‘ভাষা’র আলাপে আজফার হোসেন তাঁর নিজের পজিশনটি কিন্তু খুব সহজ ভঙ্গিতে স্বীকার করেছেন।
Published : 25 Apr 2024, 04:03 PM
‘চিহ্ন ভাসে অবশেষে’ বইটিকে আমি ইতিহাসের খাসকামরায় তত্ত্বের সুর-সাধনায় মত্ত একটি দর্শনের চিহ্নসম্বলিত বই হিসেবে পড়তে চাই। লেখক গোটা বইতে যা যা বলতে চেয়েছেন, যে ভঙ্গিতে বলেছেন, তার একটি সুচিন্তিত ভাষিক চিহ্নই স্পষ্ট হয়েছে আমার কাছে।
সাধারণ ভ্রমণ-সাহিত্যে স্থানিক ভ্রমণই মুখ্য থাকে। ভৌগোলিক অবস্থান, প্রকৃতি, স্থানের ইতিহাস, কিঞ্চিৎ হাস্যরস বা অ্যাডভেঞ্চারের তুলিরেখায় অঙ্কিত প্রায় নিরাসক্ত অথবা অতিমুগ্ধ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে সাধারণ ভ্রমণকাহিনি আমাদের নেত্রসমীপে এসে হাজির হয়।
কিন্তু ‘চিহ্ন ভাসে অবশেষে’ বইয়ে এমনতরো তেমন কিছু মেলেনি। তবে হাস্যরসের এক নতুন মাত্রা ও অলংকারের সংযোগ দেখেছি।
যদি ভ্রমণের কথাই বলি তবে ইন্ডিয়ার হায়দ্রাবাদের স্কলার্স হোস্টেলে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত স্কলারদেরকে একেকটা দেশ ধরে নিতে হবে। তারপর তাঁদের সঙ্গে আজফার হোসেনের নানাবিধ আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে একধরনের বাচনিক ভ্রমণকে আমাদের বুদ্ধিঘটে ধরে নিতে হবে। এও এক অভিনব ভ্রমণ-আখ্যান। অনেকটা আত্মজৈবনিক ভ্রমণাখ্যান। এখানে বর্তমানের লেজ ধরে ধরে বারবার ইতিহাস এসেছে, এসেছে স্মৃতিমুগ্ধ ব্যক্তিগত অতীতও। বর্তমান বুদ্ধিদীপ্ত প্রেমের ভেতরে ফটাশ করে ঢুকে পড়েছে ক্ষুদ্র-বয়সের নাবালক প্রেমের সরলতা। বর্তমান আর অতীতের কক্ষে বিনা অনুমতিতে লেখক নিভৃতে বিচরণ করেছেন ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’-এর ডানায় চড়ে। আহা মনোমুগ্ধকর গদ্য, পরীক্ষামূলকভাবে খানিকটা কবিতাক্রান্তও। তবে কবিতাকে অতিক্রম করবার চেষ্টা আজফার হোসেনের মধ্যে একটুও ছিলো না। গদ্যকে সব ধরনের আরোপণ থেকে মুক্ত রাখার জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাই।
আজফার হোসেনের গদ্যের একটি বড়ো গুণ হচ্ছে তাঁর গদ্যে বৈচিত্র্য হিসেবে কবিতাক্রান্ত গদ্যও থাকে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, ভালো গদ্যকে সবসময় কবিতার মতো করেই নাজিল হতে হয়। অধীত বিদ্যাকে গদ্যে সাজানোর মতো ওই মাপের সাধনা খুব কম লেখকের গদ্যেই মেলে। জীবিত পণ্ডিত লেখকদের প্রায় অনেকের লেখাই পড়া যায় না। অতিরিক্ত জ্ঞান জাহিরের উসিলায় তাঁরা গদ্যের সহজ গ্রহণযোগ্যতাকে পরিত্যাগ করে থাকেন। এটাকেই তাঁরা ভালো গদ্যের নির্বাচিত পথ হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু জ্ঞানগর্ভ বিদ্যাকে অতিরিক্ত জবরদস্তির মাধ্যমে যে আরোপণ করে থাকেন, তা সুপাঠকমাত্রই টের পান। