সদ্য শতবর্ষী ইদা বিতালে ও তাঁর তিনটি কবিতা

কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত গ্রন্থের জনয়িত্রী ইদা বিতালে কবিতার ভাষা, ভাবনা, আঙ্গিক ইত্যাদি নিয়ে প্রভূত পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 21 March 2024, 05:20 PM
Updated : 21 March 2024, 05:20 PM

অনুবাদ ও ভূমিকা: আলম খোরশেদ

নিকানোর পাররার (১৯১৪-২০১৮) পর আরও একজন লাতিন আমেরিকান কবি সম্প্রতি শতবর্ষের চৌকাঠ পেরুলেন। তিনি উরুগুয়াইয়ের বিখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, শিক্ষক ও অনুবাদক ইদা বিতালে (Ida Vitale)। ১৯২৩ সালের দোসরা নভেম্বর উরুগুয়াইয়ের রাজধানী মন্তেবিদেও শহরে জন্মেছিলেন ইতালীয় অভিবাসীর সন্তান, সাহিত্যের শতবর্ষী বরপুত্রী ইদা বিতালে। তাঁর বাড়িতে গোড়া থেকেই শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার আবহ বিদ্যমান ছিল। তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে মানবীবিদ্যার পাঠ গ্রহণ করেন এবং পাঠান্তে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতাতেও ছিল তাঁর তুমুল সক্রিয়তা। সেইসূত্রেই সাহিত্যজগতে, বিশেষত কবিতার আঙিনায় প্রবেশ ঘটে তাঁর, যা তাকে উরুগুয়াইয়ের সেইসময়কার বিখ্যাত, প্রভাবসঞ্চারী সাহিত্যগোষ্ঠী প্রজন্ম ৪৫ এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে তোলে, যে দলটির সদস্য ছিলেন হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি (১৯০৯-১৯৯৪), মারিও বেনেদিত্তি (১৯২০-২০০৯), কার্লোস মার্তিনেস মোরেনো (১৯১৭-১০৮৬), এমির রদ্রিগেস মনেগাল (১৯২১-১৯৮৫), আনহেল রামা (১৯২৬-১৯৮৩)র মতো দিকপাল সাহিত্যিকেরা।

এঁদেরই শেষোক্তজন, উরুগুয়াইয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যচিন্তক ও সমালোচক আনহেল রামার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি অবশ্য স্রেফ সাহিত্যিক ঘনিষ্ঠতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেটি প্রণয়ের পথ মাড়িয়ে একপর্যায়ে পরিণয়ে পরিণতি পায়। ১৯৫০ সালে তাঁরা বিয়ে করেন এবং ইদা তাঁর দুটি সন্তানের জননীও হন। ইদার চেয়ে তিন বছরের ছোট, আনহেল রামার সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যসম্পর্কটি বৌদ্ধিকভাবে যথেষ্ট ফলপ্রসূ হলেও অতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৬৯ সালে, ঠিক উনিশ বছর পরে তাঁরা স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হন। আর কী আশ্চর্য, ঠিক তার পরের বছরই ইদার জীবনে আসেন, রামারই এক ছাত্র, তাঁর চেয়ে পাক্কা আঠারো বছরের কনিষ্ঠ, মেধাবী তরুণ কবি এনরিকে ফিয়েররো (১৯৪১-২০১৬)। তাঁরা দ্রুতই পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন এবং তা সৌভাগ্যক্রমে ২০১৬ সালে ফিয়েররোর প্রয়াণ অবধি স্থায়ী হয়। ইতোমধ্যে ১৯৭৪ সালে উরুগুয়াইয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে গিয়ে সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের সূচনা হলে তাঁরা দুজন মেহিকোতে পাড়ি জমান, যেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় প্রখ্যাত কবি ও প্রবন্ধিক ওক্তাবিও পাসের। পাস (১৯১৪-১৯৯৮) তাঁকে তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা Vueltaর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেন, যা ইদার সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি সেখানকার একটি কলেজে পড়ানোও অব্যাহত রাখেন ইদা।

