পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে যদি পদটির সঙ্গে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রবাহকে আপাততঃ বিবেচনাতে নাও আনি, আলাপের স্বার্থে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে 'বাংলা' কেবল একটি স্থানিক সীমানাকে নির্দেশ করে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও বিকাশের পরিসরে 'বাংলা' প্রত্যয়টি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সস্পর্কাদি, শর্ত ও পরিবর্তনকে প্রকট ও প্রচ্ছন্নভাবে দ্যোতিত করে। অনেক চিন্তকই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণার উৎপত্তি, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণা, প্রতীক ও অনুশীলনের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে চিহ্নিত করেছেন। ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসন ও ক্ষমতার সঙ্গে এই জাতীয়তাবাদের ধারণাগত আদান-প্রদানের শর্ত ও প্রক্রিয়াগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছেন। 'সমন্বয়বাদী' তৎপরতা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলা অঞ্চলের ধারণার ক্ষেত্রে প্রকট হলেও জাতীয়তাবাদী ধারণার অনুশীলন ও জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের বাস্তবায়নের অনিবার্য শর্ত হিসাবে মুসলমান, দলিত, অস্পৃশ্য, নারী এবং বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্তাকে এই জাতীয়তাবাদ অধস্তন হিসেবে নির্মাণ ও পরিবেশন করে আসছে। সমন্বয়বাদী (সিনক্রেটিক) ঐতিহ্যের তত্ত্বের প্রধান ঝামেলা হলো এই তত্ত্ব অসমতা (ক্ষমতা ও উৎপাদন সম্পর্কগত) ও তার ধবংসক্ষম ও সৃষ্টিশীল সক্রিয়তাকে আমলে নিতে পারে না। দুর্বল জাতিগুলোকে বা সাংস্কৃতিক প্রবণতাগুলোকে তাই স্বীকৃতি/অস্বীকৃতির জন্য নির্ভর করতে হয় প্রবল জাতি বা সাংস্কৃতিক প্রবণতার উপরে। কারা সমন্বয় করছেন? কীভাবে সম্বনয় হচ্ছে? কেন সম্বন্বয় হচ্ছে? — এই জরুরি প্রশ্নগুলো এখানে উপেক্ষিত হয়। সমন্বয় কোনো একপাক্ষিক ক্রিয়া নয়। এটা দুই বা বহুপক্ষের মধ্যের সম্পর্ককে নির্দেশ করে। সেকারণেই প্রবল অসমতার মধ্যে সমন্বয়ের ক্রিয়াটির কারক হয়ে সর্বদাই ওঠে প্রবল পক্ষটি। 'রাষ্ট্রীয় সাংস্কুতিক অনুষ্ঠানে' অথবা 'প্রগতিশীল' আন্দোলনের সঙ্গে মানানসই করে 'আদিবাসী' সাস্কৃতিক কর্মের বা 'লোকজসংস্কৃতির' পরিবেশন তাই প্রকারান্তরে হয়ে ওঠে প্রবল পক্ষের উদযাপন-আত্মস্তুতি-প্রদর্শন আর অবশ্যই, নিজকে 'উদার' 'পরমতসহিষ্ণু' হিসাবে জাহির ও প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম।
উপরন্তু, স্বাধীন বাংলাদেশে সমতল ও পাহাড়ি বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে এই জাতীয়তাবাদ প্রবলভাবেই যে আধিপত্যবাদী সাম্প্রতিক ইতিহাসের পঠনে তা দেখানো সম্ভব। পাহাড়ে জুম্ম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংঘাতময় সম্পর্ককেও স্মরণে রাখা জরুরি। যদি অনুশীলনের মধ্য দিয়ে 'বাংলাকে' নির্মাণ করার দাবি করা হয় (যেমনটি পিয়াস করিম ১২ই ডিসেম্বরের মতবিনিময় সভায় বলেছেন) কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাকে আমরা পেয়েছি সেই 'বাংলাকে' মানদণ্ড ধরে এগুতে হয় (যেমনটি আজফার হোসেন একই সভায় প্রস্তাব করেছেন), সেক্ষেত্রে কতগুলো সমস্যা চিহ্নিত না করে উপায় থাকে না। কাদের অনুশীলনের মাধ্যমে এই 'বাংলা' নির্মিত হবে? তাদের জাতিগত, উৎপাদন ও ক্ষমতা সম্পর্কগত, শ্রেণীগত, লিঙ্গীয় অবস্থান কী? বাংলাদেশের 'প্রগতিশীল' 'উদারপন্থী' 'সেক্যুলার' আওয়ামী লীগিয় ও বামপন্থী বলে স্বীকৃত একাংশের অনুশীলনে যে বাংলা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছে সেই 'বাংলা'র সঙ্গে এই 'বাংলার' ফারাক কোথায় ও কীভাবে হবে তা আর যাই হোক ঘোষণাপত্রে কিংবা এই মুহূর্তের তৎপরতায় স্পষ্ট নয়। যদি এই 'বাংলা' ও 'বাঙালি' জাতীয়তাবাদ করোটিতে ধারণ করে ব্যূপনিবেশীকরণ (সেদিনকার আলোচনায় একটা তাগিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে; ঘোষণাপত্রের সঙ্গে তার কোনো সামঞ্জস্য থাকেনি সেটা হিসেবের বাইরে রাখলেও) একটা নির্ভেজাল স্ববিরোধ।
সর্বোপরি, 'বাংলা' পদটির প্রশ্নাতীত আত্তীকরণ নিয়ে আমরা চিন্তিত এই কারণে যে এই পদ সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রির রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র অনুধাবনের প্রচেষ্টাতে গোড়াতেই কপাট বন্ধ করে দেয়। কর্পোরেট পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নতুন নতুন প্রকাশগুলোর কথা মাথায় রাখলে উত্থাপিত প্রশ্নাবলীর সমাধান না-করে কিংবা আরও আরও প্রশ্ন উত্থাপন না-করে আন্দোলন পুরানো-ব্যঞ্জনাসর্বস্ব হয়ে পড়বে বলে আমাদের আশঙ্কা। এটা পরিতাপের যে, এমনকি সীমিত পরিসরে উত্থাপনের পরও, আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা ও আশু করণীয় এজেন্ডাগুলোর সাপেক্ষে এসব প্রশ্নকে সেদিনের বক্তারা গুরুত্বহীন দাবি করেছেন। গত ৩৭ বছরে বিভিন্ন 'প্রগতিশীল' আন্দোলনেই বিভিন্ন ছুতায় এধরনের যে-কোনো প্রশ্নকে কোণঠাসা করে তোলার অনুশীলন দাম্ভিক জাতীয়তাবাদী চেহারা পেয়েছে। লক্ষ্য রাখা দরকার যে, ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তীকালে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যের সীমারেখাগুলো সাম্রাজ্যবাদের নতুর পরিসরে অনেকটাই ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্র এবং তার প্রতিষ্ঠানাদি, মিডিয়া আর সিভিল সোসাইটি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের' নামে এবং জাতি-রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য রক্ষার নামে এমন সব বিধিবদ্ধতা তৈরি করেছে/করছে যা খোদ গণতন্ত্রের মূলনীতিমালাগুলোর পরিপন্থী। এই ধোঁয়াচ্ছন্নতা কথিত ফ্যাসিবাদবিরোধী হিসেবে দাবিদার আন্দোলনগুলোতেও আছর ফেলছে নানান ভাবে।
সম্প্রীতির গালগল্প
