Published : 07 Aug 2012, 12:46 AM
বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের কী ভূমিকা ছিলো তা এখনও আমাদের অনেকের কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, ফলে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে প্রচুর। বিরাজমান বিতর্ক বিমোচনে তরুণ দুই লেখক-গবেষক কুলদা রায় এবং এম এম আর জালাল খুটিনাটি তথ্য এবং অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণসহ এ বিষয়ে নতুন করে আলো ফেলেছেন গুরুত্বপূর্ণ এই দীর্ঘ লেখাটিতে।
১৭৬৫ সালের পর থেকেই বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা একত্রে ছিল। সে সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা দখল করে বসেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার মানুষের কাছ থেকে অর্থসম্পদ লুটপাট করা। যে কোনোভাবেই হোক না কেন খাজনা আদায়ই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। তারা একাজে স্থানীয় জমিদারদের ব্যবহার করে। সে সময়ে বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সূচনা হয়। খাবারের অভাবে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলা ছেড়ে পালিয়ে যায়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মানুষ নির্মম শোষণের শিকার হয়। ফলে সে সময় কিছু কিছু প্রজাবিদ্রোহও দেখা দিয়েছিল।
বাংলার সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যা যুক্ত থাকায় বাংলার আয়তন অতিরিক্ত বড় হয়েছিল। ফলে বনিক ইংরেজদের পক্ষে বড় বাংলাকে শাসন-শোষণ করা ঝামেলাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ কারণে ইংরেজরা বঙ্গকে ভাগ করার একটা পরিকল্পনা বহু পূর্ব থেকেই করে এসেছিল।
বঙ্গভঙ্গের আদিকথা
বঙ্গপ্রদেশের আয়তন ছিল সে সময় ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ছিল ৭৮,৫ মিলিয়ন। হিসাবটা ১৮৩৬ সালের। তখন বঙ্গে পূর্বাঞ্চল ভৌগলিক ও অপ্রতুল যোগাযোগ ববস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।
১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে গভর্নরের উপর অর্পন করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেটসহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত করা হয়।
১৮৯৬ সালে আসামের চীফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড প্রস্তাব করেন, চট্টগ্রাম ডিভিশন ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে একটি লেফটেনান্ট গভর্নর-শাসিত প্রদেশ গঠন করা হোক—কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী স্যার হেনরী কটন ও জনগণের প্রতিবাদে কেবল লুসাই পর্বতমালা হস্তান্তর করে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়। ১৯০১ সালে মধ্যপ্রদেশের চীফ কমিশনার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার সম্বলপুর-সহ উড়িষ্যাকে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করে বাংলার সীমানা-পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করলে ব্যাপারটি কার্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তাঁর বিখ্যাত Round and round নোটে (২৪ মার্চ ১৯০২) সমস্ত ব্যাপারটিকে ত্বরাণ্বিত করার হুকুম দিলেন। ফ্রেজার ২৮ মার্চ ১৯০৩ সালের নোটে ওয়ার্ডের পরিকল্পনাটি উপস্থাপিত করলে কার্জন তাঁর ১ জুন ১৯০৩ তারিখের নোটে 'একটি প্রজন্মের জন্য ভারতের শাসন-সীমানা' নির্দিষ্ট করে দেওয়ার আশা প্রকাশ করলেন। এরইপর ভিত্তি করে ভারত সরকারের প্রধান সচিব হার্বার্ট রিজলে বাংলা গভর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারিকে তার বিখ্যাত ৩ ডিসেম্বর ১৯০৩ তারিখের চিঠিতে Artificial agitation এবং interested outcry—এর সম্ভাবনা সত্বেও শাসনতান্ত্রিক নৈপুণ্য ও সুবিধার স্বার্থে সীমানা-পুনর্বিন্যাসের যৌক্তিকতা সমর্থন করলেন। রিজলি তার নোটে লিখেছিলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল বঙ্গদেশকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসন-বিরোধীদের দুর্বল করে দেওয়া।
একটি বিষবৃক্ষের সন্ধানে
সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ইংরেজরা একটা ধাক্কা খেয়েছিল। এই বিদ্রোহকে সামাল দিতে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে প্রজাদের যোগ ছিল না। তারা উনিশ শতকের শেষভাগে প্রজাসাধারণের উত্থানকে ভয় পাওয়া শুরু করে। তবে এই উত্থানটা তখনই ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে যখন সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে আসবে। ইংরেজরা হিসেব করে দেখল—মুগলদের শাসনকালে হিন্দুরা ধর্মীয় প্রসঙ্গে কখনোই বিদ্রোহী হয়ে উঠেনি। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মের খোলসে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু মুগলশাসকরা হিন্দুদের শাসনকার্যে কাজে লাগিয়েছে। এজন্য উত্তম সরকারী কর্ম পাবার জন্য বহু হিন্দু ফার্সী শিখে নিয়েছে। বিপরীতক্রমে ভারতের মুসলমানগণ নিম্নবর্গ থেকে ধর্মান্তরিত বলে শাসনকার্যের উপযোগী শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল। ফলে খাজনা আদায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে সকলপ্রকার শাসনকার্যে মুসলিম শাসকবর্গ হিন্দু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের কাজে লাগিয়েছে। আবার যখন ইংরেজরা মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে শাসনদণ্ড গ্রহণ করেছে তখন মুসলমানগণ শাসনক্ষমতা থেকে দূরে সরে গেছে—নিজস্ব ধর্মীয় খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
তারা শিক্ষিত-দক্ষ-অভিজ্ঞ-উচ্চাভিলাসী হিন্দু সম্প্রদায়কে কাজে লাগিয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ও এক্ষেত্রে ইংরেজদের কাছ থেকে সকলপ্রকার শিক্ষা-চাকরীসহ বৈষয়িক সুবিধাদি আদায় করেছে। তারা হয়েছে বাবু শ্রেণী। মুসলমানদের চেয়ে হয়েছে অর্থবান। ফলে এই দিক থেকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ভেদরেখা ছিল। তবে এই ভেদরেখাটি নিম্নবর্গের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ছিল না। এই নিম্নবর্গের মানুষরা ছিল সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়া শ্রেণী। এমন কি নিম্নবর্গের হিন্দুরা উচ্চবর্গের হিন্দুদের কাছে ছিল দলিত—আর নিম্নবর্গের মুসলমানগণ উচ্চবর্গের মুসলমান বা আশরাফ শ্রেণীর কাছে ছিল আতরাফ বা নিচুজাত। তাহলে দেখা যাচ্ছে রেশারেশিটা ছিল উচ্চবর্গের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে।
সৈয়দ মুজতবা আলী এই উচ্চবর্গের বিভেদ বিষয়ে 'বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি প্রবন্ধে' লিখেছেন—"আজ যদি শুধুমাত্র সংস্কৃত পুস্তকপত্র থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে হয় তাহলে এ দেশে মুসলমান ধর্ম আদৌ প্রবেশ করেছিল কিনা সে নিয়ে বিলক্ষণ তর্কের অবকাশ থাকবে। অথচ আমরা ভালো করেই জানি, মুসলমান-আগমণের পর প্রচুর সংস্কৃত পুস্তক লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা পাননি সত্য, কিন্তু তাঁদের ব্রহ্মোত্তর দেবোত্তর জমিজমার উপর হস্তক্ষেপ না হওয়ার ফলে তাঁদের ঐতিহ্যগত বিদ্যাচর্চা বিশেষ মন্দীভূত হয়নি। কিন্তু এইসব পণ্ডিতগণ পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থেকেই আপন আপন লেখনী সঞ্চালন করেছেন। …সেই ষঢ়দর্শননির্মাতা আর্য মণীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমণের পর সাত শত বৎসর ধরে যে আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু আলিসীনা (লাতিনে আভিসেনা), অল গজ্জালী (লাতিনে অল-গাজেল), আবু রূশদ (লাতিনে আভেরস) ইত্যাদি মণীষীগনের দর্শনচর্চা হল তার কোনো সন্ধান পেলেন না।
এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো-আরিস্তোতলের দর্শনচর্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি একবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। তিনি জানতেও পারলেন না যে, তিনি প্লাতোর আদর্শবাদ দৃঢ়ভূমিতে নির্মাণ করার জন্য যেসব যুক্তি আকাশ-পাতাল থেকে আহরণ করেছেন তাঁর পাশের চতুষ্পাঠীতেই হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্যের আদর্শবাদ সমর্থনার্থে সেইসব যুক্তিই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি 'গুলাত' নাস্তিকদের জড়বাদ যেভাবে খণ্ডণ করছেন, ব্রাহ্মণও চার্বাকের নাস্তিকতা সেইভাবেই খণ্ডন করছেন। এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক-সুশ্রুতের আরবী অনুবাদে পুষ্ঠ বু আলী সিনার চিকিৎসাশাস্ত্র—'য়ুনানী' নামে প্রচলিত (কারণ তার গোড়াপত্তন গ্রীক 'আইওনিয়ান=য়ুনানী' চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর)-আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করছেন, সেই চরক-সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ানো হচ্ছে।"
এই হল বিভাজনচিহ্ণ। এই বিভাজন রেখাকে চতুর ইংরেজ ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। বুঝে নিয়েছিল এই বিভাজন রেখায় স্ফুলিঙ্গ দিলে আগুন জ্বলে উঠবে। দুপক্ষকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে।
ফলে সরকার সে সময় ডিভাইড এন্ড রুল নীতি করে। তারা ঠিক করে হিন্দু মুসলমানদের ব্যবহার করা হবে একে অন্যের বিরুদ্ধে। এ জন্যে শিক্ষা ও চাকরীর ক্ষেত্রে মুসলমানদের কিছু বাড়তি সুযোগসুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারা আশা করে অচিরেই পূর্বে সুবিধাভোগী হিন্দুরা মুসলমানদের এই সুবিধাপ্রাপ্তিকে সন্দেহ করা শুরু করবে। এইভাবে বঙ্গে বিভেদের বিষবৃক্ষ রোপিত হল।
বঙ্গভঙ্গের প্রথম প্রতিবাদ
এলাহাবাদের দি পাইওনিয়ার পত্রিকায় মুদ্রিত প্রবন্ধ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে দি বাঙ্গালী প্রথম প্রতিবাদমূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে ১০ ডিসেম্বর ১৯০৩ তারিখে। এরপর ইন্ডিয়া গেজেটে রিজলের সম্পূর্ণ চিঠিটি প্রকাশিত হলে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। থ্রেটেন্ড পার্টিশন অব বেঙ্গল শিরোনামায় এই সময়ে প্রত্যহ দি বাঙ্গালী পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভার খবর ছাপা হতে থাকে।
অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদও ১৯০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্টার থিয়েটারে রমেশচন্দ্র দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ অধিবেশনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতির আশঙ্কা করে প্রস্তাবটি বিরোধিতা করে। কার্জন স্বভাবতই এইসব চেঁচামেচিতে বিরক্ত বোধ করেছেন। ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভারতসচিব ব্রডরিককে লিখলেন, 'বাঙালীরা নিজেদের একটা মহা জাতি মনে করে এবং তারা এমন একটা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন দেশ থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হয়েছে এবং জনৈক 'বাবু' কলকাতার লাট-প্রাসাদে অধিষ্ঠিত। এই সুখ-স্বপ্নের প্রতিকূল যে-কোনও ব্যবস্থা তারা নিশ্চয়ই ভীষণভাবে অপছন্দ করবে। আমরা যদি দুর্বলতাবশত: তাদের হট্টগোলের কাছে নতি স্বীকার করি তবে কোনও দিনই আর বাংলার আয়তন হ্রাস বা বাংলা ব্যবচ্ছেদ সম্ভব হবে না। (এ পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে) আপনি ভারতবর্ষের পূর্ব-সীমান্তে এমন একটা শক্তিকে সংহত ও সুদৃঢ় করবেন যা এখনই প্রচণ্ড, এবং ভবিষ্যতে যা সুনিশ্চিতভাবেই ক্রমবর্ধমান অশান্তির উৎস হয়ে উঠবে।
কার্জনরা ভারতে তাদের ভবিষ্যৎকে নিষ্কণ্টক করতে একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আয়োজন করলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন– উনিশ শতকের জাগরণ, ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি-দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাসের উদার পাঠ এদেশের মানুষের চেতনার বন্ধ দরোজায় আঘাত হানছে। পুরনো অন্ধকারের মধ্যে হাজার সূর্যের আলো পড়তে শুরু করেছে। রাজনীতি কেবলমাত্র আর সামন্তশ্রেণীর মধ্যে আটকে থাকছে না। প্রজাসাধারণের মধ্যেও শাসনতান্ত্রিক অধিকারবোধটি জাগ্রত হয়ে উঠছে। তারা আর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে না। আত্মশক্তির বোধটির জন্ম হচ্ছে।
বঙ্গভঙ্গের বিচ্ছেদ রঙ্গ
এরই অংশ হিসাবে কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে চলে গেলেন। তিনি ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহকে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দিলেন এবং নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করার মারাত্মক অস্ত্রে পরিণত করলেন। পাকিস্তানের বীজ রোপিত হল। এবং এক ধরনের হিন্দু নেতাদেরও হিংসার প্রবল বিষবৃক্ষ হিসাবে তৈরি করা হল। দেশের নতুন জাগ্রত চৈতন্যের মধ্যে পাপের জন্ম হল।
১৯০৪ সালের সীমানায় হস্তান্তরযোগ্য জেলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় রংপুর, বগুড়া ও পাবনা (৬ এপ্রিল), পাঁচমাস পরে (১৩ সেপ্টেম্বর) ভারত গভর্নমেন্ট রাজশাহী, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার হস্তান্তরের সুপারিশ করে। কিন্তু এগুলি হয়েছিল গোপনে, কার্জন তখন ভারতসচিব ও অন্যান্যদের মন থেকে দ্বিধার কাঁটা তুলে ফেলতে ব্যস্ত। ফলে প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে জনসাধারণের বিক্ষোভও স্তিমিত হয়ে আসে। এটা ছিল কার্জনের একটি কৌশল।
কার্জনের শিক্ষা সংকোচন পদক্ষেপ
কিন্তু কার্জন অন্যভাবেও বিক্ষোভ জাগিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। দীর্ঘ নীরবতার পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সুপ্রীম কাউন্সিলে একটি বিল আনেন। বিলটি আনার আগে তিনি ১৯০২ সালে ২৭ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ কমিশন নিয়োগ করেন। কার্জনের 'এফিসিয়েন্সি তত্ত্বের' মাধ্যমে শিক্ষা সংকোচনের নীতির প্রস্তাব রিপোর্টে করা হয়। সিনেটে সদস্য সংখ্যা কমিয়ে ইংরেজ সদস্য সংখ্যা বাড়ানো, বেসরকারী কলেজে আইন-পড়ানো বন্ধ করা, দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজগুলির অবলুপ্তি, শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে পাশ মার্ক ও বেতন বৃদ্ধি, সিন্ডিকেটের হাতে স্কুল-কলেজের স্বীকৃতিদান বা এফিলিয়েশন ও প্রত্যাহারের অপার ক্ষমতাদান প্রভৃতি সুপারিশও কার্জনের রিপোর্টে প্রস্তাব করা হয়।। কমিশনের অন্যতম সদস্য ডঃ গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই রিপোর্টের সঙ্গে দ্বিমত ঘোষণা করেন এবং স্বতন্ত্র প্রতিবাদী মন্তব্য পেশ করেন। আগস্টের গোড়ায় এই রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ হয়।
রবীন্দ্রনাথের নীরবতা
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ শুরুতে নেই। কোনো সভাতে অংশ নিতে তাঁকে দেখা যায় না। তিনি কোনো ব্ক্তৃতাও করছেন না। কোনো প্রবন্ধও লিখছেন না। ঠাকুরবাড়ির অনেকেই এই আন্দোলনে আছেন। এমন কি শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধেও রবীন্দ্রনাথ নীরবতা পালন করছেন। অথচ এর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। এই নীরবতায় অনেককে আশ্চর্য করে।