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, গান বা নাটকের ভাষাকে যে প্রবন্ধ-সাহিত্য টপকে গেলো, তা কেবল তাঁর সরলতার টোটকার মাধ্যমেই। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মত। আমার মতে কারো দ্বিমত থাকলে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে কেবল আক্রমণ থাকলে ব্যাপক আপত্তি আছে।
বাংলাদেশে ভালো গদ্যের স্রষ্টা হিসেবে আমি খুব কম মানুষকেই পেয়েছি। আমার নিয়মিত পাঠের তালিকায় জীবিত যাঁদের গদ্যকে সুখপাঠ্য হিসেবে পড়ে থাকি তাঁরা হলেন ফরহাদ মজহার, আজফার হোসেন, সুমন রহমান, জাভেদ হুসেন, সাইদুল হক খান, মোহাম্মদ আজম, শিশির ভট্টাচার্য্য, দেবদুলাল মুন্না, পারভেজ আলম, নাজমুল আরেফিন, নাদিয়া ইসলাম, লুনা রুশদী, সোহেল হাসান গালিব, কুদরত-ই-হুদা, রেজাউল করিম রনি, কে এম রাকিব, তুহিন খান এবং আরও কেউ কেউ। এই তালিকাটি করেছি কেতাব এবং অনলাইন প্লাটফর্ম মিলিয়ে। ভালো গদ্য পড়ার জন্য কাগজ বা স্ক্রিনকে কোনো ব্যাপার বলে মনে করি না আমি। ভালো বই পড়ার আনন্দ এক রকম, স্ক্রিনে ভালো গদ্য পড়ার আনন্দ অন্যরকম। অনলাইনের সুবিধা হলো, হাত বাড়ালেই নিজের রুচি মোতাবেক গদ্য পড়া যায়, অসুবিধা হলো এই পড়াটা তথ্যের মতো ডিভাইসে আটকে থাকে, মনের সঙ্গে প্রেম-ট্রেম হয় না অতোটা। বই পড়লে বইয়ের সঙ্গে লিপ্ততা বাড়ে। বইকে জ্যান্ত মানুষের মতো লাগে, হাত বাড়ালেই সবসময় পাওয়া যায় না। দুটোর দুই সুবিধা, অসুবিধাও দুই রকমের। দুই রকমের চিহ্ন ভেসে থাকে পাঠকের মনে।
আজফার হোসেনের ‘চিহ্ন ভাসে অবশেষে’ বইয়ে কীসের চিহ্ন অবশেষে ভেসে থাকে, তার একটা নিরীহ পর্যবেক্ষণ আমি আমার এই লেখার মাধ্যমে করতে চাই।
দেখলাম, লেখক বইটির প্রথম অনুচ্ছেদেই নিজের রাজনৈতিক পরিচয়কে বেশ শক্তভাবে চিহ্নিত করে ছেড়েছেন। স্কলার্স হোস্টেলের ডাইনিং হলে লেখকের পাশে বসে থাকা একজন বয়সী ভদ্রমহিলা যখন লেখকের বাংলাদেশি পরিচয় পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তো এখন মৌলবাদের দেশ।’, তখন এই কথার কাউন্টারে লেখক বলেছিলেন ‘শুধু মৌলবাদ কেন? মৌলবাদ-বিরোধিতারও দেশ বাংলাদেশ।’ লেখক ১৯৯৪ সালের এই স্মৃতিচারণামূলক বয়ানে যে সত্যটি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন সেটি তো আজকের দিনের জন্যও সত্য। ‘মৌলবাদ’ পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রে নাই? কিন্তু ‘মৌলবাদ বিরোধিতা’ সব রাষ্ট্রে থাকে না। বাংলাদেশে সেটা আছে। এটা সুখের খবর। এমনকি বাংলাদেশ জন্মের পরে নানা দেশের আধিপত্যবাদী এবং জালিম আচরণের বিরোধিতাও এই বাংলাদেশে আছে।