ঘোষণাপত্রের ও উল্লিখিত আলোচনার আরেকটি কেন্দ্রীয় থিম বা মূলভাব হচ্ছে সম্প্রীতি। বিবরণীটা এরকম: 'হাজার বছর ধরে' বাংলায় সবাই সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছে! মূর্তি বা ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়টি যেন এই সম্প্রীতিদার বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই মুখ্য পরিচয় থেকে এক ধরনের বিচ্যুতি! কিন্তু ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত স্পষ্টভাবেই দেখায় যে, 'আবহমান বাংলার' এ জাতীয় চিত্রায়ন বেঠিক, মিথ্যা। ধর্মীয়, জাতিগত ও অন্যান্য সংঘাত অত্যন্ত প্রাচীন, এবং চলমান। যে জিজ্ঞাসা বরং এখানে কার্যকরী হতে পারত, এবং জরুরি, তা হচ্ছে কীভাবে আধুনিক রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দর্শন প্রাক-আধুনিক সংঘাতমেরুর এবং সংঘাতপ্রবণতার খোলনলচে বদলে দিল; কীভাবে সংঘাতের চারিত্র্যের মধ্যে আধুনিক সহিংসতা অনুপ্রবেশ করল; কী কী উপায়ে রাষ্ট্র এসব সংঘাতকে, মীমাংসার বদলে, জিইয়ে রাখল। ইত্যাদি।
বাস্তবে প্রবল জাতীয়তাবাদী অনুভূতি এখানে পুনরুৎপাদিত হয়েছে এবং বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ঐতিহাসিক গতিপ্রকৃতি ও রূপান্তরপ্রবণতা অস্বীকার করা হয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে এই উপেক্ষা আত্মপরিচয়ের একটা পল্কাবোধ বা নিরাপত্তাহীনতা থেকে এসেছে বলেই কেবল ঠাহর হয়। এই ইনসিকিউরিটি জাত্যাভিমানী ছাড়া কার থাকে? আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সম্প্রীতির ঐতিহাসিক সরল চিত্রপ্রকাশ সম্প্রীতির লক্ষ্য অর্জনে তো সাহায্য করেই না বরং তা নির্যাতনের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার অনুশীলনকে বাধাগ্রস্ত করে। এই 'সরল' বাংলার উদ্যাপন-উৎসবে কোন জাতির বা ধর্মের লোকের পক্ষে নিজ অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এবং ইতিহাস দিয়ে কালি ছিটানো সম্ভব?
তাহলে 'প্রগতি' বনাম 'মৌলবাদ' নয়?
'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর ঘোষণাপত্রে যদিও বলা হয়েছে যে এই আন্দোলন তার এজেন্ডাগুলোকে 'প্রগতি' বনাম 'মৌলবাদের' লড়াই হিসাবে দেখছে না, তথাপি তার থেকে ভিন্ন কিছু ঘোষণাপত্রে দেখা যায়নি। আলোচকগণের আলোচনার মুখ্য স্বরও এই ঘোষণার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। 'প্রগতি' বনাম 'মৌলবাদ' যুগ্ম- বৈপরীত্যের বিকল্প তত্ত্বায়ন বিপজ্জনকভাবে ঘোষণাপত্রে দুর্বল, যদি আদৌ কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সম্পর্ক কী, কোথায় সেই সম্পর্ককে প্রেক্ষিতকৃত করে পাঠ করা যাবে, কীভাবে সেই সম্পর্ককে তীক্ষèভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে সেসব জিজ্ঞাসার সঙ্গে সংমিশ্রিত মনে করা সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে এই ঘোষণাপত্রকে কিংবা এই পক্ষীয় আন্দোলনকারীদের। ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে-কোনো সাংস্কৃতিক তৎপরতার আগুয়ান চারিত্র্য বিবেচনা করলে বিকল্প তত্ত্বানুসন্ধানের অভাবটা গুরুতর যেহেতু 'জনগণের' কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়ার একটা দায়িত্ব ধারাবাহিকভাবেই সংগঠকেরা করে আসছেন।