এই সময়ে তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। ছোটো গল্প লিখছেন। ঈশ্বর ও দেশ নিয়ে নৈবেদ্যের কবিতাগুলি লিখছেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা ওরফে বেলার বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে। শান্তি নিকেতনের বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। এবং তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন ২৩ নভেম্বর ১৯০২ সালে। লিখছেন নৌকাডুবি উপন্যাস। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর লেখালেখি চলছে।
রবীন্দ্রনাথ নীরবতা ভাঙলেন
১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন মজফ্ফরপুরে। সেখান থেকে সাময়িক প্রসঙ্গ শিরোণামে বঙ্গবিচ্ছেদ ও য়ুনিভার্সিটি বিল দুটি বিষয়েই তার নিজস্ব মত প্রকাশ করলেন। কার্জন কিছুদিন নীরব থাকলেন এবং প্রস্তাবটি পরিত্যাক্ত হয়েছে ভেবে আন্দোলনকারীরাও নিরব হয়ে গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ সরব হলেন। এই নিরবতার সময়টিকেই কবি কথা বলার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন, আন্দোলন যখন উত্তাল হইয়া উঠিয়াছিল আমরা তখন কোনো কথা বলি নাই; এখন বলিবার সময় আসিয়াছে।
তিনি এই দীর্ঘ আন্দোলন-মুখর সময়ে দূরে থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়ছেন। নিজের লোকজনের কাছে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তিনি বললেন, এই বঙ্গবিচ্ছেদ আন্দোলন অপূর্ব। অর্থাৎ এ ধরনের আন্দোলন এ দেশে পূর্বে হয় নি। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দেশে রাজনৈতিক উত্থান পর্বের সুচনা হয়েছে। দেশের মানুষের ঘুম ভেঙেছে রাজশক্তির তীব্র আঘাতে।
প্রচলিত রাজনীতির সমালোচনা
এর আগে কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলো ইংরেজ রাজশক্তির আশ্রয়ে থেকেই কথা বলেছে। তাদের নেতৃত্বে আছে ভূস্বামী বা জমিদার, উচ্চবিত্ত বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সিংহভাগ নিম্নবিত্তকে তারা কখনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে নি। তারা ইংরেজদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেই পছন্দ করেছে। তাদের শ্রেণীর কিছু চাওয়া-পাওয়া নিয়ে রাজশক্তির কাছে দেনদরবার করেছে—আবেদন নিবেদন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এটা ছিল এক ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি। দেশের মানুষের যে রাষ্ট্রশক্তির কাছে আবেদন নিবেদন নয়—অধিকার আছে, সে অধিকার দাবী করারও শক্তি আছে—সেটা তারা কখনো মনে করে নি।
তারা যেটা করেছে সেটা হল একধরনের বক্তৃতাবাজি। এই বক্তৃতাগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল নানা কায়দায় ইংরেজতোষণ। তাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার আকুতি। আর প্রাপ্ত সুবিধাদির জন্য কৃতজ্ঞতাবাচক শব্দজঞ্জাল সৃষ্টি করেছেন।এটুকু করেই তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। নিজেরা যে কিছু করতে পারেন সে ধরনের আত্মশক্তি এইসব নেতাদের ছিল না– ছিল না কোনো মনোবল-ব্যক্তিত্ব বা পরিকল্পনা । যখন তারা কখনো রাজশক্তির কাছে কোনো আবেদন নিবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন রাজভক্তির ভড়ং। 'সামলাইয়া কথা কহিবার প্রয়াস'।
তারা কখনো 'মনের কথা স্পষ্ট করিয়া কহিবার চেষ্টাই' করে নি। রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন এরা রাজনৈতিক সভাস্থলে দুই কূল রক্ষা বাঁচাইয়া কথা কহিবার চেষ্টা করিয়াছে। রাজশক্তির অজস্র গৌরচন্দ্রিকার দ্বারা তারা সর্বপ্রথমেই 'গোরার' মনোহরণব্যাপার সমাধা করিয়া তাহার পরে 'কালার' তরফের কথা তুলিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ এই মেরুদণ্ডহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে হতভাগ্য ও হতবল বলে কঠোর ভাষায় ধিক্কার দিয়েছেন। তাঁর মতে, তাদের এতকালের কর্মকাণ্ড সবই নিষ্ফল এবং উপহাসযোগ্য।
এই আন্দোলনের ইতিবাচক দিক
চলমান এই আন্দোলনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন– এবারই প্রথম রাজনীতিকরা দুটো বিষয়কে সকলের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন–
১. বিশ্ববিদ্যালয় বিলের মাধ্যমে ইংরেজরা এদেশের উচ্চশিক্ষা, স্বাধীন শিক্ষার মূলোচ্ছেদ করতে চায়।
২. বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাঙালিজাতিকে দুর্বল করতে চায়।
শিক্ষা ও ঐক্য—এ দুটো বিষয়ই জাতিমাত্রেরই আত্মোন্নতি ও আত্মরক্ষার চরমসম্বল। এ দুটোর উপর আঘাত পড়ায় দেশের মানুষ নড়ে চড়ে উঠেছে। নিজেদের মুখে নিজেদের কথা বলার একটা সুযোগ ঘটেছে। এই প্রথম রাজশক্তির প্রতি অবিশ্বাস জন্মেছে। এটা অভূতপূর্ব।
রবীন্দ্রনাথ এইটুকু বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি বিস্ময়কর রকমভাবে রাজনীতিকদের চরিত্র বিষয়ে একটি সত্যপ্রকাশ করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন—রাজশক্তির প্রতি অবিশ্বাস করা শুরু করলেও রাজশক্তির প্রতি বিশ্বাসের বন্ধন ছেদন করা যায়নি। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্রপথে সকল অর্জনই বেরিয়ে পড়ছে—ধরে রাখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ছিদ্রটি হল দেশের নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে এই রাজনীতিকদের কোনো সম্পর্কই নেই। মুষ্টিমেয় জমিদার, উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থেই অন্ধের মত চলছে। ফলে দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের হৃদয়ের সংযোগ নেই।
স্বদেশপ্রেম : নতুন অর্জন
কিন্তু এই অপূর্ব আন্দোলনটিকে স্বাগত জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মনে করেন, পরের কাছ থেকে সুস্পষ্ট আঘাত পেয়ে পরতন্ত্রতা শিথিল হলে নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে উঠবে। 'আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদের বিচ্ছিন্ন করিবে এ কথা আমাদের কোনোমতেই স্বীকার করিব না। বিচ্ছেদের চেষ্টাতেই আমাদের ঐক্যানুভূতি দ্বিগুণ করিয়া তুলিবে। পূর্বে জড়ভাবে আমরা একত্র ছিলাম, এখন সচেতনভাবে আমরা এক হইব। বাহিরের শক্তি যদি প্রতিকূল হয়, তবেই প্রেমের শক্তি জাগ্রত হইয়া প্রতিকারচেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে। সেই চেষ্টাই আমাদের লাভ।
এই দেশ প্রেম একটা শক্তি, তার নাম দেশ প্রেম। এই শক্তি যখন হৃদয়ের সম্মিলনের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তা পরিণত হয় এক মহাশক্তিতে। এই মহাশক্তি দিয়ে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যে প্রবল লড়াই করা যায়–সেই লড়াইটারই সূচনাপর্ব রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন। এর আগে বাংলায় এই দেশপ্রেমের উন্মেষ রবীন্দ্রনাথের আগে কেউ এভাবে দর্শন করতে পারেন নি।
১৯০৪ সালের ১৬ জুন বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে।
শিক্ষা বিষয়ে ভাবনা
কার্জনের শিক্ষা সংকোচন বিল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, বিলিতি য়ুনিভার্সিটির ব্যয়বহুল আয়োজন দেশীয় জীবনযাত্রার জন্য সংগতিপূর্ণ নয়, 'আমাদের সমাজ শিক্ষাকে সুলভ করিয়া রাখিয়াছিল—দেশের উচ্চনিচ্চ সকল স্তরেই শিক্ষা নানা সহজ প্রণালীতে প্রবাহিত হইতেছিল। কিন্তু বিলিতি আদর্শে শিক্ষা যদি দুর্মূল্য হয় তবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অত্যন্ত বৃহৎ হয়ে উঠবে।
অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে ছাত্র ও অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যবধান নেই, তাই শিক্ষাদানের উন্মুখতা ও বিদ্যালাভের জন্য প্রস্তুতি মানসিক সাযুজ্য প্রাপ্ত হয়। তিনি এক্ষেত্রে বিদেশী শিক্ষা অধিকর্তা পেডলারের সঙ্গে সেই মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করা অতি দুরুহ ও অনিষ্টকর বলে ঘোষণা করেন, 'হৃদয়ে হৃদয়ে যেখানে স্পর্শ নাই, যেখানে সুস্পষ্ট বিরোধ ও বিদ্বেষ আছে, সেখানে দৈববিড়ম্বনায় যদি দানপ্রতিদানের সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তবে সে-সম্বন্ধ হইতে শুধু নিষ্পলতা নহে, কুফলতা প্রত্যাশা যায়। জাপানের মতো সুযোগ ও আনুকূল্য পেলে সহজেই ভারতীয়রা সেই শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লাচন্দ্রের সাধনা ও সাফল্য উল্লেখ করেন।
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ নিজেদের বিদ্যাদানের ব্যবস্থা নিজেদেরই করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তিনি লিখেছেন, এ স্থলে আমাদের একমাত্র কর্তব্য, নিজেরা সচেষ্ট হওয়া, আমাদের দেশে ডাক্তার জগদীশ বসু প্রভৃতির মতো যে-সকল প্রতিভাসম্পন্ন মনস্বী প্রতিকূলতার মধ্যে থাকিয়াও মাথা তুলিয়াছেন, তাঁহাদিগকে মুক্তি দিয়া তাঁহাদের হস্তে দেশের ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার স্বাধীন অবকাশ দেওয়া; অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা-অনাদরের হাত হইতে বিদ্যাকে উদ্ধার করিয়া দেবী সরস্বতীর প্রতিষ্ঠা করা; জ্ঞানশিক্ষাকে স্বদেশের জিনিস করিয়া দাঁড় করানো; আমাদের শক্তির সহিত, সাধনার সহিত, প্রকৃতির সহিত তাহাকে অন্তরঙ্গরূপে সংযুক্ত করিয়া তাহাকে স্বভাবের নিয়মে পালন করিয়া তোলা।'
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনা
বঙ্গভঙ্গ, য়ুনিভার্সিটি বিল ও দেশের কথা এই তিনটি সাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঐক্য ও আত্মশক্তির কথা বলেছিলেন। তাকেই তিনি একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আকারে হাজির করলেন স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে।
তিনি প্রথমেই ঘোষণা করেন, আমাদের যে-সকল অভাব বিদেশীরা গড়িয়াছে ও তুলিতেছে, সেগুলো না হয় বিদেশী পূরণ করুক। …আমাদের দেশে সরকার বাহাদুর সমাজের কেহই নন, সরকার সমাজের বাহিরে। অতএব যে-কোনো বিষয়ে তাঁহার কাছ হইতে প্রত্যাশা করিব, তাহা স্বাধীনতার মূল্য দিয়া লাভ করিতে হইবে। যে-কর্ম সমাজ সরকারের দ্বারা করাইয়া লইবে, সেই কর্মসম্বন্ধে সমাজ নিজেকে অকর্মণ্য করিয়া তুলিয়া তুলিবে। অথচ এই অকর্মণ্যতা আমাদের দেশের স্বভাবসিদ্ধ ছিল না। আমরা নানা জাতির, নানা রাজার আধীনতাপাশ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু সমাজ চিরদিন আপনার সমস্ত কাজ আপনি নির্বাহ করিয়া আসিয়াছে, ক্ষুদ্রবৃহৎ কোনো বিষয়েই বাহিরের কাহাকেই হস্তক্ষেপ করিতে দেয় নাই। সেইজন্য রাজ্যশ্রী যখন দেশ হইতে নির্বাসিত, সমাজলক্ষ্মী তখনো বিদায় গ্রহণ করেন নাই।
এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন বাঙালির চিত্ত ঘরমুখ নিয়েছে। স্বদেশের শাস্ত্র, স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের মাধ্যমে অলঙ্কৃত হয়ে উঠছে। তারচেয়েও বড় বিষয় হল—স্বদেশের শিল্পদ্রব্য নিজেদের কাছে আদর পাচ্ছে, স্বদেশের ইতিহাস বাংলার গবেষণাবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলছে।
এ সময় রাজনৈতিক সাধনার চরম উদ্দেশ্য একমাত্র দেশের হৃদয়কে ধারণ করাই সকলের কর্তব্য। সে হৃদয়কে ধারণ করার জন্য করণীয় তিনি নির্ধারণ করেছেন–
১. কৃষিমেলার আয়োজন
তিনি বিলেতি ধরনের সভার বদলে দেশী ধরনের মেলা করার প্রস্তাব করেন। সেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্ত হতে একত্র হবে। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হবে। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে ম্যাজিক-লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদেরকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশসুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের যা কিছু বলার কথা আছে, যা-কিছু সুখদুঃখের পরামর্শ আছে তা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলে সহজ বাংলা ভাষায় করতে হবে।
২. হিন্দু-মুসলমান মিলন
প্রত্যেক জেলার ভদ্র শিক্ষিত সম্প্রদায় তাহাদের জেলার মেলাগুলিকে যদি নবভাবে জাগ্রত, নবপ্রাণে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন, ইহার মধ্যে দেশের শিক্ষিতগণ যদি তাহাদের হৃদয় সঞ্চার করিয়া দেন, এই-সকল মেলায় যদি তাহারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করেন—কোনোপ্রকার নিষ্ফল পলিটিক্সের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচর-জমি প্রভৃতি সম্বন্ধে জেলার যে-সমস্ত অভাব আছে, তাহার প্রতিকারের পরামর্শ করেন, তবে অতি অল্পকালের মধ্যে স্বদেশকে যথার্থই সচেষ্ট করিয়া তুলিতে পারেন।
৩.ধর্মীয় দূষিত মেলা সংস্কার
কবি দেখেছেন আমাদের দেশে যে-সকল মেলা ধর্মের নামে প্রচলিত আছে—সেগুলোর অধিকাংশই লোকশিক্ষার অযোগ্য হয়ে উঠে হয়েছে—কুশিক্ষারও মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তিনি এইসব কুৎসিত আমোদের উপলক্ষ এই ধর্মীয় মেলাগুলোকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন। তার বদলে দেশী মেলার আয়োজন করতে হবে।
৪. নতুন ধরনের নেতৃত্ত্ব সন্ধান : জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের রূপরেখা
স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে উপলদ্ধির কথা বলেন। শর্করারস যেমন একটি সূত্রকে অবলম্বন করে মিছরির দানায় পরিণত হয়, তেমনি সমাজের বিচ্ছিন্ন শক্তি ও কর্মপ্রয়াসকে সংহত করার জন্য তিনি একজন সমাজপতি মনোনয়নের কথা বলছেন। তিনি বলেন, এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।
এজন্য একজন সমাজপতি দরকার। তার সঙ্গে তার পার্ষদসভা থাকবে। তারা সবাই মিলে সমাজের সমস্যা, সমাজের মানুষের জন্য করণীয়-কর্তব্য নিরূপণ করবে। সেখানে সকলে আলোচনা করবেন। লোকসাধারণ প্রাণ খুলে তাদের কথা বলতে পারবেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গৃহীত হবে এবং সেগুলো সমাজপতির নেতৃত্ত্বে বাস্তবায়ন করা হবে। এইভাবে তিনি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এটাকে একটি স্বাধীন জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, বাহির হইতে যে উদ্যত শক্তি প্রত্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা ঐক্যবদ্ধ, তাহা দৃঢ়—তাহা আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিদিনের দোকানবাজার পর্যন্ত অধিকার করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষগম্য করিয়াছে। এখান সমাজকে ইহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে হইলে অত্যন্ত নিশ্চিতরূপে তাহার আপনাকে দাঁড় করাইতে হইবে।
এই স্থানীয় সরকার বা সমাজের প্রধান সমাজপতি কখনো ভালো, কখনো মন্দ হইতে পারেন, কিন্তু সমাজ যদি জাগ্রত থাকে, তবে মোটের উপরে কোনো ব্যক্তি সমাজের স্থায়ী অনিষ্ট করিতে পারে না। তার নেতৃত্বেই সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এর অধীনে দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন নায়ক নিযুক্ত হবেন। সমাজের সমস্ত অভাবমোচন, মঙ্গলকর্মচালনা ও ব্যবস্থারক্ষা এঁরা করবেন এবং সমাজপতির নিকট দায়ী থাকবেন। তিনি বিশেষভাবে বলেন, আমাদের দেশে মধ্যে মধ্যে সামান্য উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমানে যে বিরোধ বেধে ওঠে, সেই বিরোধ মিটিয়ে দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রীতিশান্তিস্থাপন, উভয় পক্ষের স্ব স্ব অধিকার নিয়মিত করে দেবার বিশেষ কর্তৃত্ব সমাজপতির নেতৃত্বে থাকবে।