আবার এখানে লালন এবং ফারাজ ফকিরদের মতো ভাববাদী যুক্তিবাগীশদের বিচরণও আছে। ফারাজ ফকির লেখকের ছেলেবেলায় আবিষ্কৃত একজন প্রান্তীয় দার্শনিক। যিনি ধাঁধাঁর মাধ্যমে ছড়া কাটেন। এই ছড়ায় ধাঁধাঁ থাকে, যেই ধাঁধাঁগুলোকে একই সঙ্গে সহজ এবং জটিল মনে হয়। ছড়ার নমুনা: ‘কহেন কবি ফারাজ মিয়া/ হিঁয়া লেড়ি ছন্দ/ জানালা দিয়ে ঘর পালালো/ ওরা হলো বন্ধ!’ মানুষের ঘর কখনো জানালা দিয়ে পালায় না, কিন্তু মাছেদের ঘর জানালা দিয়ে পালাতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর যেকোনো একক যুক্তি কখনো সবজায়গায় একইভাবে খাটে না। কেবল যুক্তিকে ধরে থাকলে বা কেবল আবেগকে ধরে রেখে জ্ঞানের সংজ্ঞা ও প্রজ্ঞা লাভ হয় না। নিজের ভেতরে যুক্তি ও আবেগের সমন্বয়েই জ্ঞানের মূলের সন্ধান মেলে। লালনের ভাষায়: ‘মূল হইতে হয় ডালের সৃজন/ ডাল ধরে পায় মূল অন্বেষণ।’
লেখকের পিতামহ লেখককে প্রায়ই চাণক্যের একটি সংস্কৃত শ্লোক শোনাতেন: ‘যস্য নাস্তি স্বয়ং প্রজ্ঞা শাস্ত্র তস্য কিম করিষ্যসি লোচনভ্যং বিহীনস্য দর্পণ কিম করিষ্যসি।’ অর্থাৎ যে মানুষের নিজের জ্ঞান নেই, শাস্ত্র তার (উন্নতি) কিছু করতে পারে না; ঠিক যেমন অন্ধ ব্যক্তি দর্পণে তার নিজের রূপ দেখতে পায় না।
সাধারণ কথোপকথনের ভেতর দিয়ে অতীত ইতিহাস, দর্শনের নানা দিক লেখক অনায়াসে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। বইটি পড়তে পড়তে স্কলার্স হোস্টেলের ডাইনিং হলে, লাউঞ্জে আসা নানারকমের তরুণ গবেষক ও সাহিত্যিকদের লেখকের সংহতি ও বিরোধমূলক আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে আমরা জ্ঞানজগতের নানা দিকে পরিভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছি। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির তরুণ অধ্যাপক সাজাগ রানা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অশোক আচারিয়া, ড. মৌটুসী চক্রবর্তী, জাকিয়া খাতুন এবং লেখকের ৬ নম্বর রুমের রুমমেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তরুণ শিক্ষক এহসানুল হকের সান্নিধ্য-সংযোগে উঠে এসেছে কখনো মার্কসবাদ, জেন্ডার ইস্যু, শব্দ ও ধ্বনির শক্তি, ব্যক্তি ও সমষ্টির শোষণ, বঞ্চনার ইতিহাস, মুক্তির উপায় ইত্যাদি ইত্যাদি। যেহেতু কথোপকথন ও আড্ডার স্মৃতিচারণ, সেহেতু কোনো পরিচ্ছেদের বর্ণনারই কোনো পরিকল্পিত ছক নাই। তবু পরিচ্ছেদের শুরুতে লেখক নানা কোটেশনের মাধ্যমে পরিচ্ছদটি কী সম্পর্কিত তার একটা আভাস আমাদের দিয়েছেন।
লেখক আজফার হোসেনের কী কী চিহ্ন অবশেষে ভেসে থাকে? কোথায় ভেসে থাকে?