১৯৮৪ সালে সাময়িকভাবে উরুগুয়াই ফিরে এলেও বছর পাঁচেক পরেই তাঁরা আবারও যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যের অস্টিন শহরে স্বেচ্ছানির্বাসনের জীবন বেছে নেন। অবশ্য লেখালেখি এবং নানাবিধ সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে তাঁরা নিজেদের সম্পৃক্ত রাখেন আজীবন। ইদা এইসময় কবিতারচনার পাশাপাশি সমালোচনা সাহিত্য ও অনুবাদকর্মেও মনোনিবেশ করেন। তিনি ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষা থেকে অনুবাদে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদ তালিকায় রয়েছে সিমোন দ্য ব্যোভোয়ার ও লুইজি পিরানদেল্লোর মতো বিশ্ববিশ্রুত লেখকেরা। কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত গ্রন্থের জনয়িত্রী ইদা বিতালে কবিতার ভাষা, ভাবনা, আঙ্গিক ইত্যাদি নিয়ে প্রভূত পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, যা তাঁকে একজন প্রকৃত আভাঁ-গার্দ লেখকের অভিধায় আখ্যায়িত করে। উল্লেখ্য, সম্পূর্ণ গদ্যকবিতায় রচিত Boybu নামে একটি নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসও রয়েছে তাঁর। লাতিন আমেরিকার প্রায় সব কটি মর্যাদাবান পুরস্কারেই ভূষিত হয়েছেন ইদা, যার মধ্যে রয়েছে স্প্যানিশ সাহিত্যের জন্য সর্বোচ্চ স্বীকৃতি সের্ভান্তেস পুরস্কারও (২০১৮)। তিনি সমগ্র লাতিন আমেরিকার মধ্যে পঞ্চম নারী, যিনি এই গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এছাড়া বেশ কয়েকবার তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছে।

সাহিত্যিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে এখনও সমান সম্পৃক্ত ও সক্রিয় ইদা বিতালে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি তাঁর জীবনের এই মাইলফলকটিকে খুব বড় করে পরিমাপ করতে চান না, বরং তাঁর কবিতার পংক্তির মতোই, খুব বেশি দূরে না গিয়ে বাগানবিলাসের ঝাড়ের মধ্যে যে পাখিটির বাসা, তার কাছাকাছিই থাকতে চান, কেননা তিনি জানেন, এর চেয়ে দূরে গেলেই অসুন্দর, লালসা আর নৈরাজ্যের রাজত্ব শুরু হয়। আমরাও চাই, জীবনের বাকি দিনগুলি কবি যেন এমনই প্রশান্ত ও প্রসন্নচিত্তে তাঁর অনাবিল সৃষ্টির আনন্দে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকতে পারেন। 

অধ্যায়

যেখানে অবশেষে প্রকাশিত হয়

আমি কে, কী ছিলাম,

আমার শেষ বিশ্রামের স্থল,

তুমি কে, কী ছিলে,

তোমার পরবর্তী গন্তব্য,

আমরা যে-পথ নির্বাচন করি,

যে-বাতাস আমরা বহন করি,

এবং যেখানে ঘোষণা করা হয়

রত্নখনি আবিষ্কারের কথা,

সেই আলোকিত সূত্র

যা খুব পরিষ্কারভাবে

জগতের কাছে আমাদেরকে ব্যাখ্যা করে।

কিন্তু হায়, সেই অধ্যায়টি

কখনো রচিতই হয়নি।

সৌভাগ্য

বহু বৎসর ধরে নিজের ভুল ও তার

নিরাময়সমূহকে উপভোগ করা,

মুক্তভাবে কথা বলতে ও হাঁটতে পারা,

এবং বিকৃতি ব্যতিরেকে টিকে থাকা,

গির্জায় ঢোকা কিংবা না ঢোকা,

প্রিয় বই পড়া, প্রিয় গান শোনা,

দিনের আলোতে যেমন, রাতেও সেই একই ব্যক্তি থাকতে পারা,

পশুবিনিময় দ্বারা সম্পন্ন হওয়া

বিবাহ-সম্পর্কে প্রবেশে অসম্মতি জানানো,

আত্মীয়দের শাসন সহ্য না করা,

অথবা আইনি নিপীড়ন,

আর কখনোই কোনো মিছিলে যেতে না হওয়া

অথবা সেইসব শব্দকে ক্ষমা করা

যা রক্তস্রোতের গভীরে

লৌহচারা বপন করে।

নিজ থেকেই তোমার দৃষ্টির সেতুজুড়ে

অপর এক অপ্রত্যাশিত সত্তাকে আবিষ্কার করা,

একজন মানুষ ও নারী হতে পারা,

এর চেয়ে বেশিও নয়, কমও নয়।

দেয়ালকে দুর্বল করে দাও

কালের ব্রত: দেয়ালের বিপরীতে নিজেকে পরিমাপ করা,

তাকে দুর্বল করে দাও, তার কঠিন বন্ধনসমূহ খুলে ফেলো,

তার ধাতব পাতকে ভোঁতা করে দাও। তোমার অসহিষ্ণুতার

বিষয়ে মনোযোগী হও: দীর্ঘশ্বাসেরা ফিরে আসে ঝড়ের আদলে।

বাটোভি পাহাড়ের পেছন থেকে

সূর্যাস্ত উঁকি দেয়, রক্তপাতের মতো সুন্দর।

তোমার হৃদয়ে তো ছাই থাকার কথা:

এখনও সেখানে রক্ত।

জীবন: সে আসে পাখা কিংবা কাঁটালতা নিয়ে,

ফুলদানির জন্য পুষ্পস্তবক, হাসি কিংবা

পাথুরে নীরবতা নিয়ে। তারপর, দেয়াল।