সমাজপতির হওয়ার মতো এমন লোক পাওয়া কঠিন। একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়ে তোলা না করা গেলে এই সমাজপতি নির্বাচন করা কঠিন। এ সমস্ত সমস্যা থাকা সত্বেও তিনি লিখেছেন, যদি সমাজপতি-নিয়োগের প্রস্তাব সময়োচিত হয়, যদি রাজা সমাজের অন্তর্গত হওয়াতে সমাজ অধিনায়কের যথার্থ অভাব ঘটিয়া থাকে, যদি পরজাতির সংঘর্ষে আমরা প্রত্যহ অধিকারচ্যূত হইতেছি বলিয়া সমাজ নিজেকে বাঁধিয়া তুলিয়া দাঁড়াইবার জন্য ইচ্ছুক হয়, তবে কোনো একটি যোগ্য লোককে দাঁড় করাইয়া তাঁহার অধীনে এক দল লোক যথার্থভাবে কাজে প্রবৃত্ত হইলে এই সমাজ-রাজতন্ত্র দেখিতে দেখিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিবে—পূর্ব হইতে হিসাব করিয়া কল্পনা করিয়া আমরা যাহা আশা করিতে না পারিব, তাহাও লাভ করিব—সমাজের অন্তর্নিহিত বুদ্ধি এই ব্যাপারের চালনাভার আপনিই গ্রহণ করিবে।
রবীন্দ্রনাথের তৎপরতা
এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মজফ্ফরপুরে। কলকাতায় ফিরেই তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে পড়ে শোনালেন। অন্য কিছু ব্যক্তিকেও তাঁর স্বদেশভাবনা বিষয়ক পরিকল্পনার কথা জানালেন। চৈতন্য লাইব্রেরী এন্ড বীডন স্কোয়ার লিটারেরি ক্লাবের উৎসাহী সম্পাদক গৌরহরি সেন ২২ জুলাই ১৯০৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধপাঠের ব্যবস্থা করেন।
প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীতে জানাচ্ছেন যে, চৈতন্য লাইব্রেরীর এই প্রবন্ধপাঠের বিষয়বস্তু মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ায় প্রায় এক হাজার জন ছাত্র ও জনসাধারণ সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু তাদের জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ফলে সভাস্থলে ও সভার বাইরে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়—কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে মারামারি ও ইঁটপাটকেল ছোঁড়া কিছুই বাদ যায়নি। রবীন্দ্রনাথ বিষয়গুলি বিস্তৃতভাবে বলে উপসংহারে প্রবন্ধ-লেখক স্বদেশের পূজার জন্য সকলকে কবিত্বপূর্ণ ভাষায় আহ্বান করেছিলেন। কলকাতা শহরের অনেক গণ্যমান্য লোক কবির এই প্রবন্ধপাঠ শুনে চিত্রার্পিতের ন্যায় নীরবে শুনেছিলেন।
যারা প্রবন্ধটি শুনতে পারেননি তাদের অনুরোধে মিনার্ভা হলে কবি আবার প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেখানে ৩০ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটি ২০০০ কপি ছেপে বিতরণ করা হয়েছিল পাঠের আগে। প্রবন্ধটিতে কিছু বক্তব্য সংযোজন করেছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথের গায়ে জ্বর ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। একটি চেয়ারে বসে প্রবন্ধটি পাঠ করেন।
রাজনীতিতে বাঁক পরিবর্তনের লক্ষণ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে রাজনীতি আর পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। রাজনীতির একটি নূতন বাক পরিবর্তন ঘটছে। তিনি বলেন, দেশ যখন একদা জাগ্রত হইয়া 'কনষ্টিটিউশনাল অ্যাজিটেশনে'র রেখা ধরিয়া রাজ্যেশ্বরের দ্বারের মুখে ছুটিয়াছিল, তখন সমস্ত শিক্ষিত সমাজের বুদ্ধিবেগ তাহার মধ্যে ছিল। আজ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে সেই স্রোতের পথ বাঁক লইবার উপক্রম করিতেছে।…যাঁহারা সাধনাদ্বারা, তপস্যাদ্বারা, ধীশক্তিদ্বারা ইংরেজশিক্ষিত সমাজের চিত্তকে স্বদেশের কার্যে চালিত করিয়াছেন, স্বদেশের কার্যে একাগ্র করিবার আয়োজন করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে আমি ভক্তির সহিত নমস্কার করি। তাঁহারা যে পথে গিয়াছিলেন সে পথে যাত্রা যে ব্যর্থ হইয়াছে, এ আমি কখনোই বলিব না। তখন সমস্ত দেশের ঐক্যের মুখ রাজদ্বারেই ছিল।
…এখন সে চিরন্তন সমুদ্রের আহ্বান শুনিয়াছে—এখন সে আত্মশক্তি আত্মচেষ্টার পথে সার্থকতালাভের দিকে অনিবার্যবেগে চলিবে, কোনো-একটা বিশেষ মুষ্টিভিক্ষা বা প্রাসাদলাভের দিকে নহে। এই-যে পথের দিক-পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দিতেছে ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের কৃতকর্ম নহে—যে চিত্তস্রোত প্রথমে এক দিকে পথ লইয়াছিল ইহা তাহারই কাজ, ইহা নূতন স্রোত নহে।
সভাভঙ্গের আগে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আরও কিছু কথা বলেন লিখিত বক্তব্যের বাইরে। বলেন, আজ সমবেত ব্যক্তিগণকে সমবেত ব্যক্তিগণকে সাহিত্যরস দেওয়ার জন্য আমি দাঁড়াই নাই। শুধু উদ্দীপনায় কোনো কাজই হয় না; আগুন জ্বালাইতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে হাঁড়িও চড়াইতে হইবে।..আমরা যেন প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষুদ্রভাবে দেশের জন্য কাজ করিতে পারি। আমার প্রস্তাব—প্রত্যেকে নিজেদের গৃহে স্বদেশের জন্য যদি প্রত্যহ কিছু উৎসর্গ করিয়া রাখেন তবে ভবিষ্যতে সেই সঞ্চয় কাজে লাগিবে। তাহা ছাড়া উহা আমাদের একটা চেতনা প্রবুদ্ধ করিয়া রাখিবে। …আমাদের স্বদেশ ভক্তিও যেন সেইরূপ কোনো সভা-সমিতির তাগিদের প্রতীক্ষা না করিয়া নীরবে আপন কার্য সমাপন করে। স্বদেশের কাজ যেন বৃহৎ বাহ্য অনুষ্ঠানে পরিণত না হয়।
রবীন্দ্রনাথের জনসংযোগ
প্রবন্ধপাঠের পরে তিনি কলকাতার বিদ্বজ্জনের কাছে এই বার্তা নিয়ে আলোচনা করতে ছুটে বেড়ালেন। ২৯ জুলাই সকাল সন্ধ্যায় দুবার গেলেন সুকিয়া স্ট্রিটে, ৩০ জুলাই গেলেন বসুপাড়ায় সিস্টার নিবেদিতার কাছে, ১ আগস্ট গেলেন নারকেলডাঙায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, ২ আগস্ট শ্যামবাজার ও কর্ণওয়ালিস স্টিটে, ৪-৫ আগস্ট গিয়েছেন পার্শিবাগান, ৬ আগস্ট আবার কর্ণওয়ালিস স্টিটে গিয়েছেন। উদ্দেশ্য স্বদেশী সমাজ গঠন। এছাড়া নিজেদের জোড়াসাঁকোতে প্রতিদিন নানাজন আসছেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠিতে জানিয়েছেন, একটা সমাজ গঠনের জন্যে চেষ্টা চলছে।
স্বদেশী সমাজ গঠনের প্রথম উদ্যোগ অমল হোম অনুসন্ধান করে বের করেছেন– স্বদেশী সমাজ গঠনের কিছু তথ্য পাওয়া যায় দি ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে। ছাপা হয়েছিল ১৯৪১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেখানে স্বদেশী সমাজের একটি খসড়া সংবিধান দেওয়া হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে—আমরা স্থির করিয়াছি আমরা কয়েকজন মিলিয়া একটি সমাজ স্থপান করিব।
আমাদের নিজের সম্মিলিত চেষ্টায় যথাসাধ্য অভাব মোচন ও কর্তব্য-সাধন আমরা নিজে করিব, আমাদের শাসনভার নিজে গ্রহণ করিব, যে-সকল কর্ম আমাদের স্বদেশীয়ের দ্বারা সাধ্য তাহার জন্য অন্যের সাহায্য লইব না। এই অভিপ্রায়ে আমাদের সমাজের বিধি আমাদের প্রত্যককে একান্ত বাধ্যভাবে পালন করিতে হইবে। অন্যথা করিলে সমাজবিহিত দণ্ড স্বীকার করিব।
সমাজের অধিনায়ক ও তাহার সহায়কারী সচিবগণকে তাঁহাদের সমাজনির্দিষ্ট অধিকার অনুসারের নির্বিচারে যথাযোগ্য সম্মান করিব।
বাঙালী মাত্রেই এ সমাজে যোগ দিতে পারিবেন।
সাধারণত ২১ বৎসরের নীচে কাহাকেও গ্রহণ করা হইবে না।
এ সভার সভ্যগণের নিম্নলিখিত বিষয়ে সম্মতি থাকা আবশ্যক:
১) আমাদের সমাজের ও সাধারণ ভারতবর্ষীয় সমাজের কোনো প্রকার সামাজিক বিধিব্যবস্থার জন্য আমরা গবর্নমেন্টের শরণাপন্ন হইব না।
২) ইচ্ছাপূর্বক আমরা বিলাতি পরিচ্ছদ ও বিলাতি দ্রব্যাদি ব্যবহার করিব না।
৩)কর্মের অনুরোধ ব্যতীত বাঙালীকে ইংরেজিতে পত্র লিখিব না।
৪) ক্রিয়াকর্মে ইংরেজী খানা, ইংরেজি সাজ, ইংরেজি বাদ্য, মদ্যসেবন এবং আড়ম্বরের উদ্দেশ্য ইংরেজ-নিমন্ত্রণ বন্ধ করিব। যদি বন্ধুত্ব বা অন্য বিশেষ কারণে ইংরেজ-নিমন্ত্রণ করি, তবে তাহাকে বাংলা রীতিতে খাওয়াইব।
৫) যতদিন না আমরা নিজেরা স্বদেশী বিদ্যালয় স্থাপন করি ততদিন যথাসাধ্য স্বদেশীচালিত বিদ্যালয়ে সন্তানদিগকে পড়াইব।
৬) সমাজস্থ ব্যক্তিগণের মধ্যে যদি কোনো প্রকার বিরোধ উপস্থিত হয় তবে আদালতে না গিয়া সর্বাগ্রে সমাজনির্দিষ্ট বিচারব্যবস্থা গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিব।
৭)স্বদেশী দোকান হইতে আমাদের ব্যবহার্য ক্রয় করিব।
৮) পরস্পরের মধ্যে মতান্তর ঘটিলেও বাহিরের লোকের নিকট সমাজের বা সামাজিকের নিন্দাজনক কোনো কথা বলিব না।
এই দীর্ঘ সংবিধানে সমাজের কার্যপ্রণালীর খুঁটিনাটি, এমন-কি কর প্রদানের ব্যবস্থাদিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রবীন্দ্রনাথের এই স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে সময়। একে আকাশকুসুম রচনা বলেছিলেন কেউ কেউ। ১১ আগস্ট সঞ্জীবনীতে একটি দীর্ঘ সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র। তিনি লিখেছিলেন, রবীন্দ্রবাবুর ন্যায় একজন শিক্ষিত লোকও রাজশক্তি, সমাজশক্তি ও আমাদের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পারেন, এবং আকাশকুসুম রচনা করিয়া তাহারই পশ্চাতে ধাবিত হইবার জন্য আহ্বান করিতে পারেন, ইহা আশ্চর্যের বিষয়। বিশিষ্ট কংগ্রস নেতা পৃথ্বীশচন্দ্র রায় শ্রাবণ-সংখ্যা ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক মতামতকে 'দেশের পক্ষে বিশেষ অনিষ্টকর ও নানা দোষে দুষ্ট' বলে সমালোচনা করেন। যতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এই প্রবন্ধকে একটি সামাজিক কবিতা বলে উপহাস করেন।
এই স্বদেশী সমাজ গঠন কার্যক্রম আর এগোতে পারে নি। গোঁড়া হিন্দুসমাজী ও রাজনীতিকদের বিরোধিতার জন্যই সম্ভবত স্বদেশী সমাজ পরিকল্পনার অপমৃত্যু ঘটে।
স্বদেশী সমাজের সঙ্গে বিপ্লবীদেরও সম্পর্ক হয়েছিল। এ বিষয়ে বিপ্লবী ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন—
অনুমান হয় ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে বারীন্দ্র প্রভৃতি কর্ম্মীদের দ্বারা অনুরুদ্ধ হইয়া আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে একটি পত্র লিখি যে, আমরা ভারতীয় সভার (কংগ্রস) সহযোগে কর্ম্ম করিতে প্রস্তুত নই। তাঁহার সহিত সংযুক্তভাবে কর্ম্ম করিতে চাই। ইহাতে তিনি তাঁহার দ্বারকানাথ ঠাকুর ষ্ট্রীটস্থ বাসায় আমাকে আহ্বান করেন এবং বলেন, ''আমার ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহিত এই বিষয়ে কথা কও''…।
ইহাতে সখারাম বাবু, দেবব্রত বাবু এবং আমি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বালিগঞ্জের বাড়ীতে যাই। তিনি বলিলেন, রবি বাবু আমায় জিজ্ঞাসা করেন, 'ইঁহারা কাহারা?'' আমি সব কথা বলি। তিনি বলেন, তিনি বক্তৃতা এবং সাহিত্য দ্বারা কার্য্য করিবেন। ইহাতে সখারাম বাবু ব্যঙ্গ করেন—'কবিতা লিখিয়া ভারতোদ্ধার হইবে না।'' পরে এই সহযোগিতার তাগাদার জন্য ব্যোমকেশ মুস্তফীর সহিত সাহিত্য-পরিষদ অফিসে…আমি সাক্ষাৎ করি। তিনি 'স্বদেশী সমাজ' পরিকল্পনা লইয়া ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বলিলেন এই কর্ম্মপদ্ধতি এখনও সম্পূর্ণভাবে লিখিত হয় নাই। লিখিত কর্ম্মপদ্ধতির পাণ্ডুলিপির মুদ্রিত প্রুফ তিনি তৎকালে দেখিতেছিলেন এবং বলিলেন, পরিকল্পনা পূর্ণভাবে তৈয়ারী হইলে পরীক্ষার জন্য একস্থলে তাহা বাস্তবিক কর্ম্মে পরিণত করার চেষ্টা হইবে।..পরে এই দলের কোন এক মিটিং-এ রবি বাবু আমাদের ডাকিয়াছিলেন। আমি তখন 'ভবানী মন্দির' পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে বিহারে প্রেরিত হইয়াছিলাম। প্রত্যাবর্তন করিয়া অন্নদা কবিরাজের কাছ হইতে ইহা শুনিলাম' তিনি এই আহ্বানে এই সভায় গমন করিয়াছিলেন। সভায় নানাদল নানাকথা বলে, রবি বাবু তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, 'আপনার কি মত'! কবিরাজ জবাব দেন, 'আমরা তর্ক করিতে অক্ষম, কার্য্য দিন, করিতে প্রস্তুত।' রবি বাবু বলিলেন, 'তাহা আমি জানি।'
তবে এই কার্য্যক্রম আর না এগুলেও স্বদেশী বিপ্লবীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিছু যোগাযোগ ছিল। তিনি পূর্ববঙ্গে তার গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পে তাঁদের কাউকে কাউকে কাজে লাগিয়েছিলেন।
বেঙ্গলী পত্রিকার ৩ আগস্ট সংখ্যায় একটি খবরে জানা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ স্টার থিয়েটারে বিকেল পাঁচটায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে বিপিনচন্দ্র পাল বক্তব্য রাখবেন। বিষয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন– রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত ছিলেন সভায়। এই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে স্ট্যান্ডিং কমিটি হয় তাতে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, ঠাকুরবাড়ির জামাই স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল, মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভাতিজা গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে রাখা হয়নি। তিনি এই আন্দোলন থেকে প্রত্যক্ষভাবে একটু সরেই ছিলেন। প্রশান্তকুমার পাল এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, সম্ভবত ঝড়ের কেন্দ্রস্থলে না থেকে দূর থেকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিটি কবি বুঝে নিতে চাইছিলেন। তাঁর কৌশলটি হল—এভাবে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থার পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হবে।
ভাদ্র-সংখ্যা বঙ্গদর্শনে 'স্ত্রীসমাজে' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে মেয়েদেরকে এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি লিখেছেন—জগতে স্ত্রীলোক যদি বা যুদ্ধ না করিয়া থাকে, ত্যাগ করিয়াছে; সময় উপস্থিত হইলে ভূষণ হইতে প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। …আজ আমাদের বঙ্গদেশ রাজশক্তির নির্দয় আঘাতে বিক্ষত হইয়াছে, আজ বঙ্গ রমণীদের ত্যাগের দিন। আজ আমরা ব্রতগ্রহণ করিব। আজ আমরা পীড়িত জননীর রোগসজ্জায় বিলাতের সাজ পরিয়া শৌখিনতা করিতে যাইব না। বয়কট আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর চিন্তার স্বতন্ত্রতা প্রকাশ পেয়েছিল 'অবস্থা ও ব্যবস্থা' ভাষণে। প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন টাউন হলে ২৫ আগস্ট। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব ও বাঙ্গালীদের বিলেতি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনকে ক্ষতির দিক থেকে দেখেননি। তিনি দেখেছেন লাভের দিক থেকে। একই সঙ্গে তিনি ইংরেজ উপনিবেশকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন।
বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্যের সম্ভানা জেগেছে। এই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে স্বদেশী সমাজ গঠন করা যায় সে বিষয় ইতিপূর্বে তিনি পরিকল্পনা হাজির করেছিলেন। সেজন্য রাজনীতিকরা তাকে উপহাস করেছিলেন। সে উপহাসেও তিনি দমিত হননি। তিনি মনে করেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আঘাতের ফলে যে বাঁক বদলটি ঘটছে রাজনীতিতে—তাতে রাজনীতি কেবলমাত্র রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। রাজনীতি চলে আসতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের দরোজায়। এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। পূর্বে রাজন্যবর্গ-শাসিত রাষ্ট্রে প্রজাসাধারণের কর দেওয়া ছাড়া শাসন ক্ষমতা নির্ধারণে কোনো ভূমিকাই ছিল না। তারা ছিল রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক—জড় পদার্থের ন্যায় ছিল তাদের অবস্থা। এখন তাদের মধ্যে প্রাণসঞ্চারের সুযোগ এসেছে।
সুতরাং এই সময়ে কিছু কর্তব্যের তাড়নায় তিনি মুখর হয়েছেন। তাঁকে এর আগে যারা উপহাস করেছিলেন, তাদের উপহাসকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, স্বদেশের কর্মভার দেশের লোকের নিজেদের গ্রহণ করিবার চেষ্টা একটা পাগলামী নহে—বস্তুত দেশের হিতেচ্ছু ব্যক্তিদের এইরূপ চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। তিনি সেটাই করছেন।
বৃটিশ শাসকদের সমালোচনা
রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ শাসনের কঠোর সমালোচনা করে তাদের শোষণ প্রক্রিয়াটি তুলে ধরেছেন অবস্থা ও ব্যবস্থা প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, ইহা আমরা স্পষ্টত দেখিয়াছি, যে-সকল জাতি ইংরেজের সঙ্গে বর্ণে ধর্মে প্রথায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তাহাদিগকে ইহারা নিজের পার্শ্বে স্বচ্ছন্দ্যবিহারের স্থান দিয়াছেন এমন ইহাদের ইতিহাসে কোথাও নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংরেজদের উপনিবেশের উদাহরণ দিয়েছেন—এশিয়ার লোকদের ইংরেজরা কোনো প্রকারেই আশ্রয় দেয় না। ব্যবসায় অথবা বসবাসের জন্য তাদেরকে ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না—যদি কেউ এশিয়ানদের ঘর ভাড়া দেয় তাহলে তাদের প্রতি ইংরেজরা অসন্তুষ্ট হয়। এশিয়ীদের দোকান থেকে ইংরেজরা কিছু কেনে না। এদের দোকানে অন্য কাউকে কিনতে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। ইংলন্ডে সে সময়ে এশীয়ানদের কোনো আড্ডা গাড়তে দেওয়া হয় নি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ইহা স্পষ্টত দেখা যায় যে, এশিয়াকে যুরোপ কেবলমাত্র পৃথক বলিয়া জ্ঞান করে না, তাহাকে হেয় বলিয়াই জানে। …য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতা নিজেকে জাহির করা এবং বজায় রাখাই চরম কর্তব্য বলিয়া জানে। অন্যকে রক্ষা করা যদি তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খাইয়া যায় তবেই অন্যের পক্ষে বাঁচোয়া, যে অংশে লেশমাত্র খাপ না খাইবে সে অংশে দয়া-মায়া বাছ বিচার নাই।
আরেকটি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, বাঙালি এক সময় জাহাজ তৈরি করতে দক্ষ ছিল। ইংরেজরা এই দেশে আসার পরে সে বিদ্যা বিলুপ্ত করেছে। তারা একটি জাতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। একটি বিদেশী নয়—একটি বিদেশী জাতি বহুদূর থেকে বাঙালিকে শাসন করছে—শোষণ করছে। সুতরাং এই বিদেশী ইংরেজ শাসনকে শুধু অবিশ্বাস করলেই চলবে না—এদের প্রতি ন্যূনতম বিশ্বাসের সূত্রটাকেও ছিন্ন করতে হবে।
এখন বৃটিশ রাজশক্তি এই পঙ্গুত্বকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করছে ঐক্যকে বিনষ্ট করার মধ্যে দিয়ে। ঐক্য এক মহাশক্তি। তারা জানে ঐক্য বিনষ্ট করা গেলে মহাশক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা সম্ভব। এভাবেই তাদের উপনিবেশিক শাসনক্ষমতা নিষ্কণ্টক থাকবে। ঐক্যের অনুভূতির মধ্যে কেবল একটা শক্তিমাত্র নহে, পরন্তুও এমন একটা আনন্দ আছে যে, সেই অনুভূতির আবেগে মানুষ সমস্ত দুঃখ ও ক্ষতি তুচ্ছ করিয়া অসাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়। এ কারণে ইংরেজ রাজ বাঙালির ঐক্যের বিনষ্টির জন্য যে কোনো অপকৌশল গ্রহণ করছে।
এ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ 'আমাদের স্বদেশহিতকর সমস্ত চেষ্টাকে নিজের দিকে ফিরাইয়া আনা'টাই কর্তব্য হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আমাদের অবিশ্বাসের মধ্যে এইটুকুই আমাদের লাভের বিষয়। তিনি বলেন, ইংরেজদের উপর ক্ষোভের কারণে নয়—আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আমাদের ঐক্য দরকার। ক্ষোভের কারণে সৃষ্ট ঐক্য সীমিত সময়ের জন্য টেকে—কিন্তু নিজেদের হৃদয়ের প্রয়োজনে সৃষ্ট ঐক্যের ক্ষমতা অসীম। সেই ঐক্য সৃজনশীল। তখন সেখানে বাইরের কোনো শক্তি প্রবেশ করতে পারে না।
বিলেতি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনকেও লাভের দিক থেকে দেখেছেন। বিলেতি দ্রব্যের বদলে দেশী দ্রব্য ব্যবহার শুরু করা গেলে দেশের প্রতি সত্যিকারের প্রেম অনুভব করা সম্ভব হবে। এবং এভাবে এদেশীয় শিল্পকাঠামো গড়ে উঠবে। দেশী দ্রব্য ব্যবহার করায় অভ্যস্থ হয়ে এভাবে ইংরেজ বেনিয়ারা তাদের ব্যবসা হারাবে। তারা শক্তিহীন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি আমাদের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ভিতও শক্তিশালী হবে।
তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে বঙ্গচ্ছেদের আক্ষেপে আমরা যথাসম্ভব বিলেতি জিনিস কেনা বন্ধ করিয়া দেশী জিনিস কিনিবার যে সংকল্প করিয়াছি সেই সংকল্পটিকে স্তব্ধভাবে, গভীরভাবে, স্থায়ী মঙ্গলের উপর স্থাপন করিতে হইবে। আমি আমাদের এই বর্তমান উদযোগটির সম্বন্ধে যদি আনন্দ অনুভব করি তবে তাহার কারণ এ নয় যে তাহাতে ইংরেজের ক্ষতি হইবে।
এদিন তিনি স্বদেশী সমাজের রূপরেখাটি আরও বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্মসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব—তাঁহাদের নিকটে নিজেকে সম্পূর্ণ অধীন, সম্পূর্ণ নত করিয়া রাখিব; তাহাদিগকে কর দান করিব, তাহাদের আদেশ পালন করিব, নির্বিচারে তাহাদের শাসন মানিয়া চলিব; তাহাদিগকে সম্মান করিয়া আমাদের দেশকে সম্মানিত করিব।
'আমাদের নিজেদের দিকে যদি সম্পূর্ণ দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিবে, এ কথা আমরা কোনোমতেই স্বীকার করিব না।…আমাদের কিছুতেই পৃথক করিতে পারে এ ভয় যদি আমাদের যদি জন্মে তবে সে ভয়ের কারণ নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে আছে এবং তাহার প্রতিকার আমাদের নিজেদের চেষ্টা ছাড়া আর কোনো কৃত্রিম উপায়ের দ্বারা হইতে পারে না'।
এই ভয়ের কারণটি তিনি নানাভাবে প্রত্যক্ষ এবং রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন। সেটা সেই নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্গের মানুষের ভেদ, নিম্নবর্ণের মানুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষের ভেদ, এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের ভেদ এবং অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে শিক্ষিত মানুষের ভেদের মধ্যে অবস্থান করছে।
এই দিনগুলোতে এই উত্তাল সময়ে বাউল সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন আমার সোনার বাংলা গানটি। গানটি কোলকাতায় মানুষের মুখে মুখে গীত হচ্ছে। আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
১ সেপ্টেম্বর সিমলা থেকে ঘোষণা করা হয়—১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের গতি আরও বেড়ে যায়। ৩ রা সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কলেজ স্কোয়ারে। প্রায় চার হাজার ছাত্র খালি পায়ে পতাকা হাতে সমাবেশে যোগদান করে। তারা উদাত্ত কণ্ঠে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঘোষণা করা হয়– যদি ১৬ অক্টোবর সতি সত্যি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় তবে সেদিনটিতে সারা দেশে পাদুকা বর্জন ও চাদর বর্জন করার মধ্যে দিয়ে ৩দিনের শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে।
এই দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ গিরিডিতে অবস্থান করছিলেন। গিরিডিও তৎকালীন বঙ্গের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ লাগে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ দেশীয় কোম্পানীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের শেয়ার কেনেন। বাঙালী মালিকাধীন একটি ব্যাংকে টাকা রাখেন। গিরিডিতে বসে তিনি এক মাসে বাউল সুরে ২১টি স্বদেশী সঙ্গীত লেখেন। তাঁর গান লেখার খবর পেয়ে কোলকাতায় স্বদেশী গান শেখানের জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গানগুলি খেয়া কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
স্বদেশী গানগুলির তালিকা—
১) ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, ২) মা কি তুই পরে দ্বারে পাঠাবি কি তোর ঘরের ছেলে, ৩) এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে, ৪) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা, ৫) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে, ৬) যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু, ৭) তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে, ৮) সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, ৯) আমি ভয় করব না ভয় করব না, ১০) ওরে তোরা নেই বা কথা বললি, দাঁড়িয়ে হাটের মধ্যিখানে নেই জাগালি পল্লী, ১১) ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি, ১২) বুক বেধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই, ১৩) নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে, ১৪) আমরা পথে পথে যাব সারে সারে, তোমার নাম গেয়ে ফিরিব দ্বারে দ্বারে, ১৫) আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, ১৭) আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার, ১৮) বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, ১৯) ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন কাটবে, ২০) আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে, ২১) ওরে ভাই মিথ্যা ভেবো না। হবার যা নয় কোনোমতেই হবেই না সে, হতে দেব না।।
রাখি বন্ধন কর্মসূচি
গিরিডি থেকে কোলকাতায় এসে ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরী স্বধর্ম সমিতির বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি প্রস্তাব রাখেন –১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হলে সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসব। দিনটিকে মিলন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজনীতিকরা ওই তারিখে রাজধানী কলকাতায় হরতাল আহ্বান করে।
রাখিবন্ধন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রাখি-সঙ্গীত 'বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল—পূণ্য হউক, পূণ্য হউক' রচনা করেন। ৭ আগস্ট বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর সুরম্য প্রাসাদপ্রাঙ্গণে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন। বিজয়া সম্মিলনী মূলত হিন্দুদের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সব প্রতীকই হিন্দুদের প্রতীক থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব প্রতীকের সাম্প্রদায়িক চরিত্র আছে। বঙ্গদেশ কেবল হিন্দুদের নয়—হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষেরই দেশ। এতকাল সকল মানুষ এক সঙ্গেই আছে। বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ চাই। এমন আন্দোলন চাই যেখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই অন্তর থেকে অংশ নিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাই স্পষ্টত ভেবেছেন– বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এই হিন্দু প্রতীকগুলো মুসলমানদের কাছে টানার বদলে আরও দূরে সরাবে। সুতরাং তিনি এই বিজয় সম্মিলনীতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্ভাষণ করার আহ্বান করেন। তিনি লিখেছেন–হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল পর্যন্ত, নদীজালজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণ ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।
আরেকটি প্রবন্ধ 'বঙ্গবিচ্ছেদে' লিখেছেন, এই ব্যবচ্ছেদের ফলে দেশবাসীর অন্নবস্ত্র, বাসস্থানের বিশেষ ক্ষতি না হইলেও ইহাতে আমাদের একমাত্র যথার্থ অনিষ্ট এই যে, সমস্ত বাংলা দেশ এক শাসনাধীনে থাকিলে বাঙালির অন্তঃকরণে যে একটা ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত থাকে, নানাকারণে বাঙালির একত্রে মিলিবার যে বহুতর উপলক্ষ ঘটে, তাহা নষ্ট হইলে আমরা ভিতরে ভিতরে যে বল-লাভের পথে চলিতেছিলাম, তাহাতে বাধা পড়িবে। তবে এই বঙ্গবিচ্ছেদ নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে–তাতে রবীন্দ্রনাথ মনে করছেন পার্টিশন আমাদের ক্ষতি করবে না। সকলের মধ্যে একটা প্রাণশক্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে দুই বঙ্গ ভাগ হলেও বাঙালির কিছু ক্ষতি হবে না। কারণ এই প্রাণশক্তি পার্টিশনের উপর জয়ী হবে—এই আশা থাকবে। মিলনে-বিরহে, আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, সুবিধা-অসুবিধ বাঙালি ঐক্য অনুভব করবে।
বৃটিশ পার্লামেন্টে ১৯০৫ সালের ৪ জুলাই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গ্রহণ করায় আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি ত্যাগ করে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয় ৭ আগস্ট টাউন হলের একটি সভায়। প্রত্যেক জেলার বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধি, ছাত্র-জনতা এ সভায় উপস্থিত ছিল। সেখানে নরেন্দ্রনাথ সেন বিলেতি-বর্জন বা বয়কট প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বয়কট ঘোষণার পর বৃহত্তর বঙ্গের সর্বত্র শত শত সভায় বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও বিলেতি বর্জনের শপথ গৃহীত হয়। বহু তরুণ ছাত্র দোকানে দোকানে পিকেটিং করে। দূর গ্রামে মাথায় করে দেশীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় করতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবে ভারতের ইংরেজ বনিকরাও কিছু অসুবিধা আশঙ্কা করে প্রথমে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিল। বয়কট ঘোষণা হওয়ার হওয়ার পরে তারা প্রস্তাবটির পক্ষে চলে যায়। দেশি কাপড়ের তুলনায় বিলেতি কাপড়ের দাম কম ছিল। বিলেতি কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরীব মানুষের অসুবিধা হয়ে যায়। কোথাও কোথাও বিলেতি দ্রব্য বিক্রিতে জোর জবরদস্তি করা হয়। এরই কারণে ফরিদপুর ২৬ আগস্ট ফরিদপুরে ছোটো খাটো দাঙ্গার ঘটনাও ঘটে।
রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে উপন্যাসে এইরকম একটা ঘটনা লিখেছেন। সেখানে শিক্ষিত প্রজাহিতৈষী জমিদার নিখিলেশের কাছে এক গ্রামীণ খুদে কাপড় ব্যবসায়ীকে নিয়ে এসেছেন মাস্টার মশায়। তার নাম পঞ্চু। ঘরে বাইরে থেকে পড়া যাক–
মাস্টারমশায় পঞ্চুকে আমার কাছে নিয়ে এসে উপস্থিত। ব্যাপার কী?
ওদের জমিদার হরিশ কুণ্ডু পঞ্চুকে এক-শো টাকা জরিমানা করেছে।
কেন, ওর অপরাধ কী?
