Published : 09 May 2024, 02:40 PM
‘এই বইটা কি লেখা শেষ করতে পারব
সময় যে জানান দিচ্ছে।’
মিহির সেনগুপ্তের (১৯৪৭-২০২২) শেষ বইয়ের পাণ্ডুলিপির এই লাইনগুলো উৎকীর্ণ আছে মূল গ্রন্থেও। মিহির মহাভারতের পঙক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, 'কুরুশ্রেষ্ঠ কালের কেউ প্রিয় বা অপ্রিয় নেই, কাল কারও প্রতি উদাসীন নয়, কাল সকলকেই আকর্ষণ করে নিয়ে যায়'। কালের নির্মমতায় মৃত্যুর গহ্বরে হারিয়ে যাওয়াই মানুষের নিয়তি, কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়ে মিহির সেনগুপ্ত প্রয়াত হন। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রয়াণের পর।
শৈশব আর কৈশোরের লম্বা সময় মিলিয়ে তাঁর জীবনের পনেরো-ষোলো বছর ঝালকাঠির কেওরার বড়োবাড়িতে কেটেছিল। বছরখানেক ছিলেন বরিশালে, তখন ছিল কলেজ জীবন, এরপর ১৯৬৩ সালে থিতু হলেন পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ পর্বে বিরাটি থেকে বাদু, সেখান থেকে বারাসাত এবং সর্বশেষে ভদ্রেশ্বর। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি তিনি ব-বর্গেরর বাইরে যাননি। বরিশালের প্রতি অনুরাগ ভেতরগত। তাঁর বইগুলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থাকে বরিশালের মানুষ এবং জনসংস্কৃতির কথা। এখানেও লিখেছেন, 'বরিশালকে 'শহর' নেহাৎই আহ্লাদ করে বলা। আসলে, বরিশাল একটা উন্নত ধরনের গ্রাম-সমষ্টি মাত্র। তবে তার একটা অসামান্য সৌন্দর্য আছে যার তুলনা আজ পর্যন্ত পেলাম না। কলকাতা হচ্ছে মহানগরী। কিন্তু তা আমাকে কোনোদিন আকর্ষিত করেনি।'
মিহির সেনগুপ্ত মূলত ইতিহাস-আশ্রয়ী লেখক। তাঁর বেশিরভাগ রচনাই আত্মজৈবনিক, নন-ফিকশনাল গদ্য। লেখালেখির পর্বও শুরু করেছেন একটু রয়ে সয়ে। 'সিদ্ধিরগঞ্জের মোকাম', 'ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি' দিয়ে শুরু। এরপর 'বিষাদবৃক্ষ', যা তাঁকে এনে দিয়েছিল মর্যাদাপূর্ণ 'আনন্দ পুরস্কার।' মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র আর ঘটনা নিয়ে লিখেছেন একাধিক গ্রন্থ। 'বিষাদবৃক্ষ' গ্রন্থে মিহির সেনগুপ্ত দেশভাগের ঘটনাকে ব্যক্তিগত পরিসর থেকে বৃহত্তর জনসমাজের সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলেন। বাস্তুভিটে হারাবার বেদনা বইটির সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তিনি লিখেছিলেন-- 'আমার দেশ ত্যাগের আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল বোধহয় আমার জন্মেরও আগের থেকে। কারণ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নিজ গ্রাম এবং আশপাশ গ্রামগুলোতে গৃহস্থ শূন্য তালাবন্ধ বাড়ি এবং পোড়ো ভিটে দেখে দেখে, নিত্য রোজ একের পর এক আতঙ্কিত পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে প্রথমে গঞ্জের ভাড়া ঘরে এবং সেখান থেকে অনির্দিষ্টের পথে অজানা ঠিকানায় পাড়ি দিতে দেখতে দেখতে অভিভাবকদের উদ্ভট আচরণ এবং ভিন্নধর্মী সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতি নির্বিচার কাটব্য শুনতে শুনতে দেশত্যাগ ব্যাপারটার অনিবার্যতা যেন মজ্জায় মিশে গিয়েছিল। আমিও অভিভাবকদের এই মানসিকতার অংশীই ছিলাম।' 'বিষাদবৃক্ষ' জুড়ে ছিল দেশভাগের যন্ত্রণা, হাহাকার। ফেলে আসা শেকড়ের দেশ আর কুড়িয়ে পাওয়া দেশের তুলনা। তাঁর শেষ বইটি, 'এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়ো'--'বিষাদবৃক্ষ' বইয়ের পরের গল্প। যেখানে আছে কলকাতা পর্বের সংগ্রাম আর তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোর বিবরণও। করোনার অভিঘাতে মানুষেরা যখন বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছিল, মহামারি আর অনিশ্চয়তায় ঘেরা সেদিনগুলোর অনুভূতি বইয়ের একটি অংশে লেখা আছে।