'প্রগতি' বনাম 'মৌলবাদ'-এর পাকচক্রটা, নিরীখ করে দেখলে, বাংলাদেশে অর্থোডক্স বাম-লিবেরেল মিথোজীবী ঘরানায় দীর্ঘকাল ধরে চর্চিত তাত্ত্বিক পাটাতনের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্ম সম্পর্কে যে রকম জনসমাজবিচ্ছিন্ন, ঊর্ধ্বপদ ও দুর্বল তত্ত্বায়ন ও অনুশীলন বলবৎ রয়েছে সেটাই প্রকট হয়ে উঠেছে আলোচ্য ঘোষণাপত্রে এবং আন্দোলন মোর্চায়। সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদ ও রাজনৈতিক ধর্মের বহুমাত্রিক পরিবর্তনশীল সম্পর্ক এবং সেই সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধে ধর্মীয় প্রতীক ও অনুশীলনের বহুমাত্রিক তাৎপর্য এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। এই উপেক্ষা আলসেমিজনিত নাকি অজ্ঞতাজনিত সেই প্রশ্ন আমাদের ভাবিয়েছে এবং পরিশেষে দুটোই সমান বিপজ্জনক বলে আমাদের মনে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম, ধর্মীয় অনুশীলন ও রাজনৈতিক ইতিহাসের পাঠ এখানে অসহিষ্ণু এবং হালকা-পলকা। 'জামাত' এমন একটা জেনেরিক বর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং আলোচ্য সভাটিতেও বারংবার হয়েছে, যে কোনো রকম গূঢ় উপলব্ধির ভরসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
যদি 'প্রগতি' বনাম 'মৌলবাদ' এর প্রথাগত বৈপরীত্যের বাইরে তত্ত্বায়ন করতে হয়, আগেই যেমনটা জাতীয়তাবাদের ঔপনিবেশিক পাটাতন নিয়ে উল্লেখ করেছি, প্রগতির দার্শনিক বনিয়াদ নিয়ে কেবল সজাগ হলেই চলবে না বরং এই জোড়কে অকার্যকর করে দেবার যুক্তিতর্ক হাজির করতে পারতে হবে। সেসব আত্মাবয়ব, বিদ্বেষ ও ভীতিবোধ প্রথমেই পরিহার করা দরকার বলে আমরা মনে করি যা এই বিপরীত জোড়ের লেগ্যাসি হিসেবে বহন করা হচ্ছে।
সর্বরোগহরা লোকসংস্কৃতি লালন
লোকসংস্কৃতি লালন-পালন এবং খোদ লালন সম্ভবতঃ সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ। এই প্রপঞ্চ, আমাদের সতর্ক পর্যবেক্ষণ, বাঘ-মহিষ এক ঘাটে নিয়ে এসে ছেড়েছে। কর্পোরেট পুঁজি কেন্দ্র থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট টেলিভিশন, বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থা থেকে শুরু করে দেশজ চিন্তক, ফ্যাশন হাউজ থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনকারী পর্যন্ত একটি 'আইডিয়া'তে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে শুরু করেছে। যখন কোনো সাংস্কৃতিক-লক্ষণা পরস্পর সম্ভাব্য বিপ্রতীপ বর্গসমূহের দ্বারা এরকম নির্বিশেষে আত্তীকৃত হয় তখন গভীরভাবে তা তদন্তের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। এই তদন্ত 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন' করতে ইচ্ছুক বলে মনে হয়নি। বরং ঘোষণাপত্রটিতে লালন ও লোকসংস্কৃতি লালন-পালন একটা সর্বরোগহরা দাওয়াই হিসেবে উপস্থিত হয়েছে এবং আশু মীমাংস্য জিজ্ঞাসাবলীর সঙ্গে যথেষ্ট সংমিশ্রণ না-ঘটানোর একটা পরিত্রাণ-পথ হয়েছে (যেমন, আলোচ্য সভায় লোকসংস্কৃতির প্রতিভূ হিসেবে ছিলেন লোকসংস্কৃতি গবেষক লুবনা মরিয়ম)।