ও বিলিতি কাপড় বেচেছে। ও জমিদারকে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বললে, পরের কাছে ধার-করা টাকায় কাপড় কখানা কিনেছে, এইগুলো বিক্রি হয়ে গেলেই ও এমন কাজ আর কখনো করবে না। জমিদার বললে, সে হচ্ছে না, আমার সামনে কাপড়গুলো পুড়িয়ে ফেল্, তবে ছাড়া পাবি। ও থাকতে না পেরে হঠাৎ বলে ফেললে, আমার তো সে সামর্থ্য নেই, আমি গরিব ; আপনার যথেষ্ট আছে, আপনি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলুন। শুনে জমিদার লাল হয়ে উঠে বললে, হারামজাদা, কথা কইতে শিখেছ বটে— লাগাও জুতি। এই বলে এক চোট অপমান তো হয়েই গেল, তার পরে এক-শ টাকা জরিমানা।
সেনাপতি লর্ড কিচেনের সঙ্গে কার্জনের মতভেদ হওয়ায় কার্জন পদত্যাগ করেন। তার স্থলে লর্ড মিন্টোর নিয়োগ হয়। মিন্টো তখন ছিলেন কানাডায়। তার আসতে দেরী হওয়ার সুযোগ নিয়ে কার্জন সিমলা থেকে ঘোষণা জারি করে বসেন, ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে। নবগঠিত প্রদেশ আসাম ও পূর্ব বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর নিযুক্ত হলেন কার্জনের চেয়েও পাষণ্ড শাসক ব্যামফিল্ড ফুলার। অ্যান্ড্রু ফ্রেজার পুনর্গঠিত বাংলা প্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্নর থাকেন।
বঙ্গভঙ্গের এই খবরগুলো সে সময়কার পত্রপত্রিকাগুলো কালো বর্ডার দিয়ে প্রকাশ করছিল। শোকচিহ্ণের প্রতীক হিসাবে এই কালো বর্ডার দিয়ে খবর প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সম্পাদকগণ। বাঙালিদের মধ্যে আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুতেও কালো পেড়ে কাগজ বা কালো খাম ব্যবহারের চল হচ্ছিল। এটা বিদেশী প্রথা। শোকের দেশী চিহ্ণ হল সাদা—শ্বেত শুভ্র। প্রাচীনকাল থেকে এই সাদা রং বাঙালির শোককে শুভ্রতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করছে। রবীন্দ্রনাথ শোকচিহ্ণ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে পত্রিকার সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন সাদা শুভ্রতায় ফিরে আসতে। তিনি লিখেছিলেন, এই (কালো) চিহ্ণ ব্যবহার করে কলঙ্ক বাড়িও না। আমাদের শোক আজি শুভ্র হউক, সংযত হউক, নিরাভরণ হউক—কঠোর ব্রত দ্বারা তাহা আপনাকে সফল করুক, অনাবশ্যক অনুকরণের দ্বারা তাহা দেশে বিদেশে আপনার কৃষ্ণাশ্রুরেখাকে হাস্য করিয়া না তুলুক।
শোকচিহ্ণের মতো করতালি দেওয়ার প্রথাকেও বিদেশী বলে বাতিলের প্রস্তাব করেন কবি। তিনি করতালি প্রবন্ধে লিখেছেন, এরূপ উৎকট উপায়ে মান্য ব্যক্তিকে সম্মান করা হয় না, কারণ, সম্মান করিবার উপায় কখনোই অসংযত হইতে পারে না। আমাদের দেশে করতালি চিরকাল অপমানের উদ্দেশ্যই ব্যবহার করা হইয়াছে-বস্তুত তাহাই সঙ্গত—কারণ, অসংযমের দ্বারাই অপমান করা যায়। তাই চিৎকার-রব দুয়ো বা সশব্দে করতালি দেওযা অপমানের উপায়। অপরপক্ষে যিনি আমাদের সম্মানের যোগ্য, তাঁহার কাছে আমরা আত্মসম্বরণ করিয়া থাকি। কবি মান্য ব্যক্তিকে সাধু সাধু বলার প্রস্তাব করেন।
উৎসাহ উদ্দীপনার আতিসাহ্যে জনপ্রিয় লোককে ঘাড়ে তুলে নেওয়া হয়। আবার কখনো টেনে নেয় ভক্তবৃন্দ—এই প্রথাকেও অপমানজনক বিদেশী অনুকরণ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
সে সময়ে কোলকাতার অনেকগুলো থিয়েটার ছিল। তাদের নাম ছিল ইংরেজিতে—স্টার, ক্লাসিক, গ্রান্ড, য়ুনিক। এগুলোর মালিক কিন্তু বাঙালি। থিয়েটারগুলোর ইংরেজি নামের বদলে বাংলা নাম রাখতে এই মালিকদের প্রতি কবি অনুরোধ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, বর্তমানে এমন একটি সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে যখন এই নাট্যাশালাগুলির পক্ষে বিলাতি নাম বিলেতি পোষাকের মত ছাড়িয়া ফেলাটা লোকের চক্ষে আকস্মিক ও অপ্রাসাঙ্গিক বলিয়া ঠেকিবে না। বরঞ্চ তাহা আমাদের দেশের বর্তমান হৃদয় ভাবের সহিত মিশ খাইয়া আমাদের স্বদেশ প্রেমের আনন্দোচ্ছ্বাসে নূতন তরঙ্গ তুলিবে।
তাঁর ইচ্ছে জেগেছিল স্বদেশী ভাবধারা জনগনের মধ্যে প্রচারের জন্য স্বদেশী ভিক্ষুসম্প্রদায় গড়ে উঠুক। তিনি লিখেছেন—যে সকল ভিক্ষুক নাম গান করিয়া দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা সংগ্রহ করে—তাহারা যাহা পায় তাহার চেয়ে অনেক বেশি দেয়—তাহারা দেশের চিত্ত আকাশ হইতে প্রত্যহ কলুষ মোচন করিয়া, তাহাকে মধুময় করিয়া তুলিতেছে। কর্ম্মের ঘোরতর আন্দোলনের মধ্যেও তাহারা জীবনের চরম লক্ষ্যকে স্মরণ করাইয়া সংসারের কত আবর্জনা দূর করিতেছে তাহার হিসাব লওয়া শক্ত। এই রূপে যে সম্প্রদায় স্বার্থনিরত লোকদিগকে প্রত্যহ স্বদেশী কর্তব্য স্মরণ করাইয়া বেড়াইবেন—স্বদেশের স্বরূপকে অন্যমনস্কের মনে জাগ্রত করিয়া রাখিবেন, স্বদেশের প্রতি প্রেমকে প্রত্যহ সুরে তানে দেশের পথে ঘাটে উদ্বোধিত করিয়া তুলিবেন তাহারা এই মহৎ কর্তব্য সাধনের দ্বারা যদি জীবিকা সম্বন্ধে নিশ্চিত হইতে পরেন তবে তাহাতে লজ্জার বিষয় নাই।
স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শে কোলকাতায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে এই রকম বৈতালিক গোষ্ঠী গঠিত হয়েছিল। তারা রাস্তায় রাস্তায় গান গাইতেন। তখন পানওয়ালা বিড়িওয়ালা পর্যন্ত টাকা পয়সা দিত। সংগৃহীত এই চাঁদা জাতীয় অর্থভাণ্ডারে জমা দেওয়া হত।
উদ্বোধন নামে প্রবন্ধে কবি নারীদের উদ্দেশ্যে লেখেন, তোমরা—যাহারা আজ বিশ্ববঙ্গের বেদনায় ব্যথা পাইয়াছ, চক্ষু বিশ্ববঙ্গের মিলনাবেগে গৌরব অনুভব করিতেছ, তোমরা আজ সকলে প্রস্তুত হইয়া এস,–তোমাদের দুটি চক্ষু হইতে বিদেশী হাটের মোহাঞ্জন আজ চোখের জলে একেবারে ধুইয়া মুছিয়া এস—যে বিদেশের অলঙ্কার তোমাদের অঙ্গকে সোনার শৃঙ্খলে আপাদমস্তক বন্দি করিয়া রাখিয়াছে, তাহা আজ খণ্ড খণ্ড করিয়া ভাঙিয়া এস, আজ তোমাদের যে সজ্জা তাহার প্রীতির সজ্জা হউক, মঙ্গলের সজ্জা হউক, তাহাতে বিদেশের রেশম-পশম-লেস-ফিতার জাল-জালিয়াতি অপেক্ষা তোমাদিগকে অনেক বেশি মানাইবে।
রবীন্দ্রনাথ ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরীর সভায় রাখীবন্ধনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। জনসাধারণ উৎসাহের সঙ্গে রাখীবন্ধন কর্মসূচিটি গ্রহণ করে। বেঙ্গলী পত্রিকায় রাখী সংক্রান্ত ব্যবস্থা নামে একটি ঘোষণা ছাপা হয়েছিল—
দিন। এই বৎসর ৩০ শে আশ্বিন ১৬ অক্টোবর
আগামী বৎসর হইতে আশ্বিনের সংক্রান্তি।
ক্ষণ। সূর্য্যোদয় হইতে রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত।
নিয়ম। উক্ত সময়ে সংযম পালন।
উপকরণ। হরিদ্রাবর্ণের তিন সুতার রাখী।
মন্ত্র। ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই।
অনুষ্ঠান। উচ্চ নিচ হিন্দু মুসলমান, খৃস্টান বিচার না করিয়া ইচ্ছামত বাঙ্গালী মাত্রেই হাতে রাখী বাঁধা, অনুপস্থিত ব্যক্তিকে সঙ্গে মন্ত্রটি লিখিয়া ডাকে অথবা লোকের হাতে রাখী পাঠাইলেও চলিবে।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। সেদিন কোলকাতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ৩০ শে আশ্বিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথকে পুরোভাগে রাখিয়া বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আপামর জনসাধারণ এক বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া গঙ্গাতীরে সমবেত হইল। গঙ্গাস্নান করিয়া পরস্পরের হস্তে রাখী বন্ধন করিল। রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সামনে যাকে পেতাম, তারই হাতে বাঁধতাম রাখি। সরকারী পুলিস এবং কনস্টেবলদেরও বাদ দিতাম না। মনে পড়ে, একজন কনস্টেবল হাত জোড় করে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান।
দুপুর সাড়ে তিনটার সময় ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে ফেডারেশন হল ভিত্তি প্রস্তর অনুষ্ঠানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সে অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রটির বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছিলেন। সভার শেষে সেই বিশাল জনতা পায়ে হেটে সার্কলার রোড ধরে বাগবাজারে চলে যায়। ঐ মিছিলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। মিছিলে সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশী সঙ্গীত গীত হচ্ছিল।
এর আগে ১২ অক্টোবরে ময়মনসিংহের মহারাজার বাড়িতে একটি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল—১৬ আক্টোবর জাতীয় অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলা হবে। সে টাকা দিয়ে একটি তুলার কারখানা গড়ে তোলা হবে। জনসাধারণকে অনুরোধ করা হবে তারা যেন অন্তত এক দিনের আয় এই ভাণ্ডারে দান করেন। ১৬ অক্টোবর পশুপতিনাথ বসুর বাড়ির আঙিনায় অনুষ্ঠিত সভায় অর্থসংগ্রহ সভায় উপস্থিত মতে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন ১০০ টাকা।
বঙ্গবঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়। এই প্রথম পর্যায়ের প্রদান ৩টি কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল।
১) বিলেতি ভোগ্যপণ্য বয়কট।
২) স্বদেশী শিল্পের সংগঠন ও প্রচার এবং এই উপলক্ষ্যে জাতীয় অর্থভাণ্ডার স্থাপন।
৩) মিছিল, বক্তৃতা ও লেখালেখি।
প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন, এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ৫টি সভায় যোগ দিয়েছেন, ২টি সভায় লিখিত ভাষণ পাঠ করেছেন। ১টিতে সভাপতিত্ব ও মৌখিক ভাষণ দিয়েছেন। একটিতে ঘোষণাপত্রের বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছেন। একটি সভায় শুধু উপস্থিত ছিলেন। এই হিসেব থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ ছিল অন্যদের চেয়ে কম। তবে ভাণ্ডার ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ মোটেই কম নয়। এইসব লেখালেখির মাধ্যমে তিনি কয়েকটি বিষয়ের উপর সুস্পষ্টভাবে জোর দিয়েছেন—
১) বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা।
২) ভিতর থেকে ঐক্য গড়ে তোলা গেলে সে ঐক্য বাইরে কোনো শক্তি ভাঙতে পারে না।
৩) ইংরেজদের উপর রাগ করে নয়—দেশকে ভালোবেসে দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা দরকার।
৪) দেশীয় শিল্পোদ্যোগকে গড়ে তোলার জন্য কিছু বিলেতি ভোগ্যবস্তু থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে হবে। এই ত্যাগের মধ্যেকার ইতাবাচক বা ভাবগত দিকটিকেই জোর দিয়েছেন।
৫) সহজ পরিচিত সুরের মাধ্যমে রচিত গানগুলো মাধ্যমে দেশজননীর একটি সৌন্দর্য্যময়ী কল্পমূর্তি রচনা করেছেন। এ-গানগুলোর মাধ্যমে তিনি বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগিয়েছেন। এবং একটি জনসম্প্রদায়কে একটি জাতি হিসাবে পরিণত করার চেষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথ করেছেন।
৬) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের জন্য মিলনের স্রোতধারায় নিতে চেষ্টা করেছেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রকৃতি
বঙ্গভঙ্গ থেকে কয়েকটি ধারায় আন্দোলন শুরু হয় বঙ্গে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার পর বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে 'স্বরাজ' শব্দ গৃহীত হয়। স্বরাজ বলতে কংগ্রেসের নরমপন্থীরা বুঝলো ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, চরমপন্থীরা বুঝলো স্বাধীনতা। এর থেকে উৎপত্তি হলো বিদেশী পণ্য বর্জন প্রসঙ্গ। চরমপন্থীরা চাইলো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ বয়কট। এই পুরো আন্দোলনটিকেই স্বদেশী আন্দোলন হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়।
ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, স্বদেশী আন্দোলন তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল সে সময়। প্রথমধারাকে বলা যায় গঠনমূলক স্বদেশী। 'স্বদেশী সমাজ' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের গঠনমূলক কাজের কথা বিশদ করেছিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আত্মশক্তির উদ্বোধন। দ্বিতীয়ধারা বয়কটকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তৃতীয়ধারায় ছিল চরমপন্থীরা। তাদের কাছে স্বদেশী আন্দোলন এবং বয়কট গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে স্বরাজ। এ নিয়ে কংগ্রেসে তুমুল বিতর্কও হয়। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য জেলায় জেলায় সমিতি গড়ে ওঠে। গৃহীত নীতি কার্যকর করার জন্য তৈরি করা হয় জাতীয় স্বেচ্ছাসেবীদল। বরিশালে 'স্বদেশ বান্ধব', ময়মনসিংহে 'সুহৃদ' ও 'সাধনা', ফরিদপুরে 'ব্রতী' আর সবচেয়ে বিখ্যাত ঢাকার 'অনুশীলন' সমিতি। জেলা সমিতির অধীনে অনেক শাখাও স্থাপিত হয়।কলকাতায় গড়ে ওঠে 'যুগান্তর' নামে আরেক সংগঠন।এই দলের নেতা অরবিন্দ ঘোষ। সহোদর বারীন ঘোষ তার সহযোগী। এরা অস্ত্র হিসেবে বোমা ব্যবহার চালু করেন।
বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ছাত্রদের এই আন্দোলনটা কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করে বৃটিশরাজ। ২২ অক্টোবর দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সরকার একটি সার্কুলার জারি করে সকলপ্রকার স্কুল-কলেজের ছাত্রদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা হয় এবং নানাবিধ শাস্তির বিধান করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভয় দেখানো হয় যদি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা যায় তাহলে তার সরকারী সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। সরকারের এই ঘোষণায় কোলকাতায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় জাতীয় বিশ্বিবিদ্যালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবটি রবীন্দ্রনাথ আগে থেকেই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—শিক্ষাকে সরকারী আওতামুক্ত রাখতে হবে। তাহলে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর ইচ্ছে মত ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। দেশের মানুষ সমাজের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারবে—তাদের জন্য কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার। কবিকল্পনা বলে রাজনীতিকরা রবীন্দ্রনাথের এই প্রস্তাবে কখনই কর্ণপাত করেননি।
১৯০৫ সালের ২৭ অক্টোবর পটলডাঙায় সহস্র ছাত্রের উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রস্তাব সকলের সামনে বিষদভাবে আবার তুলে ধরেন। সে সভায় সিটি কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শচীন্দ্রনাথ বসু সরকারী সার্কুলারটি প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, আমরা কোলকাতার ছাত্রবৃন্দ সম্মিলিত হইয়া প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, যদি গভর্নমেন্টের বিশ্ববিদ্যালয় আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতেও হয় তাহাও স্বীকার করি, তথাপি স্বদেশ সেবারূপ যে মহাব্রত আমরা গ্রহণ করিয়াছি তাহা কখনো পরিত্যাগ করিব না।
সে সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমাদের সমাজ যদি নিজেদের বিদ্যাদানের ভার নিজে গ্রহণ না করে, তবে এক দিন ঠকিতে হইবে। আজকার এই অবমাননা যে নূতন তাহা নহে, অনেকদিন হইতেই ইহার সূত্র আরম্ভ হইয়াছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষার উপর গভর্নমেন্টের অনুকূল দৃষ্টি নাই; সুতরাং গভর্নমেন্ট যদি এই পরোয়ানা প্রত্যাহারও করেন, তবুও আমরা তাহাদের হাতে শিক্ষার ভার সমর্পণ করিয়া শান্ত থাকিতে পরিব না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাদের অন্তকরণকে অস্থি মজ্জায় একেবারে দাসত্বে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। তাই আমাদের নিজেদের শিক্ষার ভার নিজেদের হাতে রাখিতে হইবে।
২৯ অক্টোবর বাংলার ভগিনীদের জাতীয় ধনভাণ্ডারে দান করার আহ্বান করে আবেদন প্রচার করা হয়। আবেদনপত্রটিতে স্বাক্ষর করেন—শ্রী শিশিরকুমার ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, জগদিন্দ্রনাথ রায়, নলিনীবিহারী সরকার, মতিলাল ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী, নবাব আবদুল সোভান চৌধুরী, কুমার সতীশচন্দ্র সিংহ ও গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ব্যধি ও প্রতিকার