তাঁর পরিবারকে যেমন শূন্য হাতে কলকাতায় উদ্বাস্তু হয়ে চলে যেতে হয়েছিল, পঞ্চাশ-ষাট দশকে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুল হিন্দু জনগোষ্ঠী এদেশ থেকে পশ্চিমবাংলার নানা জেলায় বসত গড়তে বাধ্য হন। এদের অনেকেই দুই দেশে নিজেদের মধ্যে বাড়ি বদল করেছিলেন। এমন একজনের কথা বইতে মিহির সেনগুপ্ত উল্লেখ করেছেন। তাঁর নাম নিত্য পাল। নিত্য পালদের বনেদি গেরস্থালি ছিল রাজশাহী জেলার সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে। ওখানে গঙ্গার এক পাড়ে রাজশাহী অপর পাড়ে মালদা। নিত্য পালের পিতামহ শ্রীপালের বন্ধুর নাম সাজ্জাদ আলি খান চৌধুরি। রাজশাহী এবং মালদার মধ্যে এই দু'জন বাড়ি বদল করেছিলেন। দুজনেই বুদ্ধিধর মানুষ। মিহির সেনগুপ্ত লেখেন, 'তাঁরা বুঝেছিলেন যে তাঁদের দুজনের মধ্যে যতই একাত্মতা থাকুক, পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আদৌ ভরসা করা যায় না।'
তিনি প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, তিনি মনে করেন, 'যা কিছু প্রকৃতির নিজস্ব স্বাভাবিক শৃঙ্খলাবিরোধী, সেটাই পাপ বলে অভিহিত হবার যোগ্য।' কলকাতা পর্বে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। ঝালকাঠি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে তিন পর্বে তাঁর পরিবার কলকাতায় স্থানান্তরিত হন। প্রথমে পঞ্চাশের দশকে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা এবং নিজের দুই অগ্রজ ভাই। দ্বিতীয় পর্বে তিনি নিজে। তৃতীয় পর্বে পিতা-মাতা এবং বাকি ভাইবোনেরা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় হবু স্ত্রী বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় গিয়েছেন। ততদিনে তিনি বুঝে গেছেন ‘সহজ গার্হস্থ্য স্থিতিশীলতা এবং বিপ্লবী আন্দোলন-এই দুটো ব্যাপার এক সঙ্গে চলে না। বিপ্লবের 'মেড ইজি' 'হয় না।'
একসময় প্রশ্ন দাঁড়াল, নিজেদের একটা বাড়ি কি হবে না? বাড়ি কোথায়-এর উত্তরে বলতে হত- কেওরা বড়োবাড়ি। যে বাড়ি ফেলে শূন্য হাতে চ'লে যেতে হয়েছিল তাঁদের। ব্যাংকে চাকরি করতেন, লোন নিয়ে ভদ্রমত একটা বাড়ি করা গেল। বাড়ি কোথায় এর উত্তর দিতেও সহজ হল যেন। বলতে পারেন, বাড়ি- ভদ্রেশ্বর। বাড়িতে কয়েকটি কামরা। তাতেই 'যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নয় জন', করে বিরাটকায় পরিবারটির সবারই জায়গা হয়ে গেল। এতদিনে যদিও তাঁদের একটা বাড়ি হল, ঝালকাঠির বাড়ির তুলনায় সেটি কিছু নয়। তবু ভাড়া বাড়িতে থাকার যে বেদনা সে জায়গা থেকে তো উদ্ধার পাওয়া গেল! এমনিতে বাসা এবং বাড়ি এই দুই বস্তুর ভিন্নতা নিয়ে তাঁর নিজের কিছু অনুধাবন ছিল। তিনি লিখেছেন, 'বাসা জিনিসটা শহুরে, ক্ষুদ্রতা। সেটা যেন অনেকটা গর্তের মতো। বাইরের জগতের সঙ্গে তার একাত্মতা বোধে আসে না। যখন কেওড়ার বাড়ি চিরকালের মতো ছেড়ে এসেছিলাম, মনে হয়েছিল দুহাতের স্নেহের আগল থেকে যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেলাম। ওরকম একটা হাহাকারি-অনুভূতি এ জীবনে আর পেলাম না। ছন্নছাড়া হওয়ার এই অনুভূতিটা জীবনে যেন চিরস্থায়ী হয়ে রইল।’
মিহির সেনগুপ্ত বইয়ে যেমন জীবনের ব্যক্তিগত পরিসর নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেখানে আরো আছে মহাজীবনের দূরব্যাপী এক চিত্র। সারাজীবন তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতের সান্নিধ্যে থেকেছেন। একসময় বাউল সঙ্গীতের ভক্তিমার্গে মন ভেড়ান। বাউলের গানের সুর আর পঙক্তির মাঝে খুঁজে ফেরেন জীবনের গূঢ় মাহাত্ম্য। এভা্বেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় প্রশান্তচন্দ্র রায়ের। প্রশান্ত রায় গানের মানুষ। ভক্তিগীতি তাঁর প্রাণের খোরাক। এমন ভক্তিরসের গানপাগল মানুষের সহগামী হতে মিহির সেনগুপ্ত তাই আর দেরী করেন নি। বন্ধুত্ব গড়ায় আজীবনের সস্পর্কে। যে বন্ধুত্ব আমৃত্যু দু'জনকে ঘিরে রেখেছিল।