ঢাকাই চলচ্চিত্রে যখন 'ফোক-ফ্যান্টাসি' যখন একটা চলচ্চিত্র-বর্গ হিসেবে জনপ্রিয়, তখন অনেকের মতোই, আমরা এই বর্গটি শনাক্ত করতে যথেষ্ট সমর্থ ছিলাম না। এর একটা কারণ আমাদের অল্প বয়সের শব্দভাণ্ডার-সীমাবদ্ধতা, আমাদের সাহিত্য-সমালোচনা পাঠের অভাব ইত্যাদি। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রবল ধারার চলচ্চিত্র নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে বাতিকগ্রস্ত দূরত্ব এবং কোনোরকম পাঠপরিক্রমার অভাবও আমাদের অবোধ থাকার কারণ। এই এত বছর বাদে 'ফোক' কীভাবে 'ফ্যান্টাসি' তা হাড়েমজ্জায় উপলব্ধি করবার সুযোগ আমাদের হয়েছে। 'লোকসংস্কৃতি' হয়ে দাঁড়িয়েছে 'হাজার বছরের বাঙালি'র বৌদ্ধিক সাফাইকারী/জাস্টিফায়ার। 'লোকসংস্কৃতি' এক কল্পদূরত্বের সাংস্কৃতিক জমিন যার উপর দাঁড়িয়ে সেক্যুলার-লিবেরেল চিত্ত তার নিজের অভিব্যক্তির সমরূপতা খোঁজে।
লোকসংস্কৃতির, এবং বিস্ময়করভাবে এর প্রতিভূ হিসেবে লালন-এর, উদবর্তন অধুনা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার একটা বৈশ্বিক প্রপঞ্চ হিসেবে আমরা শনাক্ত করি। প্রপঞ্চটি মূর্ত হয় অস্ট্রেলিয় এ্যাবরজিনাল আর্ট-এর মোটিফ ঢাকার ফ্যাশন শিল্পের কোনো একটি পোশাকে প্রস্ফূটিত হবার মাধ্যমে যেমন, ইউনেস্কোর মহাসম্মেলনে 'হেরিটেজ' বিষয়ক ধারাবাহিক আহাজারির মধ্যেও তেমনি। সাংস্কৃতিক আইকন নির্মাণের বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কীভাবে এবং কোথায়-কোথায় বাংলাদেশ সামিল হয়ে আছে সে বিষয়ে বৌদ্ধিক অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি কাজ। ধারণা করি যে, এই বিষয়ে আরও আলাপ-আলোচনার দরকার পড়বে। এবং প্রয়োজনীয় তর্কাতর্কির মধ্যে এই বিষয়ে পুনর্বার কথা বলবার ইচ্ছা আমরা রাখি এবং জরুরিত্ব আমরা অনুভব করি।
একটা আর্তনাদের মতো শোনায়
বিমানবন্দরের ঘটনার পর মুখ্যত চারুকলা চত্বর থেকে বিকশিত যে আন্দোলনটি দানা বাঁধছে তার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মুখ্য একটা হচ্ছে একটা আর্তনাদ-প্রায় দাবি: "আমাদের 'ওরা' সংস্কৃতিচর্চা করতে দেবে না।" এখানে এই 'ওরা' বিস্ময়করভাবে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে। প্রায়শঃ, যখন আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা সংঘটিত হয় তখন, ভাস্কর্য ভাঙাকে সংস্কৃতি-চর্চার-বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সাম্রাজ্যবাদী আঘাত হিসাবে সরল ভাবে পাঠ করার প্রবণতা অনুভূত হয়। আবার একই সঙ্গে, এবং প্রায়শঃ মধ্যবিত্ত পাবলিক-জবানে ভাস্কর্যভাঙার বিষয়টাকে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও ধর্মীয় 'গোঁড়ামি'র সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখা হয়। যখন এই দুই থিসিসের সম্পর্ক, ন্যায্যভাবেই, নিয়ে একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসে তখন অবধারিতভাবেই ধর্মগোষ্ঠীকে দেখানো হয় রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদের 'দালাল' কিংবা ক্রীড়নক হিসেবে। এ কথা বলবার সময়ে আমরা সবিশেষ সতর্ক আছি যে রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক আঘাত-থিসিস অন্যটার থেকে লক্ষণীয়ভাবে অল্পচর্চিত।
রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মগোষ্ঠী এবং প্রতি-সাংস্কৃতিক চর্চাদি এত সরল বিষয় হলে হয়তো সুবিধা হতো। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না যে এগুলো এত সরল ও দ্বিমুখী। প্রতি-সংস্কৃতি কেবল ধর্মীয় বা ধর্মশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয় নয়। গত এক শতকের ইতিহাসের মধ্যেও এগুলো লক্ষ্য করা দরকার। বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়াতে, কিংবা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর গণচীনে ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ আছে যেখানে পূর্বতন সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির নিদর্শন হিসেবে এন্তার মূর্তি/ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় নকশাল আন্দোলনের অংশ হিসেবে শহর-সজ্জার জন্য প্রতিষ্ঠিত বহু ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে সেগুলোকে বুর্জোয়া চিন্তাচেতনার সম্প্রসারণ হিসেবে অনুধাবন করে। আবার তালেবানদের বামিয়ানের বৌদ্ধ ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাটি, আমরা যতই ক্ষুণ্ন হই না কেন, ইউএন-এর চতুর ও লাঙ্গুর-ধরা রাজনীতির প্রতি একটা বার্তাপ্রদানও বটে। এসমস্ত জটিল অভিব্যক্তি পাঠের ক্ষেত্রে তীক্ষ্ণ তত্ত্বায়ন ও ক্ষুরধার বিশ্লেষণ ছাড়া লঘুতার ঝুঁকি প্রকট।
আর্তনাদটা আমাদের চিন্তিত করবার কারণ আছে। প্রধান কারণ এই যে এটি কোনোরকম রাজনৈতিক বোঝাপড়ার বদলে একটা সেন্টিমেন্টাল সহমর্মিতা যাচনা করে। উপরন্তু এই আর্তনাদ ইতিহাসে নানাবিধ সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি প্রণালী জারি থাকার নজিরের সঙ্গে বেমানানও বটে। সর্বোপরি, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতা নির্ধারণের জন্য এবং মৈত্রী স্থাপনের জন্য রাষ্ট্র ও এর নানাবিধ এজেন্সিকে বুঝতে বাধা প্রদান করে।
প্রতিমা/মূর্তি/ভাস্কর্য: অথ দুর্গা সমাচার
ভেঙে-ফেলা ভাস্কর্যগুলো কেমন ছিল এ নিয়ে ভাস্কর্যগুলো চাক্ষুষ দেখনেওয়ালাদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। এটা কাকতালীয় যে আমরা স্বচক্ষে সেগুলো দেখি নাই। পরবর্তীকালে মনে হয়েছে না-দেখার কারণে গ্লাণিবোধের বিশেষ কারণ আমাদের নেই। কিন্তু সঙ্গত কারণেই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন 'ভাস্কর্য' আর 'মূর্তি'র পার্থক্য বিষয়ে ধর্মগোষ্ঠীকে সজাগ করতে সচেষ্ট হলেন, তখন উদ্দীষ্ট মানুষজন হোন বা নাই-হোন, আমরা কিন্তু হয়েছিলাম। 'মূর্তি' বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রায় দৈনন্দিন ব্যবহার্য একটা পদ। নানান ব্যাঞ্জনায় কখনো এটি 'প্রতিমা'। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর কোনো না কোনো অঞ্চলে 'মূর্তি' ভাঙা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এটি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে একটা প্রপঞ্চ-মর্যাদা লাভ করে; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই করে না। কেন অপরাপর পূজার তুলনায় দুর্গা পূজাতে, কিংবা কখনো কখনো কালী পূজায়, এই আক্রমণ অধিকতর তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেয়া খুব জটিল কিছু হবে না। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, ভাস্কর্য কিংবা যেকোনো 'শিল্পরূপ' সম্পর্কে মোহগ্রস্ততা থাকলে তা আসলে সহিংসতা এবং প্রতিপক্ষতার রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক বৈরিতার অনুশীলনকে উপলব্ধি করতে সহায়তা দেবে না।