২৬ অক্টোবর মল্লিকবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের সভাপতিত্বে স্বদেশী সভায় যোগদান করেন রবীন্দ্রনাথ। সভাটিতে প্রধানত মুসলমানদের উপস্থিতিই ছিল প্রধান। সেদিনের রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি ব্যধি ও প্রতিকার প্রবন্ধে ছাপা হয়েছিল। এখানে তিনি মূলত হিন্দু-মুসলমান বিরোধের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তজিত করিয়া দিয়াছে। কথাটা যদি সত্যিই হয় তবে ইংরেজদের উপর রাগ করিব কেন? দেশের মধ্যে যতগুলো সুযোগ আছে তাহা নিজের দিকে টানিবে না, এই ইংরেজকে এতোবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কি কারণ ঘটিয়াছে।
মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগান যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না। অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে সেখানে জোর করিবেই—আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে—এতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।
তিনি বলেন, মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নহে। আমরা বিরুদ্ধ।
এরপর তিনি এই ভেদব্যাধির কারণটি বর্ণনা করছেন–
আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে বসিয়া এক ক্ষেত্রের ফল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি, আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ, যাহা ধর্মবিহীত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না।
পূর্ববঙ্গে জমিদারী পরিচালনা করতে যখন এসেছিলেন তখন প্রথম দিনেই তিনি দেখেছিলেন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী অনুসারে আলাদা আলাদা বসার স্থান। সেই দিনই এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ করেছিলেন তার জমিদারী থেকে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে কবি বলেন–
আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমান বসে না—ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়। হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।
এক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার বিধান তো দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয়—তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে সেই ম্লেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদের সহ্য করিতেই হইবে।
তিনি এই সময়ের হিন্দু নেতৃবৃন্দের ভেদাশ্রিত আন্তকরণ দেখে ব্যাথিত হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি দেখেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে এই ভেদের বীজটি একদিন বিষবৃক্ষে পরিণত হবে। বিচ্ছেদটি চূড়ান্ত হবে হৃদয়ে, দেশবিচ্ছেদে, সংস্কৃতি বিচ্ছেদে, মনুষ্যত্ব বিচ্ছেদে। ভয়ঙ্করভাবে নিপীড়িতরা পীড়কদের উপর প্রতিশোধ নেবে। কবি বলেন, একদিন মানুষকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা যাহাদের অভ্যাস নহে, পরস্পরের অধিকার যাহারা সূক্ষাতিসূক্ষভাবে সীমাবদ্ধ রাখিবার কাজে ব্যাপৃত—যাহারা সামান্য স্খলনেই আপনার লোককেই ত্যাগ করিতেই জানে, পরকে গ্রহণ করিতে জানে না—সাধারণ মানুষের প্রতি সামান্য শিষ্টতার নমস্কারেও যাহাদের বাধা আছে—মানুষের সংসর্গ নানা আকারে বাঁচাইয়া চলিতে যাহাদিগকে সর্বদা সতর্ক থাকিতে হয়—মনুষ্যত্ব হিসাবে তাহাদিগকে দুর্বল হইতেই হইবে। যাহারা নিজেকেই নিজে খণ্ডিত করিয়া রাখিয়াছে, ঐক্যনীতি অপেক্ষা ভেদবুদ্ধি যাহাদের বেশি দৈন্য অপমান ও অধীনতার হাত হইতে তাহারা কোনোদিন নিষ্কৃতি পাইবে না।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আরও কিছু ত্রুটির কথাটাও তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বয়কট ও স্বরাজ মন্ত্র গ্রহণের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়েছে এই আন্দোলনের প্রধান শত্রু ইংরেজের চেয়ে নিজেরাই নিজেদের ভেদ সম্পর্কটাই বড় শত্রু। বাইরের ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমে দেখা গেল নিজেদের মধ্যেই একটা যুদ্ধ লেগে আছে। এই আত্মকলহ বজায় রেখে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব।
তিনি বলেন, আজ আমাদের ইংরেজী পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে 'আমরা উভয়ে ভাই'—তখন এই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুতেই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা 'চাষা বেটা'বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্ণমেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে-দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি আস্পর্দ্দা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা। সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোনো বিখ্যাত স্বদেশী প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে, পূর্ববঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। এই বাবুদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া, কিছু সুবিধার জন্য ঐক্যের কথা বলা এবং ঐক্যের আগ্রহে হৃদয়ের যোগ না থাকায় এই বয়কট বা স্বরাজের আন্দোলনটা সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে উঠেছে বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন।
এই রকম একটি পরিস্থিতিতে বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হয়ে উঠবে এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দেশের লোককেই দেশের সকল মানুষের অন্ন-বস্ত্র-সুখস্বাস্থ্য-শিক্ষাদীক্ষা দানে সর্বপ্রধান সহায় হতে হবে। দুঃখে বিপদে দেশের মানুষই সকল মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িতে হবে—কেবল সুবিধায় নয়। অসুবিধায়ও। অসুবিধায়ও ভাই বলে তাঁর কাছে যেতে হবে। তবেই স্বরাজ সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে কবি বলেন।
কবির এই চিন্তাটা ছিল প্রচলিত রাজনীতিকদের চেয়ে ভিন্ন। শুধু ভিন্ন বলাটা সঙ্গত হয় না—বলা উচিৎ একেবারে তাঁদের বিপরীত চিন্তার প্রকাশ। নেতারা যখন বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনকে তাঁদের সাময়িক সুবিধার কর্মনীতি হিসেবে গ্রহণ করছে—সেখানে একটা সুদূর প্রসারী চিন্তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাকে উপস্থান করেছেন, উল্টো পথে হাঁটছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : ছাত্রসমাজ প্রস্তুত–দোদুল্যমান রাজনীতিক
২৭ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে ফিল্ড এন্ড একাডেমী ভবনে সদস্য ও ছাত্রদের সান্ধ্যসম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবঙ্গ ব্যাপারটি সর্বজনীন বলেই ছাত্ররা যোগদান করবে—এটা খুব স্বাভাবিক। নেতাদের ত্যাগ স্বীকার যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের পাঁজনের শক্তিকে সংহত করা গেলে নেতারাও যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হবেন। জাতীয় ধনভাণ্ডারের ইংরেজি নাম NATIONAL FUND না রেখে বঙ্গভাণ্ডার রাখার প্রস্তাব করেন এই সভায়। তাঁর মতে স্বদেশী কলকারখানা গড়ে তোলা গেলে স্বদেশী দ্রব্যের যোগান বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া আমাদের শিক্ষাকে স্বাধীন করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়লয প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। গভর্নমেন্টের সম্মন ও চাকরীর মায়া ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে ছাত্রদের পরামর্শ দেন। যদি ছাত্ররা প্রস্তুত থাকে এই ত্যাগ স্বীকারে তাহলে নেতারা বাধ্য হবে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে।
৫ নভেম্বর বিকেলে ডন সোসাইটিতে দুহাজার ছাত্রের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, বাংলাদেশে আজ নবজীবনের সূত্রপাত হয়েছে। বিদেশী বর্জন ও স্বাধীন স্বদেশী শিক্ষার দ্বিমুখী সংকল্পকে আশ্রয় করে চলেছে বাংলা। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতেই জীবিকোপার্জনের ব্যবস্থা, অভিভাবকদের মতগঠন, ইঞ্জিয়ারিং ডাক্তারি ভূবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় চালু করা না গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইংরেজের বিশ্বিদ্যালয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশেও যেতে হবে।
এ সময়কার সভায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকের চেয়ে জাতীয় শিক্ষার আন্দোলনে বেশী সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন। তবে পাশাপাশি তিনি স্বদেশী গান লিখছেন, স্বদেশী দ্রব্য প্রস্তুত ও প্রচারেও তিনি বিস্তৃতভাবে অংশ নিচ্ছেন এই সময়ে।
১ লা নভেম্বর সারাদেশে PROCLAMATION DAY পালিত হয়। রংপুরে বন্দে মাতরম গানটি গাওয়ার অভিযোগে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট টি এমোরসন প্রায় ২০০ জন ছাত্রকে ৫ টাকা হারে জরিমান করেন। খবরটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৪ নভেম্বর। গোলদিঘির পাড়ে সেদিনই এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা সংকোচন পরওয়ানা বিরোধী সমিতি বা ANTI CIRCULAR SOCIETY তৎক্ষণাৎ গঠিত হয়। গভর্নমেন্টের বিশ্ববিদ্যালয় পরিত্যাগ করে ছাত্রদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হওয়ার আবেদন জানানো হয় এই জমায়েতে। ৫ নভেম্বর বগুড়ার নবাব আবদুল সোভান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিন্দা করে বক্তব্য রাখে। কিন্তু উপস্থিত ছাত্র-জনতা এই নিন্দা পছন্দ করে নি। তারা পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়কে বক্তব্য অসমাপ্ত রেখেই বসিয়ে দেয়।
৭ নভেম্বর এন্টি সার্কুলার সোসাইটির পক্ষ থেকে শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু ও জাপান-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার রমাকান্ত রায় রংপুরে যান। সেখানে ছাত্রসভায় প্রস্তাবিত জাতীয় বিশ্বদ্যালয়ের অধীনে রংপুর জাতীয় বিদ্যালয় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ৮ নভেম্বর ঔপন্যাসিক ব্যারিস্টার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়। রংপুরের ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবটিকে বিবেচনা করতে বাধ্য করে।
৯ নভেম্বর মাদারীপুরে পূর্ববঙ্গে ছোটো লাট র্যামফিল্ড ফুলারের আদেশে কয়েকজন ছাত্রকে বেত মারার শাস্তি দেওয়া দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা বন্দে মাতরম বলেছিল। এই খবর কোলকাতায় পৌঁছালে গোলদিঘিতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সুবোধচন্দ্র মল্লিক এক লক্ষ টাকা দানে ঘোষণা করেন প্রস্তাবিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে। সভায় বক্তব্য রাখেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাস, মৌলবী আবুল হোসেন প্রমুখ। তারা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। ছাত্ররা সুবোধ মল্লিককে রাজা উপাধীতে ঘোষণা করে।
১০ নভেম্বর গোলদিঘিতে আরেকটি ছাত্রজনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ময়মনসিংহ-গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পাঁচ লক্ষ টাকা দান করার প্রতিশ্রুতি দেন। ১১ নভেম্বর ১০ হাজার ছাত্রের উপস্থিতিতে আশুতোষ চৌধুরী ছাত্রদের অনুরোধ করেন, তারা যেন বি.এ. ও এম.এ পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার সংকল্প ত্যাগ করে। তখনো জাতীয় বিশ্বিবদ্যালয় বিষয়ে নেতাদের দোদুল্যমানতা ছিল। ১৩ নভেম্বর পান্তির মাঠে বিরাট জনসভায় আশুতোষ চৌধুরী, সিস্টার নিবেদিতা, অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় বক্তব্য রাখেন। ছাত্রদের দাবীর মুখে আশুতোষ চৌধুরী জানান—নেতারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য চেষ্টা করছেন।
১৬ নভেম্বর বিকেল তিনটায় পার্ক স্ট্রিটে বেঙ্গল ল্যান্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভায় জাতীয়ভাবে এবং জাতীয় তত্ত্বাবধানে সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক এবং কারিগরী এই ত্রিবিধ শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য ১৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় শিক্ষা সমাজ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে রবীন্দ্রনাথ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আরেকটি প্রস্তাবে ছাত্রদের পরীক্ষা বর্জনের সংকল্প ত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এই সভায় NATIONAL COUNCIL OF EDUCATION এর জন্য একজন ভদ্রলোক পাঁচলক্ষ টাকা বা বার্ষিক কুড়ি হাজার টাকার আয়ের ভূ-সম্পত্তি, একজন নগদে দুই লক্ষ টাকা ও একটি সুন্দর বাড়ি, একজন নগদ এক লক্ষ টাকা ও অপর একজন বার্ষিক ত্রিশ হাজার টাকা আয়ের সম্পত্তি দেওযার কথা ঘোষণা করেন। এই সভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন। ডঃ রাসবিহারী ঘোষ, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, আশুতোষ চৌধুরী, প্রমথ চৌধরী, মহম্মদ এ গজনভি, ডাঃ নীলরতন সরকার, মৌলবী আবদুল মজিদ, মৌলবী শামসুল হুদা, রেভারেন্ড নাগ, সুবোধচন্দ্র মল্লিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আন্দোলনে মতবিরোধ
১৭ নভেম্বর স্বদেশী শিক্ষা সংক্রান্ত মন্ত্রণাসভার সিদ্ধান্তের জন্য পান্তির মাঠে সমবেত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিনন্দন জানানোর জন্য সভাস্থলে পত্রপুষ্পে শোভিত করা হয়েছিল। মঞ্চে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলর স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাক্তার রাসবিহারী ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। তৎকালীন সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কোলকাতা রিপন কলেজের মালিক। তাঁর কর্মকাণ্ডে ছাত্রজনতা তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছিল না। তিনি বলেন, আমি শুনিয়াছি কেহ কেহ বলিতেছেন যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইলে রিপন কলেজের ক্ষতি হইতে পারে এই আশঙ্কায় আমি ইহার প্রতিবন্ধকতা করিব—আমি বলিতে পারি যে যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইবে তখন রিপন কলেজই সর্ব্বপ্রথমে তাহার অন্তর্ভুক্ত হইবে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্রদের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখনই ত্যাগ না করার পরামর্শ দেন। তার এই দুকূল বজায় রাখার পরামর্শটি উপস্থিত ছাত্ররা পছন্দ করেনি। তারা তাকে কঠোরভাবে নিন্দা জানায়। দেশের ছাত্রসমাজ, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবীগণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকলেও রাজনীতিকরা তাদের সুবিধাবাদিতার কারণে এই দাবী নিয়ে ইংরেজদের বেশি ঘাটাতে চায় নাই। পরিহাসের বিষয় হল, ১৯০৬ সালে আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন হলে রিপন কলেজসহ বাংলার কোনো কলেজই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়নি। পরে এইভাবে জনগণের আকাঙ্খা জাতীয় সুবিধাবাদি রাজনীতিকদের হাতে মার খায়।
২৪ নভেম্বর পান্তির মাঠে আর একটি ছাত্রসভায় বিপিনচন্দ্র পাল, মৌলবী লিয়াকত হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সেখানে দ্বিতীয় প্রস্তাবটির কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়—আজ যদি রংপুরের ছাত্রগণকে ফেলিয়া কলিকাতার ছাত্ররা পরীক্ষায় উপস্থিত হন তবে গবর্নমেন্ট যে বঙ্গব্যবচ্ছেদ করিতে পারেন নাই, বাঙালি নিজেই সেই বঙ্গব্যবচ্ছেদ করিবেন।
হতাশার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আশা