মিহির সেনগুপ্তের গদ্যশৈলীর নির্মেদ আর ধ্রুপদী ভাব মনে প্রশান্ত অনুভূতি জাগায়। তাঁর দেখাশোনায় একটা দুর্লভ বিষয় আছে, সে তাঁর নৈর্বক্তিক দৃষ্টি। দেশবিভাগ নিয়ে তাঁর অনুধাবনে পক্ষপাতমূলক বিক্ষেপ বা ত্রুটি দেখা যায় না। বর্ণহিন্দুসমাজের একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করতে তিনি কখনো পিছপা হননি। হিন্দুশাস্ত্রগ্রন্থাদির গভীর পাঠ পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল সাহিত্য, সমসাময়িক নাটক-গল্প উপন্যাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে পড়াশোনা এবং ইংরেজিভাষাভিজ্ঞতায় তিনি রীতিমত বিদ্বান ছিলেন। পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তরের দশকের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থা এবং আবহ নিয়ে তাঁর মধ্যে ছিল ব্যাপক এবং গভীর ঔৎসুক্য। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি, মানুষের সঙ্গে ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদান বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা বইটির প্রাণ। সমসাময়িক প্রাগ্রসর সমাজের সমগোত্রীদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান কখনো কখনো বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, প্রথম জীবনে কলকাতায় প্রায় বস্তি এলাকায় বসবাসের যে বর্ণনা সেখানে দরিদ্র, বঞ্চিত আর অভাজনদের জীবনযাপনের গল্প ভালোমন্দ মিলিয়ে বইতে উঠে এসেছে। কলকাতা শহরের ভেতর মানুষের যে জীবনান্দোলন ছিল আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি সেই চিত্রকে এক জায়গায় জড়ো করল।
সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে তাঁর অবস্থান কতটা পরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্যকর সে সম্পর্কে ধারণা পেতে 'বিষাদবৃক্ষ' গ্রন্থ থেকে একটি ঘটনা উদ্বৃত করতে চেষ্টা করি। মানুষের সাম্প্রদায়িক আচরণের নেপথ্য কারণ কেবল ধর্মে সীমাবদ্ধ থাকে না, তার পেছনে আছে বহুবিধ উপকরণ। তিনি যখন দেশত্যাগ করবেন তার আগে বাল্যবন্ধু দুলালের সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। মিহির সেনগুপ্তের ভাষ্যে সেই অংশটি এমন--"দুলালের সঙ্গে আমার দেশ ছাড়ার আগের দিনের কথায় ফিরে যাই। আমি ওকে আমাদের বাড়িঘর, গ্রামের সৌকর্য দেখিয়ে বলেছিলাম, দেখ, এইসব ছেড়ে আমাকে হিন্দুস্থান চলে যেতে হবে। ও ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, চলে যাবি? হিন্দুস্থানে? কেন? ও ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের সমস্যাগুলো, সংখ্যাগুরুরা যে বুঝতে পারে না তা সেদিন ওর প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, ও অজ্ঞতার ভান করছে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছিল অনেক পরে, পশ্চিমবঙ্গে এসে। এখানে সংখ্যাগুরু মানুষেরাও সংখ্যালঘুদের সমস্যা বুঝতে পারে না দেখলাম। তবে একই মানসিকতার একজন হিসাবে আামার বুঝতে কিছু অসুবিধা হয়নি। ব্যাপারটার মধ্যে একটা তীব্র হিনম্মন্যতার প্রশ্ন ওতপ্রোত, আর সে হীনম্মন্যতার জন্য সংখ্যাগুরুর অবজ্ঞা অনেকটাই দায়ী। দায়ী তাদের শিক্ষার অভাব এবং অজ্ঞতাও।"
কিঞ্চিদুর্দ্ধ অর্ধশতাব্দী আগের সংখ্যাগুরুর সংকীর্ণতা যেমন নির্মম এবং ট্র্যাজিক ছিল সেই জায়গা থেকে এখনো আমাদের উদ্ধার হয়নি। হিন্দুরা এখনো দেশত্যাগ করছে। শান্তি আর স্বস্তির জীবন তাঁদের এখানে হয়নি।
দু’দিন ধরে বইটা পড়েছি, আরো দু'দিন কেটেছে এটি নিয়ে লেখা আর ভাবনার আচ্ছন্নতায়। 'এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া'র সঙ্গে যাপিত এই চারদিনের সময়যাপন আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনের এককোণে জমা হল মধুরতম সম্পদ হয়ে, সুখবিলাস আর অপার আনন্দ হয়ে।