পাবলিক পরিসরে সেক্যুলার ভাস্কর্য ভাঙা, আর 'প্রাইভেট' পরিসরে ধর্মীয় ভাস্কর্য (প্রতিমা) ভাঙার ঘটনার মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ককে আমরা কীভাবে বুঝব? এসব ক্ষেত্রে প্রতি-সাংস্কৃতিক তৎপরতার নানাবিধ বহিঃপ্রকাশকে, সমান্তরালভাবে, পাঠ করবার মতো যথেষ্ট উদযোগী হওয়া দরকার। সেক্যুলার-লিবেরেল আইকন বা মোটিফ ইত্যাদির উপর আঘাত নিয়ে ব্যতিব্যস্ততা ঘন হয়ে গেলে সহিংসতা কিংবা রাষ্ট্রের চালিয়াতি দুটোই অনুসন্ধান কঠিন হয়ে পড়বে।
রাষ্ট্রকে অনুধাবনের আবশ্যকতা
খুশির কথা যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রবক্তা বিষয়টিকে নগর-পরিকল্পনার সার্বিক রাষ্ট্রীয় তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করতে ব্যবহার করেছেন। তবে ১২ই ডিসেম্বরের সভায় কিংবা 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর ঘোষণাপত্রে এই জিজ্ঞাসার কোনো ছাপ ছিল না। ঢাকা মহানগরীর মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠছে 'নান্দনিক' স্থাপনা। এসব স্থাপনা কর্পোরেট পুঁজির উল্লম্ফিত সামর্থ্যকেই ইঙ্গিত দেয় মাত্র। এসব স্থাপনা কি আমাদের আরাম দেয়? কেবল 'নান্দনিক' বলে? অন্যদিকে, রাষ্ট্রকে সরলভাবে কেবল একটি কারক (এজেন্ট) হিসেবে তত্ত্বায়িত না করে একটি বিশ্বজনীনীকৃত চরম ক্ষমতাবান শর্ত/শর্তের সমষ্টি হিসেবে ঠাহর করা এই মুহূর্তে দারুণ দরকার। উপনিবেশীকীকরণ এবং আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার উদ্ভব ও বিশ্বজনীনীকরণের ইতিহাস মনে রাখলে দখল-নিয়ন্ত্রণ-হস্তক্ষেপ-রূপান্তরের দুনিয়াব্যাপি বিস্তারে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের নতুন পরিকাঠামোয় এই ধারণায়ন আমলে নেয়া অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রীয় (অ-রাষ্ট্রীয় ও রাষ্ট্রোর্ধ্ব) প্রতিষ্ঠানাদি, মিডিয়া, কর্পোরেট বাণিজ্য ও ধর্মের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাসের বিবিধতার ক্ষুরধার বিশ্লেষণে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের শর্তাবলির স্থানিক ও বৈশ্বিক জটিল সম্পৃক্ততাকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস আলোচ্য আন্দোলনের এজেন্ডায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বাংলাদেশে ভাস্কর্য-ভাঙার দৃশ্যমান শক্তিগুলোর সংগঠিত ও বিকশিত হয়ে ওঠার ইতিহাসে এই শর্তসমূহ সবল ভূমিকা রেখেছে বলে আমরা মনে করি। এই শর্তগুলো, চুলচেরা বিশ্লেষণে, রাষ্ট্রীয় ও বহুরাষ্ট্রীক সমরতন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত দেয়।
জিজ্ঞাসাটি, তাহলে, হচ্ছে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিসমূহের মধ্যে বৈরিতা ও সদ্ভাবের জায়গাগুলো নিয়ে। যদি বৈরিতার পক্ষ বহুমাত্রিক হয় তাহলে বহুমাত্রিক হতে হবে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।