বইটি পড়ে আপনি কিছুতেই নির্ধারিত কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবেন না। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় পুতুলের নাম-গন্ধ খুব-একটা না থাকায় একজন ইনোসেন্ট পাঠকের মতো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে আপনার চিত্ত। পুরো বইয়ের কোথায় কী চিহ্নের কথা ভাসাতে চেয়েছেন লেখক? আর এ আবার কেমন ধারার ভ্রমণকাহিনি? যেখানে ভ্রমণের চেয়ে বিচিত্র আলাপ আর চেতনাপ্রবাহ রীতির সাহায্যে উঠে আসা কিছু স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নেই।
আজফার হোসেনের ঝোঁকের দিকটি হলো: স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে ‘ভাষা’র আলাপ চালিয়ে যাওয়া, আর ঝক্কির দিকটি হলো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিতর্ক করা। বিতর্কের ব্যাপারে প্রথমেই একটা চিহ্ন উত্থাপন করেছি – ‘মৌলবাদ’-সম্পর্কিত তাঁর স্পষ্ট অবস্থান। এই বিতর্ককে যে ঝক্কির বলছি তার কারণ লেখক চাইলেই সেখানে সবার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করতেই পারতেন। বিদেশে বসবাসরত অনেক স্কলারই দেশের বহুবিধ নিন্দা-মন্দ করে থাকেন বিদেশিদের সাপোর্ট পাওয়ার জন্য। আজফার হোসেন সে কাজটি করেননি। উলটো বাংলাদেশের পক্ষেই কণ্ঠ জোরালো করেছেন। এটা বিরল। ফলে কীসের চিহ্ন আমাদের মানসপটে ভেসে থাকতে পারে, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।
‘ভাষা’র আলাপে আজফার হোসেন তাঁর নিজের পজিশনটি কিন্তু খুব সহজ ভঙ্গিতে স্বীকার করেছেন। লেখক বলছেন, ‘আমার হিন্দী ও উর্দু অত্যন্ত বিশ্রী। এই ভাষা দুটো কেউ বললে পুরোপুরিই বুঝতে পারি, কিন্তু বলতে গেলে বাংলা শব্দই চলে আসে, যেগুলো এদিক সেদিক ভাঙিয়ে একটা হিন্দী-হিন্দী ভাব দেওয়ার চেষ্টা করি মাত্র।’ (পৃষ্ঠা ১৯)
লেখকের মনে যদি উর্দু ও হিন্দির প্রতি গভীর প্রেম থাকতো (যেমনটা বাংলা ও ইংরেজির প্রতি আছে বলে বলার ক্ষেত্রে দুটো ভাষাতেই লেখক তুখোড়), তাহলে তিনি এ দুটো ভাষাতেই সাবলীল হতেন। কিন্তু এ কথার পরেই লেখক তাঁর হিন্দিভাষী এক বন্ধুর বরাতে কেনীয় লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গোর কথা উল্লেখ করেন। নগুগি নাকি সাহেবি কায়দার ইংরেজি ভাষাকে ব্যঙ্গ করার জন্য ইংরেজি ভাষার ব্যাকরণ ও বাক্যগঠনকে ওলোট-পালট করেছিলেন। হিন্দি ও উর্দুর সঙ্গে আজফার হোসেনের আচরণও নাকি সেরকমের। তবে একটা পার্থক্য হলো নগুগি পুরোদস্তুর ইংরেজি ব্যাকরণ ও ইতিহাস জেনে করেছেন,আজফার হোসেন হিন্দি ও উর্দু ব্যাকরণ না জেনে করেছেন। এটা ভাষার আলাপে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
এইচএসসির পাঠ্যতালিকায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'রেইনকোট' গল্পটি আছে। আমি গল্পটি বেশ কয় বছর ধরেই পড়াই। গল্পটিতে ইসহাক নামে প্রিন্সিপালের পিওন চরিত্রটি আছে, যে পাকিস্তান সরকারের অধীনতা স্বীকার করে বাংলা বলা ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাভাষীদের সঙ্গেও সে সমানে উর্দুতে কথা বলে। লেখকের ভাষায় ‘রাতদিন এখন উর্দু বলে।’ অর্থাৎ মানুষ তখনই কোনো ভাষাকে আয়ত্ত করতে পারে যখন সেই ভাষার প্রতি তার প্রেম জন্মায়, ইসহাকের ক্ষেত্রে প্রেমটি অবশ্য ক্ষমতার সাথে যুক্ত হয়ে এসেছে। আর কে না জানে প্রেমে কী না হয়!