এই পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে মতবিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ এইসব মতবিরোধ সত্বেও প্রস্তাবিত শিক্ষা কমিটিকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে যেতে থাকেন। তিনি আশা করে আছেন বঙ্গবঙ্গের এই জাগরণের মধ্যে আর কিছু না হোক অন্তত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠবে। এটা গড়ে উঠলে দেশের মানুষ তাদের আত্মশক্তি বুঝতে পারবে। প্রকৃত স্বদেশ গড়ে তুলবে। ১৯ নভেম্বর কমিটি খসড়া পরিকল্পনাটিকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়কে ২৬ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন, হীরেন্দ্রবাবু, মোহিনীবাবু…নীররতন সরকার (প্রভৃতি) মিলিয়া সংকল্পিত (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের) নিয়ম ও গঠনে (প্রণালী প্রণয়নে) নিযুক্ত ছিলাম—(যখন) ছাত্রগণ এক সংকল্প গ্রহণ করিয়াছেন তখন নিষ্ফল আশঙ্কা বোধ হয় মন হইতে দূর করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। আমি তো অনেকদিন হইতে ঔদাসীন্য ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আশাপথ চাহিয়া কাজ করিয়া যাইতেছি—বর্ত্তমান উদ্যোগও যদি ব্যর্থ হয় তবু আমি আশা ছাড়িবনা। দেশের কল্যাণের জন্য যখন অন্য পথ নাই তখন বারবার প্রতিহত হইয়াও এই একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হইতেই হইবে।
শিক্ষার আন্দোলন নামে সে সময়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ পুস্তিকাটির ভূমিকা লিখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে স্বদেশী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে-সকল সভা সমিতি বসিয়াছে, তাহার মধ্যে নানা মতের, নানা বয়সের, নানা দলের লোক সমবেত হইয়াছেন। ইঁহারা সকলে মিলিয়া যাহা কিছু স্থির করিতেছেন, তাহা ইঁহাদের প্রত্যেকেরই সম্পূর্ণ মনঃপুত হইতে পারে না। এই-সকল সমিতির সঙ্গে বর্তমান লেখকেরও যোগ ছিল। প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ের যে শিক্ষাপ্রণালী ও নিয়ম নির্ধারিত হইয়াছে, লেখকের যদি সম্পুর্ণ স্বাধীনতা থাকিত তবে ঠিক সেরূপ হইত না সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহা লইয়া লেখক বিবাদ করিতে প্রস্তুত নহেন। তিনি কাজ আরম্ভ হওয়াকেই সকলের চেয়ে বেশি করেন। যদি তাঁহার মনোমতো প্রণালীই বাস্তবিক সর্বোৎকৃষ্ট হয়, তবে কাজ আরম্ভ হইলে পর সে-প্রণালীর প্রবর্তন যথাকালে সম্ভবপর হইবে, এ ধৈর্য তাঁহাকে রক্ষা করিতেই হইবে।
জাতীয় শিক্ষার আন্দোলন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুবিধাবাদিতাও রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করে ফেলে। ১৯০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি শান্তিনিকেতনে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁকে কোনো ধরনের সভাসমিতিতে যোগ দিতে দেখা যায় না। ১১ ডিসেম্বর মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন—কিছুদিনের জন্য সভাসমিতি হইতে পলায়ন করিয়া বোলপুরে আশ্রয় লইয়াছি। বেশিদিন এমন আরামে কাটিবে না। আবার কখন জনতার হঠাৎ ডাক পড়িবে, নির্জনতা হইতে বিদায় লইতে হইবে।
১১৯০৬ সালের ১১ মার্চ রবীন্দ্রনাথের মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শিক্ষা কমিটির সভায় শিক্ষাসমাজের গঠনপ্রণালীর চূড়ান্ত রিপোর্ট গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ এ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রাজনৈতিক অংশে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা যোগ দিলেও জাতীয় শিক্ষা-আন্দোলনে তাঁর যোগ ছিল সর্বাঙ্গীন। কিন্তু জাতীয় নেতাদের মতিগতি দেখে মাস-দেড়েকের মধ্যেই তাঁর মোহমুক্তি ঘটে। ১২ ডিসেম্বর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিঠিতে লেখেন, আমাকে লইয়া টানাটানি করিয়া কি লাভ? বস্তুত দেশ যদি প্রস্তুত হইয়া না থাকে তবে আমি মাথা খুঁড়িয়া মরিলে কেবল আমারই মাথার পক্ষে অসুবিধা—তাহাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বৃহৎ ব্যাপারের কোনোই সুবিধা হইবে না।…আমি ইহাঁদের কাছে যাতায়াত করিয়া বৃথাই সময় নষ্ট করিয়াছি।
ইহা নিশ্চয়ই জানিবেন উচ্চতর লক্ষ্য বিস্তৃত হইয়া যাঁহারা গবর্নমেন্টের বিরুদ্ধে স্পর্দ্ধা প্রকাশ করাকেই আত্মশক্তি-সাধনা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা বলিয়া মনে করেন—যাঁহারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনাকে এই স্পর্দ্ধা প্রকাশেরই একটা উপলক্ষ্য বলিয়া জ্ঞান করেন তাঁহাদের দ্বারা স্থিরভাবে দেশের স্থায়ী মঙ্গল সাধন হইতে পারিবে না। দেশে যদি এরূপ লোকেরই সংখ্যা এবং ইহাদের প্রভাবই অধিক থাকে তবে আমাদের মত লোকের কর্তব্য নিভৃতে যথাসাধ্য নিজের কাজে মনোযোগ করা। বৃথা চেষ্টায় নিষ্ফল আন্দোলনে শক্তি ও সময় ক্ষয় করা আমাদের পক্ষে অন্যায় হইবে।..আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে, অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ূ আছে আমার এই প্রদীপটি জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব। আমি কোনো জন্মেই লীডার বা জনসংঘের চালক নই—আমি ভাট মাত্র—যুদ্ধ উপস্থিত হইলে গান গাহিতে পারি এবং যদি আদেশ দিবার কেহ থাকেন তাঁহার আদেশ পালনেই প্রস্তুত আছি। যদি দেশ কোনোদিন দেশীয় বিদ্যালয় গড়িয়া তোলেন এবং তাহার কোনো সেবাকার্যে আমাকে আহ্বান করেন তবে আমি অগ্রসর হইব—কিন্তু কোনো নেতা হইবার দুরাশা আমার মনে নাই—যাহারা নেতা বলিয়া পরিচিত তাহাদিগকে আমি নমস্কার করি—ঈশ্বর তাঁহাদিগকে শুভবুদ্ধি প্রদান করুন।
এই আন্দোলনে শুধু রাজনীতিকরা নয়—আমলাতন্ত্রে কাজ করেছেন এমন লোকজনও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের দুর্বলতা নিয়েও কবি সরব হয়েছিলেন। বিপিনগুপ্তকে ১৯১১ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর চিঠিতে লিখেছিলেন, একটা SYSTEM এর যাঁরা মানুষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে খুব সফলতা লাভ করেন, তাঁরা সেই সে SYSTEM থেকে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। গুরুদাস বাবু হাইকোর্টের জজ হলেন, কিন্তু পুরাতন শিক্ষা-পদ্ধতি থেকে মুক্ত করতে পারেননি। আবার যেটা ন্যাশনাল হওয়া দরকার, সেটাকে হিন্দু করবার চেষ্টা দেখে সফলতার আশা বড় করতে পারিনি। দেশের শিক্ষাপদ্ধতির মর্মকথাটুকু বুঝতে না পারলে, নিজেকে ভাল করে চিনতে না পারলে একটা মিথ্যে মেকি নিয়ে আত্মবঞ্চনা করা ত স্বদেশের অপমান করা হয়।
১৯০৫ সালের ২৭-৩০ ডিসেম্বর বারানসিতে জাতীয় কংগ্রেসের একুশতম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলের সভাপতিত্বে এই অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের নিন্দা করা হয়। স্বদেশী আন্দোলনকে প্রশংসা করলেও বয়কটকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি তারা। তাদের ভাষায়—PERHAPS THE CONSTITUTIONAL AND EFFECTIVE MEANS ছিল বয়কট। বয়কট আন্দোলনকে সর্বভারতীয় করতে আগ্রহী ছিল না। বস্ত্র-বয়কটের ফলে সে সময় বোম্বে ও আহমেদাবাদের ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছিল। কংগ্রসের অবাঙালি নেতৃবৃন্দ তাদের ব্যবসাটাকে বড়ো করে দেখেছিল—বাংলার স্বার্থ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিবর্গের দাবী ছিল বস্ত্রবয়কট করলেই হবে না, তার বদলে বঙ্গে বস্ত্রকারখানা গড়ে উঠুক বাঙালিদের উদ্যোগে। এজন্য জাতীয় ধনভাণ্ডারও গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখানে বাঙালিদেরকে অর্থদান করার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসীরা বোম্বে ও আহমেদাবাদের স্বার্থে এই উদ্যোগকে বাতিল করে দেয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন—চিরস্থায় বন্দোবস্তের কল্যাণে বাঙালি জমিদাররা অনেক টাকা পয়সা কামাই করেছে। সুতরাং তাদের দায়িত্ব—স্বদেশী মিল গড়ে তোলার জন্য মূলধন দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে লিখেছিলেন বিলাসের ফাঁদ নামে একটি প্রবন্ধ। সেখানে বলেছিলেন, ইংরেজের অনুকরণে ব্যক্তিগত ভোগস্পৃহা চরিতার্থ করতে গিয়ে সেই অর্থ সমাজের কল্যাণে ব্যয়িত হতে পারছে না। তিনি লিখেছেন– দেশের অধিকাংশ (জমিদারদের) অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া , কোঠাবাড়ি গাড়িঘোড়া সাজসরঞ্জাম আহারবিহারেই উড়িয়া যাইতেছে । অথচ যাঁহারা এইরূপ ভোগবিলাসে ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন , তাঁহারা প্রায় কেহই সুখে স্বচ্ছন্দে নাই ; তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি , অনেকেরই ঋণ , অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবন নষ্ট হইতেছে—কন্যার বিবাহ দেওয়া , পুত্রকে মানুষ করিয়া তোলা , পৈতৃক কীর্তি রক্ষা করিয়া চলা , অনেকেরই পক্ষে বিশেষ কষ্টসাধ্য হইয়াছে।
বঙ্গভঙ্গ চলমান আন্দোলনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের দ্বিধা ও পশ্চাদপসারণ লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাংলার চরমপন্থী রাজনীতিকরা বয়কট ও স্বদেশীকে স্বরাজের প্রধান হাতিয়ার রূপে ভাবতে শুরু করেছিল।
সে সময় সপ্তম এডওয়ার্ডের পুত্র যুবরাজ ও তাঁ স্ত্রী ভারত সফরে এসেছিলেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাদেরকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। তারা এই জন্যই চেয়েছিলেন বৃটিশকে বেশী ঘাটানো যাবে না। কংগ্রেসে অন্যতম নেতা ভূপেন্দ্রনাথ বসু ২৯ পিসেম্বর বারানসির কংগ্রেস সম্মলনের অধিবেশন থেকে ছুটে এসে কোলকাতায় স্টীমার ঘাটায় উপস্থিত হয়েছিলেন যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানাতে। সেদিন কোলকাতার গোলদীঘিতে স্বদেশী সভা চলছিল। ভূপেন্দ্রনাথ বসু যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানিয়েই জাহাজ ঘাটা থেকে গোলদীঘীর স্বদেশী সভায় যোগ দেন। হোমপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন, লোকে তাঁকে দেখিয়া উত্তজিত হইয়া উঠিয়া—তাহাকে ধিক্কার দিল। দুই দলে মতান্তর যত স্পষ্ট হইতে লাগিল, ততই ছাড়াছাড়ি হইতে লাগিল।
বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে ইংরেজ সরকার দমননীতি গ্রহণ করে। পূর্ব ও আসামের লেফটেন্যান্ট স্যার বামফিল্ড ফুলার ন্যায়বিচারের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে দমন-পীড়ন শুরু করে দেয়। এটা নিয়েও রবীন্দ্রনাথের অনেক ক্ষোভ ছিল। ১৯০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোলকাতায় গ্রান্ড থিয়েটারে স্বদেশী আন্দোলনরত নির্বাচিত কিছু ব্যক্তিকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ সেখানে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান স্বদেশী আন্দোলনে কুপিত রাজদণ্ড যাঁহাদিগকে পীড়িত করিয়াছে, তাঁহাদের প্রতি আমার নিবেদন এই যে, তাহাদের বেদনা যখন আজ সমস্ত বাংলাদেশের হৃদয়ের মধ্যে বহন করিয়া লইল, তখন এত বেদনা অমৃতে পরিণত হইয়া তাহাদিগকে অমর করিয়া তুলিয়াছে। রাজচক্রের যে অপমান তাঁহাদের অভিমুখে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, মাতৃভূমির করুণ করস্পর্শ তাহা বরমাল্যরূপে ধারণ করিয়া তাহাদের ললাটকে আজ ভূষিত করিয়াছে।
দেশী শিল্প-ব্যবসা-বানিজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৮ মার্চ কোলকাতায় একটি দেশী ইন্সুরেন্স কোম্পানী যাত্রা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথও এই ইন্সুরেন্স কোম্পনীর সঙ্গে ছিলেন।
এই সময়কালে রবীন্দ্রনাথ আরও বেশি করে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে এসেছেন। জাতীয় শিক্ষাআন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত মতবিরোধ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ত্বের এই আন্দোলনের প্রতি অনীহাকে তিনি অপছন্দ করেছেন। কিন্তু পুরোপুরি শিক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেননি।
ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মারা গেছেন। সেজো মেয়েটিরও অসুস্থ হয়ে হয়ে আছে। মাতৃহীন ছোটো ছেলেটি আর ছোটো মেয়েটিকে দেখভাল করার মত লোকও তেমন পাচ্ছেন না। বড়ো ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বিলেতে কৃষি বিদ্যা শেখার জন্য। অর্থ সংকট রয়েছে। ধীরে ধীরে গড়ে তুলতেন শান্তি নিকেতন—বিদ্যালয়। তার সকল দ্বায়িত্ব তাঁর একার উপর। আর রয়েছে বিপুল রচনাকর্মের তাড়না। সংসার এবং কর্মজাল থেকে ধীর ধীরে মুক্তি চাচ্ছিলেন। তাছাড়া ঈশ্বরমুখীন এক ধরনের আধ্যাত্মিকতাও তাঁর মধ্যে কাজ করছে। ফলে তিনি এইসব সংশয়াপন্ন, দোদুল্যমান, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন হৃদয়বৃত্তি আর রাজনীতির মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। রাজনীতি ছলনাপূর্ণ হতে পারে—হৃদয়কে সে গণ্যকে করে না।
১৪ এপ্রিল বরিশালে তিনদিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন শুরু হয়। ব্যারিস্টার আবদুল রসুল সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমারসন বরিশালের রাস্তায় তখন বন্দে মাতরম ধ্বনি দেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ব্যারিস্টার আবদুল রসুলকে সামনে রেখে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। রাস্তায় বেরিয়েই শোভাযাত্রা থেকে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া শুরু হয়। পুলিশ তখন বেধড়ক মারপিঠ করে শোভাযাত্রায়। কংগ্রসের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পুলিশের হাতে তিনি আটক হন। ৪০০ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি ছাড়া পান। দ্বিতীয় দিনের সম্মেলন শুরু হলে পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট কেম্প ঘোষণা কর সম্মেলনস্থলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া হবে না এই মর্মে নিশ্চিত করা হলে সম্মেলনের অনুমতি দেওয়া হবে। কেম্পের এই দাবী মানতে নেতৃবৃন্দ অস্বীকার করলে তখন সম্মেলন বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তৃতীয় দিনে সম্মলনে রবীন্দ্রনাথের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তিনি এই উপলক্ষ্যে বরিশালে উপস্থিতও হয়েছিলেন। তাঁকে রাখা হয়েছিল কীর্ত্তনখোলা নদীবক্ষে। সম্মেলনে পণ্ড হয়ে গেলে তিনি ফিরে যান। এ ঘটনায় কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হিরো মর্যাদাপ্রাপ্ত হন বঙ্গে। কোলকাতা ফেরার সময় তাঁর গাড়ি মানুষেরা টেনে শোভাযাত্রা সহকারে ইংরেজ স্টাইলে শহরে আনা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই বিদেশী প্রথার সমালোচনা অনেক থেকেই করে আসছিলেন। তিনি জানেন, দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ালেই হয় না—মন থেকে ইংরেজকে তাড়ানোর দরকার আগে। দেহের আগে আত্মার স্বাধীনতা দরকার। বিদেশী তাড়ানোর আগে স্বদেশী হওয়াটাই সবার চেয়ে জরুরী।
রবীন্দ্রনাথ ২১ এপ্রিল দীনেশচন্দ্র সেনকে চিঠিতে লেখেন, আত্মার স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো স্বাধীনতা নাই—আমরা নতুন বন্ধনকেই মুক্তি বলিয়া ভ্রম করি। আমি এ সময়ে জঞ্জালের মধ্যে নিজেকে জড়াইয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতে চাই না—বেশ একটু নিরালায় ভাল করিয়া নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করিয়া লই—আগে নির্মল অন্তঃকরণে সমস্ত জিনিসটাকে তলাইয়া দেখি—তারপর যদি কথা বলার আবশ্যক হয় ত কথা বলিব। আমি এখন লোকলোচনের অন্তরালে থাকিতে ইচ্ছা করি—আমার আর যশোমানে কাজ নাই। ভিড়ের মধ্যেই যদি দিন কাটাই তবে ঘরের কাজ কখন করিব? এতএব এবারে আমি সরিয়া পড়িলাম।
২৬ এপ্রিল বরিশাল নির্যাতন-পীড়নের প্রতিবাদে রাই পশুপতিনাথের বাড়িতে আয়োজিত সভায় রবীন্দ্রনাথ দেশনায়ক প্রবন্ধটি পড়েন। তিনি লিখেছেন–আপনারা ভাবিয়া দেখুন, বাংলার পার্টিশনটা আজ খুব একটা বড়ো ব্যাপার নহে। আমরা তাহাকে ছোটো করিয়া ফেলিয়াছি। …এই পার্টিশনের আঘাত উপলক্ষে আমরা সমস্ত বাঙালি মিলিয়া পরম বেদনার সহিত স্বদেশের দিকে যেমনি ফিরিয়া চাহিলাম অমনি এই পার্টিশনের কৃত্রিম রেখা ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্র হইয়া গেল। আমরা যে আজ সমস্ত মোহ কাটাইয়া স্বহস্তে স্বদেশের সেবা করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইয়াছি, ইহার কাছে পার্টিশনের আঁচড়টা কতই তুচ্ছ হইয়া গেছে। কিন্তু আমরা যদি কেবল পিটিশন ও প্রোটেস্ট্, বয়কট ও বাচালতা লইয়াই থাকিতাম, তবে এই পার্টিশনই বৃহৎ হইয়া উঠিত—আমরা ক্ষুদ্র হইতাম, পরাভূত হইতাম। কার্লাইলের শিক্ষা-সার্ক্যুলর আজ কোথায় মিলাইয়া গেছে। আমরা তাহাকে নগণ্য করিয়া দিয়াছি। গালাগালি করিয়া নয়, হাতাহাতি করিয়াও নয়। গালাগালি-হাতাহাতি করিতে থাকিলে তো তাহাকে বড়ো করাই হইত।