আজফার হোসেন বরং উর্দু ও হিন্দি ভাষার ফাও আধিপত্যকে একটু অমান্য করার জন্যই হয়তো অপ্রেমজনিত কাজ চালানোর মতো করে হিন্দি ও উর্দু বলেন। আর এটাও কে না জানে জগতের সমস্ত কুৎসিত বস্তুর নেপথ্যে থাকে অপ্রেম! লেখক ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলছেন: ‘শ্রমহীন ও প্রেমহীন লোক নিমেষেই কারো চোখ উপড়ে নিতে পারে, কিন্তু সৃজনশীল হতে পারে না।’(পৃষ্ঠা ৯৪) আমার তো মনে হয় প্রেমই সৃজনশীলতার মূল মন্ত্র। প্রেম থাকলেই শ্রম দেবার স্পৃহা জন্মায়। যেমন লক্ষ্ণৌয়ের খুব বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদের একটি বিখ্যাত গান আছে, ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও, তাই বলো কিবা যায় আসে, প্রিয়ার কী রূপ সেই জানে, যে কখনো ভালোবাসে।’ গানটিতে যে ভালোবাসতে পারে তার যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে। এই গানে নর-নারীর প্রেম বুঝিয়ে থাকলেও প্রেম মূলত সর্বত্রগামী। অর্থাৎ মনে প্রেম থাকলে আপনি অত্যন্ত কঠিন বইও অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারেন, আর প্রেম না থাকলে সহজকে শ্রেফ গলাধঃকরণ করতে হয়। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ আমাদের কারিকুলামের পাঠ্যবই আর বাইরের গল্পের বই।
প্রেম-ভালোবাসা বলতে যে আমরা কেবল নর-নারীর প্রেমকেই বুঝে থাকি, সেজন্য আমরা অন্য কোথাও তাকে তেমন একটা খুঁজে পাই না। আমরা তাই জীবনানন্দের ‘বনলতা’কে কেবল নারীরূপে দেখতেই ভালোবাসি। অথচ জেমস জয়েস ‘ইউলিসিস’-এ বলেছেন, ‘ভালোবাসা ভালোবাসে ভালোবাসাকে ভালোবাসতে।’ এ বাক্যটিকে কেবল একজন নারীর ক্ষেত্রে বসিয়ে দিয়েও জীবন পার করা যায়, আবার ভালোবাসাময় অজস্র নর-নারীর ক্ষেত্রেও বসিয়ে দেয়া যায়। আর ভালোবাসা মানেই যে সবসময় লেহন, চর্বন, গলাধঃকরণ এবং আত্মসাৎকরণ – ব্যাপারটা তা নাও হতে পারে সবসময়। ভালোবাসা বলতে কখনো কখনো স্মৃতির কৌটায় পরম যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করাকেও বোঝায়।
আজফার হোসেনের তৈরি করা ‘বনলতা’ কোনো একজন নারী বলে মনে হয়নি আমার। প্রেমে পড়েছেন লেখক বহুবার। বর্তমান ‘বনলতা’র মধ্য দিয়ে চলে গেছেন অতীত ‘বনলতা’র মধ্যে। কখনো পাওয়ার স্মৃতি, কখনো বা অপ্রাপ্তির স্মৃতি উঠে এসেছে। লেখক চেতনাপ্রবাহ রীতির সহযোগিতায় এ দুই সময়ে আসা-যাওয়া করেছেন, এ পদ্ধতিকে রেটোরিক্যালি ‘পকেটমার’ও বলেছেন। লেখকের ভাষায়: ‘মুহূর্তগুলো তো ছিঁচকে পকেটমার! সময়ের পকেট কেটে-কেটে ওরা ভেগে যায়, আচমকা এ গলি ও গলি ধ’রে।’ (পৃষ্ঠা ৯৬)
ইলিয়াসের ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ গল্পটিকে বারবার মানুষের মধ্যে ফিরে আসতে দেখেন আজফার হোসেন। পুরনো প্রেমিকা বা যদি বলি পুরনো বনলতা সেনের সঙ্গে লেখক চেতনাপ্রবাহ রীতির সহযোগিতায় কথা বলে যাচ্ছেন ১২ নং পরিচ্ছেদে। এখানে লেখকের বনলতার কাছে প্রিয় ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের সং-সাজা পুরুষ, যাদের জন্য লেখক বঞ্চিত হন। এই পরিচ্ছেদে আমি দেখলাম দারুণভাবে ছেঁকা খাওয়া এক তরুণ কবি ও দার্শনিককে। যিনি ছেঁকা খেয়ে সেমিকোলনের মতো ব্যাঁকা হয়ে পুরোদস্তুর দার্শনিক বনে যান। লেখকের দার্শনিক উক্তিটি হলো: ‘কোনো কোনো মুখোশ আছে যা মুখের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়, এমনকি বেশি বাস্তবও। আমরা কি শেষ পর্যন্ত মুখোশই?’
‘সেমিকোলনের মতো’ অলংকারটি আজফার হোসেনের নিজের সৃষ্টি। তাঁর গদ্যে অসাধারণ কৌতুক ও হাস্যরসাত্মক উপাদানও পাওয়া যায়। যেমন, ‘লক্ষ করলাম, তাঁর একটি চিকন লোমশ ঠ্যাং ঠিক সেমিকোলনের আকারে বেঁকে আছে।’ (পৃষ্ঠা ২১) “পৌনঃপুনিক দশমিকের মতো উচ্চারণ করেন: ‘আহ! আমাকে তো কথা বলতে দিচ্ছেন না!’” (পৃষ্ঠা ৭৮)
তাঁর গদ্যে নানাবিধ নিরীক্ষামূলক পরিচর্যার মধ্যে কবিতাক্রান্ত গদ্যের চিহ্ন যেমন থাকে, তেমনি গদ্যের বাইরে চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদার কবিতাকেও আজফার হোসেনের অনুবাদে খুব সাবলীলভাবে নৃত্য করতে দেখা যায় ৫ নং পরিচ্ছেদে। বইটির শেষ পরিচ্ছেদে মেলে কবির নিজের কিছু গদ্যকবিতা। সর্বশেষ আট নাম্বার কবিতায় কবি বলছেন: ‘ঘুড়ির মতো ঘড়ি উড়ে উদ্দাম। রাত মুখ রাখে চিহ্নের চোয়ালে। সময়ের টানে চিহ্নপাখি ক্যামনে যায় আর ক্যামনে আসে! চিহ্ন ভাসে অবশেষে।’
কীসের চিহ্ন ভাসে?
আজফার হোসেন যে ভেতরে ভেতরে একজন তুখোড় কবি, বিপ্লবী, প্রেমিক ও দার্শনিক – তার চিহ্ন? নাকি জন্মগ্রহণের পর থেকে এ যাবত যা যা করে গেলেন, তার ভেতরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন’ উপন্যাসের মতো এখানে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, সময়ের পরিবর্তনের জোয়ারে নিজেকে সামিল করার অন্তর্গত তাগিদ, যে কোনোভাবে হোক নিজেদের অধিকার আদায় ও তা সমুন্নত রাখার – ব্যক্তি থেকে ফুটে সমষ্টিতে ফলবার – যে লড়াই, সেই লড়াইয়ের চিহ্নই যেন ভেসে উঠেছে। ‘চিহ্ন’ উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের মতো আজফার হোসেনের স্মৃতির জগত থেকে বের হয়ে আসা পৃথিবীর সমস্ত লড়াকু মানুষেরা যেন সবদেশের সর্বকালের প্রতিবাদী সচেতন মানুষের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বইটিতে আমি যে যে ‘চিহ্ন’ পেলাম সেগুলো হলো: ১. মানুষের উচ্চারিত শব্দসমষ্টিই মূলত মানুষের পরিচয়ের চিহ্ন; ২. বাঙালি মুসলমানের আদি-পরিচয়ের একটা নিষ্পত্তির চিহ্ন; ৩. বেঁচে থাকার চিহ্ন হলো প্রেম, যেহেতু ‘ভালোবাসার ঘাম’ লেখকের সৃষ্টি; ৪. অতীত ও ভবিষ্যতের দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে বর্তমানকে সন্তানের চিহ্ন হিসেবে দেখানো; ৫. একজন লেখকের ভেতরে থাকে একজন দুর্দান্ত কবির চিহ্ন।
পরিশেষে বলতে চাই, ‘চিহ্ন ভাসে অবশেষে’ বইটি পড়ে আমি যেমন ভালো গদ্য পড়ার আনন্দ লাভ করেছি, তেমনি পৃথিবীর নানা সাহিত্যে এবং জ্ঞান-জগতের নানা শাখায় তিনি আমাকে গাইড হয়ে ঘুরিয়ে এনেছেন। এই ভ্রমণে ভিন্ন রকমের চমক ছিলো।