যাঁহারা পিটিশন বা প্রোটেস্ট্, প্রণয় বা কলহ করিবার জন্য রাজবাড়ির বাঁধা রাস্তাটাতেই ঘন ঘন দৌড়াদৌড়ি করাকেই দেশের প্রধান কাজ বলিয়া গণ্য করেন আমি সে দলের লোক নই সে কথা পুনশ্চ বলা বাহুল্য। আজ পর্যন্ত যাঁহার দেশহিতব্রতিদের নায়কতা করিয়া আসিতেছেন তাঁহারা রাজপথের শুষ্ক বালুকায় অশ্রু ও ধর্ম সেচন করিয়া তাহাকে উর্বরা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন, তাহাও জানি। ইহাও দেখিয়াছি, মৎস্যবিরল জলে যাহারা ছিপ ফেলিয়া প্রত্যহ বসিয়া থাকে অবশেষে তাহাদের, মাছ পাওয়া নয়, ঐ আশা করিয়া থাকাই একটা নেশা হইয়া যায়। ইহাকে নিঃস্বার্থ নিষ্ফলতার নেশা বলা যাইতে পারে, মানবস্বভাবে ইহারও একটা স্থান আছে। কিন্তু এজন্য নায়কদিগকে দোষ দিতে পারি না, ইহা আমাদের ভাগ্যেরই দোষ। দেশের আকাঙ্ক্ষা যদি মরীচিকার দিকে না ছুটিয়ে জলাশয়ের দিকেই ছুটিত তবে তাঁহারা নিশ্চয় তাহাকে সেই দিকে বহন করিয়া লইয়া যাইতেন, তাহার বিরুদ্ধপথে চলিতে পারিতেন না।
দেশের হিতসাধন একটা বৃহৎ মঙ্গলের ব্যাপার, নিজের প্রবৃত্তির উপস্থিত চরিত্রার্থসাধন তাঁর কাছে তুচ্ছ। ঠিক এই উপস্থিত চরিতার্থসাধনটিকে রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করেছিল। তিনি দেখেছিলেন এর মধ্যে দেশের বৃহৎ মঙ্গল সাধনের আকাঙ্খাটা নেই। এ কারণে এই তার কাছে দেশে সম্প্রতি যে আন্দোলন-আলোচনার ঢেউ উঠেছে তার অনেকটাই কলহ মাত্র মনে হয়েছে। কলহ অক্ষমের উত্তেজনাপ্রকাশ, তাহা অকর্মণ্যের একপ্রকার আত্মনিবেদন। এইখানে এসে তিনি বয়কট আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর বিরোধীতার জায়গাটিকে পরিস্কার করে দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, আপনাদের কাছে আমি স্পষ্টই স্বীকার করিতেছি, বাঙালির মুখে 'বয়কট' শব্দের আস্ফোলনে আমি বারংবার মাথা হেঁট করিয়াছি। আমাদের পক্ষে এমন সংকোচজনক কথা আর নাই। বয়কট দুর্বলের প্রয়াস নহে, ইহা দুর্বলের কলহ। আমি নিজের মঙ্গলসাধনের উপলক্ষ্যে নিজের ভালো করিলাম না, আজ পরের মন্দ করিবার উৎসাহেই নিজের ভালো করিতে বসিয়াছি, এ কথা মুখে উচ্চারণ করিবার নহে। আমি অনেক বক্তাকে উচ্চৈঃস্বরে বলিতে শুনিয়াছি–'আমরা য়ুনিভার্সিটি বর্জন করিব।' কেন করিব। য়ুনিভার্সিটি যদি ভালো জিনিস হয়, তবে তাহার সঙ্গে গায়ে পড়িয়া আড়ি করিয়া দেশের অহিত করিবার অধিকার আমাদের কাহারো নাই।…দেশের যাহাতে ইষ্ট, তাহা যেমন করিয়াই হউক সংগ্রহ করিতে হইবে, সেজন্য সমস্ত সহ্য করা পৌরুষের লক্ষণ—তাহার পর সংগ্রহকার্য শেষ হইলে স্বাতন্ত্র্যপ্রকাশ করিবার দিন আসিতে পারে।
তিনি আরও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আজ আমরা দেশের কাপড় পরিতেছি কেবল পরের উপর রাগ করিয়া, এই যদি সত্য হয়, তবে দেশের কাপড়ের এতবড়ো অবমাননা আর হইতেই পারে না। আজ আমরা স্বায়ত্তভাবে দেশের শিক্ষার উন্নতিসাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছি, রাগারাগিই যদি তাহার ভিত্তিভূমি হয়, তবে এই বিদ্যালয়ে আমরা জাতীয় অগৌরবের স্মরণস্তম্ভ রচনা করিতেছি।
১৯০৬ সালের ৪ জুন কোলকাতার পান্তির মাঠে শিবাজী-উৎসব পালিত হয়। সেখানে শিবাজী-মেলা উপলক্ষ্যে উৎসবের প্রবর্তক চরমপন্থী বালগঙ্গাধ তিলককে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। উৎসবে সখারাম গণেশ দেউস্কর-প্রণীত শিবাজী পুস্তিকাটি বিতরণ করা হয়। স্বদেশি আন্দোলনকে হিন্দুরূপ দেওয়ার প্ররোচনামুলক ও অদূরদর্শী প্রচেষ্টা সূত্রপাত হয় এই উৎসব থেকেই। রবীন্দ্রনাথ এই উৎসবকে লক্ষ্মীছাড়া বিশেষণে ভূষিত করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান হিন্দুয়ানী রূপটিও তাঁর এই আন্দোলন থেকে সরে আসার অন্যতম কারণ। তিনি চরমপন্থী আন্দোলনেরও তীব্র বিরোধিতা করেন। ঘরে বাইরে উপন্যাসে চরমপন্থী আন্দোলন বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়।
বয়কট আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এইসব চরমপন্থীরা ব্রিটিশ পণ্য না-কেনা, তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাণ্ডগুলো ঘটনাতে শুরু করে। তাতে সাফল্য আসে খুব অল্পই। এ আন্দোলনের ফলে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কোনো কোনো পণ্য রাতারাতি বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। সেটা কিনতে হয় চড়া দামে লুকিয়ে চুরিয়ে। বিশেষ করে বস্ত্র ব্যবসায়ী মুসলমান তাঁতী বা জোলা সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় সবচেয়ে বেশি। ফলে অধিকাংশ মুসলমান এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ। তাদের আয়ই ছিল এই বস্ত্রব্যবসা। তাদের পূঁজীও ছিল সামান্য। বিদেশী সুতার দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এই সুতা কিনে তারা বস্ত্র বয়ন করত। তার দামও ছিল কম। পাশাপাশি বিদেশী বস্ত্রের দামও কম থাকায় এগুলোও তারা হাটে বিক্রি করত। এই ছোট ব্যবসা থেকে তারা কোনোক্রমে বেঁচেবর্তে থাকত। কিন্তু স্বদেশী শিক্ষিত বাবুরা যখন গ্রাম্য হাঁটে-বাজারে তাদের এই বিদেশী বস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিল, তাদের কারো কারো বস্ত্র পুড়িয়ে দিয়ে তাদের কপর্দক শূন্য করে দিল, এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ গর্জে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এভাবে জোর করে আদর্শ চাপানো যায় না। তিনি ঘরে-বাইরে উপন্যাসে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
ঘরে বাইরের মাস্টার মশায়ের বয়ানে স্বদেশীদের বয়কটপন্থীদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন—
তোমাদের মনে (বৃটিশের উপর) রাগ হয়েছে, জেদ হয়েছে, সেই নেশায় তোমরা যা করছ খুশি হয়ে করছ। তোমাদের পয়সা আছে, তোমরা দু পয়সা বেশি দিয়ে দিশি জিনিস কিনছ, তোমাদের সেই খুশিতে ওরা তো বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ওদের তোমরা যা করাতে চাচ্ছ সেটা কেবল জোরের উপরে। ওরা প্রতিদিনই মরণ-বাঁচনের টানাটানিতে পড়ে ওদের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ছে কেবলমাত্র কোনোমতে টিঁকে থাকবার জন্যে— ওদের কাছে দুটো পয়সার দাম কত সে তোমরা কল্পনাও করতে পার না— ওদের সঙ্গে তোমাদের তুলনা কোথায়? জীবনের মহলে বরাবর তোমরা এক কোঠায়, ওরা আর-এক কোঠায় কাটিয়ে এসেছে ; আর আজ তোমাদের দায় ওদের কাঁধের উপর চাপাতে চাও, তোমাদের রাগের ঝাল ওদের দিয়ে মিটিয়ে নেবে? আমি তো একে কাপুরুষতা মনে করি। তোমরা নিজে যত দূর পর্যন্ত পার করো, মরণ পর্যন্ত— আমি বুড়োমানুষ, নেতা বলে তোমাদের নমস্কার করে পিছনে পিছনে চলতে রাজি আছি। কিন্তু ঐ গরিবদের স্বাধীনতা দলন করে তোমরা যখন স্বাধীনতার জয়পতাকা আস্ফালন করে বেড়াবে তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব, তাতে যদি মরতে হয় সেও স্বীকার।
… মাস্টারমশায় বললেন, শুধু তাই নয়, যারা (বয়কট) ব্রত নিয়েছে তারা বিব্রত করবারই ব্রত নিয়েছে। তোমরা চাও, যারা ব্রত নেয় নি তারাই ঐ (দেশী দামী) সুতো কিনে যারা ব্রত নেয় নি এমন লোককে দিয়ে কাপড় বোনাবে, আর যারা ব্রত নেয় নি তাদের দিয়ে এই কাপড় কেনাবে। কী উপায়ে? না তোমাদের গায়ের জোরে আর জমিদারের পেয়াদার তাড়ায়। অর্থাৎ ব্রত তোমাদের কিন্তু উপবাস করবে ওরা, আর উপবাসের পারণ করবে তোমরা।
এই বস্ত্রবয়কটের জোরজবরদস্তির কারণে সে সময় ফরিদপুরে ছোটোখাটো দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছিল। দরিদ্র জোলা সম্প্রদায়ের মানুষ এই স্বদেশী বাবুদের রুখে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের সঙ্গে নিম্নবিত্ত মানুষেরও যোগ ছিল না। তাদের মতামত কখনোই নেওয়া হয়নি। তাদের স্বার্থের দিকে রাজনৈতিক নেতারা বা এই স্বদেশীবাবুরা খুব কমই তাকিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গের জমিদারী এলাকায় তাঁতের স্কুল বসিয়েছিলেন। তাঁদেরকে কম দামে সুতো কিনে দিয়েছিলেন। জোলা প্রজাদের উৎপাদিত বস্ত্রবিক্রির চেষ্টাও করেছিলেন। তবে এই কাজে যাদের উপর তিনি নির্ভর করেছিলেন—তারা তাঁকে আর্থিকভাবে ঠকিয়েছিল। সেটা অন্য ইতিহাস।
বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ্য করে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানের ভেদরেখাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই ধরনের বিরোধের নজির ইতিপূর্বে ছিল না। মুসলমানদের মনে তাদের না পাওয়ার বেদনাটি জেগে উঠেছিল। মুসলমান শাসনকালে মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের সংকীর্ণতাকে ক্ষমার চোখে দেখেছে, দেখে তারা ঠকেছে—কিন্তু ইংরেজ আমলে হিন্দুদের এই সংকীর্ণতা প্রবল হয়েছে, তখন মুসলমান সমাজ সে ক্ষমার জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা বৈষম্যকে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে। শিক্ষিত মুসলমান আবিষ্কার করলেন, তারা রাষ্ট্র কাঠামোতে হিন্দুদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকার কারণটি দুরীভূত করার কোনো চেষ্টাই করেনি হিন্দু জমিদার-উচ্চবিত্ত শ্রেণী। হিন্দুদের সঙ্গে থাকলে তাঁরা সে ধরনের সুযোগও পাবে না। পরিস্থিতিটা সত্যি ছিল। তবে এই পরিস্থিতিটা ইংরেজের সৃষ্টি ছিল। ইংরেজরা হিন্দুদেরই রাষ্ট্রে বেশী বেশী সুযোগ সুযোগ দিয়েছে, আর মুসলমানদের বঞ্চিত করে রেখেছে। কিন্তু যখন বঙ্গদেশে ইংরেজবিরোধী চেতনা জাগতে শুরু করেছে—তখন থেকেই চেতনার শক্তিটাকে নস্যাৎ করার জন্য ইংরেজরা মুসলমানদের মনে এই বঞ্চনার কারণটি হিন্দুদের ঘাড়ে চাপায়। এবং তাদের প্রতি বিভেদ সৃষ্টির কৌশল করে সফল হয়। এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা এই হিন্দু-মুসলমানদের বিভেদের কারণটি কখনো কার্যকরভাবে দূর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। একমাত্র রবীন্দ্রনাথই শুরু থেকে এই বিভেদের দিকে সকলের উদ্দেশ্য বক্তব্য দিয়েছে। বলেছেন শিক্ষা-দীক্ষা-পেশাসহ অর্থনৈতিক দিক থেকে মুসলমানদের হিন্দুদের সমকক্ষ করার ব্যবস্থা করা ছাড়া এই বিভেদ দূর হতে পারে না। জীবিকার মিলে, সামাজিক আচার-আচরণের মিলে, সাহিত্য-সাধনার মিলে, সর্বোপরি মনুষ্যত্বের মিলে এ ভেদবুদ্ধি দূর হতে পারে। দুই সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক সমতা মিলনের, সেই সূত্রে স্বশাসনের চাবিকাঠি। এ জন্য প্রয়োজনে হিন্দুদেরই বেশী ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিকরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের উল্টোপথে। তারা মিলনের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনটা হয়ে উঠেছিল—একটা যতুগৃহ বা মোমের ঘর। একটু স্ফুলিঙ্গ পেলেই ফস করে জ্বলে উঠেছিল। পুরো গৃহটি পুড়ে গিয়েছিল। ঠেকানোর কোনো সুযোগ ছিল না। পুরো বঙ্গদেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে ৪০-৪২ বৎসর সময়ের মধ্যে। দেখা যায় ১৯০৬ সালে রাজনৈতিক কারণে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গারও শুরু হয়। এই সময় থেকে হিন্দুরা মসজিদের সামনে জোরে জোরে ঢাক ঢোল পিটাতে শুরু করে, আর মুসলমানরাও বেশি বেশি প্রকাশে গরু কোরবানী দিতে শুরু করে। সহনশীলতাটার হ্রাস ঘটতে শুরু করে।
এই বিভেদ রেখাটি ধরে ১৯০৬ সালে ডিসেম্বর মাসে স্যার সলিমুল্লাহর আহ্বানে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এই মুসলিম লীগ মুসলমান জমিদার, উচ্চবিত্ত মুসলমানদের উদ্যোগে গড়ে উঠলেও সকল শ্রেণীর মুসলমানের সমর্থন লাভ করে। ভাগ্যের পরিহাস যে, একই সময়ে হিন্দু মহাসভা নামে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনও গড়ে ওঠে।
বঙ্গভঙ্গের সময়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দানা বাঁধে। তখনকার শিক্ষিত তরুণদের এক অংশ মনে করেছে—কংগ্রেসের সাংবিধানিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসবে না। এলেও সেটা দেরী করে আসবে। অথবা বৃটিশ যদি দয়া করে দেয়, তবেই সেই স্বাধীনতা পাওয়া যাবে।
১৯০৫ সালে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে অনুশীলন নামে একটি গড়ে ওঠে। এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করা। এই আন্দোলন তখনকার শিক্ষিত হিন্দুদের মনে অসাধারণ উৎসাহ সৃষ্টি সৃষ্টি করেছিল। এ আন্দোলনের একটা সাম্প্রদায়িক রূপও প্রকট ছিল। মুসলমান সম্প্রদায় সে কারণেই এই সন্ত্রাসবাদি আন্দোলনে যোগ দেননি। বা তাকে সমর্থনও দেননি। এমন কি বন্দে মাতরম গানটিও ছিল মুসলমানদের কাছে অসহনীয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বন্দে মাতরম গানটিতে মুসলমানদের আপত্তি করার জায়গা আছে। পরে জহরলাল নেহেরুর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ গানটির সাম্প্রদায়িক অংশটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সন্ত্রাসবাদীরা এই সংশোধিত বন্দে মাতরমকে মেনে নেননি। তারা তাদের আন্দোলনের শক্তি হিসাবে কালীকে/দুর্গাকে দেখতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল গীতা। এই সব কারণ এই আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণের বাঁধা সৃষ্টি করেছে। তাঁদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সবর্নাশা রূপটি একেছেন তার ঘরে বাইরে উপন্যাসে। তারা ছিল ব্যক্তিগত লোভমোহের উর্ধ্ব উঠতে পারেনি। বিপ্লবীপনাতে এসেও বাবুপনা এদের ঘোঁচেনি। ফলে দরিদ্র মানুষ তখনো তাদের কাছে ব্রাত্যই ছিল। জনগণের কাছ থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। একপর্যায়ে ডাকাতি-দস্যুতার মত উপায়ও তারা গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরের সন্দ্বীপ চরিত্রটি এই সন্ত্রাসবাদি নেতাদের মনে রেখেই নির্মাণ করেছিলেন। এরা স্বদেশকে গড়ার ব্রতটা গ্রহণ করেনি। এদের সে ধরনের পরিকল্পনাও ছিল না। ফলে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ই নয়, এদের আন্দোলনের সঙ্গে নিম্নবর্গের হিন্দুদেরও সমর্থন ছিল না।
জাতীয় শিক্ষার আন্দোলনটি বাস্তববুদ্ধি ও আন্তরিকতার অভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরী এই ত্রিমুখী শিক্ষার সংকল্প নিয়ে পরিষদ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারকানাথ পালিত, ডাঃ নীলরতন সরকার, মণীন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ নেতারা কারিগরী শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন পরিষদের আর্থিক সংগতি ও দেশের প্রয়োজনের দিকটির কথা মনে রেখে। অন্যরা এটা মানেননি। ১৯০৬ সালের ১ জুন জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি নয়—দুপক্ষ দুটি প্রতিষ্ঠানকে ইংরেজের আইনঅনুসারে রেজিস্ট্রশন করা হয়। তবে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এন্ড স্কুলই সক্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথকে এই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের ডাইরেক্টর করা হয়েছিল। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হলে হলেও কলকাতা ও মফস্বলের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এই জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তারা ইংরেজের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঙ্গেই থেকেছে। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের পরিকল্পনাঅনুসারে পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়নি। উত্তীর্ণ ছাত্রদেরকে উচ্চশিক্ষা ও কর্মনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিট্যুটের সঙ্গে মিলিত হয়ে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এন্ড টেকনিক্যাল ইনস্টিট্যুট নাম ধারণ করে। এবং অধিকাংশ সম্পদ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করে দেয়। ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে ডঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিয়োগ পেলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন—তাঁর স্বদেশ অন্যদের স্বদেশের চেয়ে আলাদা। তিনি তাঁর মতো করে তাঁর স্বদেশের কাছে ফিরে গেলেন—গেলেন পূর্ববঙ্গে, পল্লীপূনর্গঠনে।