দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় বোন শামসুন্নাহার বাদী হয়ে চাচা ও চাচাতো ভাইসহ নয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
Published : 28 Feb 2023, 12:41 PM
মুহূর্তের মধ্যে হারিয়েছেন দুই ছেলেকে, আরেক ছেলে হাসপাতালে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। কাঁদতে কাঁদতে গলার কণ্ঠস্বর বসে গেছে বৃদ্ধা জহুরা বেগমের। তাকে ঘিরে রেখে স্বজনরা সান্তনার নানা কথা বলছেন। কিন্তু কোনকিছুতেই কাজ হচ্ছে না। নিঃশব্দ কান্নায় তার চোখের কোল বেয়ে ঝরছে অবিরাম অশ্রুধারা।
একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে চাচাতো ভাইদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হওয়া ব্যবসায়ী আসলাম সানি ও সফিকুল ইসলাম রনির বাড়ির প্রতিটি ঘরে। স্ত্রীরা হারিয়েছেন তাদের স্বামীকে। শিশু সন্তানরা খুঁজছে তাদের বাবাকে। পাঁচ বোনও ভাইদের শোকে কাতর। সকলেই একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছেন। পুরো বাড়িতে শোকের মাতম।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের খাসপাড়ার পাঁচপাড়া এলাকার নিহতদের বাড়ির সামনে যেতেই কান্নার শব্দ কানে আসে। নিহতদের পরিবার ও স্বজনদের উপস্থিতিতে বাড়ির ভেতর তখন গিজগিজ করছিল।
পৈত্রিক ভিটায় নির্মিত তিনতলা এ বাড়ির নিচতলায় বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন আসলাম সানি (৫০), মেজো ভাই রফিকুল ইসলাম (৪০) ও ছোট সফিকুল ইসলাম রনি (৩০)। তারা প্রয়াত মো. সানাউল্লাহর ছেলে।
ভবনের উপর দুটি তলায় পোল্ট্রি ফার্ম চালাতেন রফিকুল ও সফিকুল। বড়ভাই আসলামের ছিল বিয়ে অনুষ্ঠানের ডেকোরেটর সরঞ্জামের ব্যবসা।
তাদের বাড়ির বিপরীত পাশের ভিটাতে চাচা মহিউদ্দিন ও চাচাতো ভাইদের বসবাস। রোববার দুপুরে জমির বিরোধে সেই চাচাতো ভাইদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন আসলাম ও সফিকুল। গুরুতর জখম অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন রফিকুল।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পর থেকে নিহতদের চাচা মহিউদ্দিনের ছেলে মো. মোস্তফা (৪০), মামুন হোসেন (৩৫), মফিজুল ইসলাম (২৫), মারুফ (১৮) পলাতক রয়েছেন।
সোমবার দুপুরে আসলাম সানিদের বাড়ির একটি কক্ষে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন তাদের সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধা মা জহুরা বেগম। ছেলেদের প্রসঙ্গ তুলতেই দুই হাত প্রসারিত করে শোকাহত বৃদ্ধা মা বলেন, ‘সামান্য জমিজমার ঝগড়া নিয়া আমার তাগড়া তিনটা পোলারে কোপাইয়া শ্যাষ কইরা দিলো। চোখের সামনে তিন ছেলের রক্তাক্ত শরীর দেখছি।
“পোলারা যার যার ব্যবসা নিয়া ছিল। হেরা তো আর জানতো না তাগোরে মারার লাইগা যম রেডি হইয়া আছে। আমার তিনডা পোলা, তিনোডারেই শ্যাষ কইরা দিলো। আমার আসলাম, আমার রনি, ওরে আমার রফিকুল!”
একটি কক্ষে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মুঠোফোনে নিজের ভাইকে স্বামী হারানোর কথা জানাচ্ছিলেন আসলাম সানির স্ত্রী সোনিয়া আক্তার।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কান্না থামানোর জন্য সান্ত্বনার বাক্যের উত্তরে তিন সন্তানের জননী সোনিয়া বলছিলেন, “আমারে আর কী বুঝাবি? ভাইরে ভাই, আমি কী করমু বুঝতেছি না। এমনে কেউ কাউরে মারে না। আমারে পুরা খালি কইরা দিলো। আমি পোলাপানগুলারে লইয়া এখন কী করমু? সন্তানগুলা তো এতিম হইয়া গেল।
“যেমনে হউক আসামিগোরে ধরাইয়া দে। আমি আর কিছু চাই না, যারা আমারে এমনে খালি করছে তাগো ফাঁসি চাই।”
স্বামী ও দেবরকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার বিচার দাবি করে সোনিয়া বলেন, “আমার পোলাপানগুলোরে (দুই ছেলে, এক কন্যা) এতিম কইরা গেলো। কেউরে যেন আর এতিম আর স্বামীহারা না হইতে হয় সেই বিচার আমি সবার কাছে চাই।”
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে সদ্য স্বামী হারানো এই নারী বলেন, “ক্যামনে এমন কোবান কোবাইলো গো? আল্লাহ! কোনো মানুষ মানুষরে এমনে মারতে পারে! আমি গিয়া দেখলাম, মাইরা ফালাইয়া থুইছে। একটুও মায়া নাই, দয়া হয় নাই। হারামিগুলা ক্যামনে এইটা করলো গো।
“উনি (আসলাম) মনে হয় বাইতে আমার কোলেই মইরা গেছে! হাসপাতালে নিয়া কাজ হয় নাই। কান দিয়া, মুখ দিয়া রক্ত বাইর হইছে। গলা জাবরাইয়া ধরছিলাম।”
বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন সোনিয়া। পাশে দাঁড়ানো স্বজনরা তাকে বারবার শান্ত হওয়ার কথা বললেও থামেনি সেই কান্না।
সান্ত্বনায় মানছেন না নিহত সফিকুল ইসলাম রনির স্ত্রী সানজিদা আক্তারও। শিশু সন্তান আনাস আহমেদকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন তিনিও। সানজিদা বলেন, “অবুঝ শিশু কিছু বুঝতেছে না। বাড়িতে লোকজনের ভীড় দেখে বারবার কাঁদছে আর ‘বাবা, বাবা’ বলে ডাকছে। তার বাবা যে নাই সেই কথা ওরে কী করে বুঝাই!”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রফিকুল ইসলামের স্ত্রী সাদিয়া ইসলাম মিথিলাও শঙ্কিত তার স্বামীর পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি বলেন, “আইসিইউতে আছেন উনি। বাঁচবেন কিনা জানি না।” বলেই ঢুকরে কেঁদে ওঠেন এই নারী।
সাদিয়া বলেন, “জমিজমা নিয়ে আমার স্বামী ও ভাসুরদের সাথে তাদের চাচাতো ভাইদের ঝামেলা ছিল। বছরখানেক আগেই সবকিছু মিটমাট হইয়া গেছিল। কিন্তু চাপা ক্ষোভ রাইখা দিছিল তারা। সেই ক্ষোভ থেকেই তুচ্ছ ঘটনায় আমার স্বামীসহ ভাসুর, দেবরকে নির্মমভাবে কোপাইছে।”
হতাহতদের বোন শামসুন্নাহার বলেন, “আমরা পাঁচবোনের তিনটা ভাই। তিনভাইরেই নির্মমভাবে কোপাইলো। ছোট ভাইরে নিয়া ময়মনসিংহ আরেক বোনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল।
“ঘটনার দিন তার ট্রেনের টিকেট কাটতে যাওয়ার কথা। সর্বশেষ টিকেট কাটা নিয়েই কথা হইছিল তার সাথে। ও আমারে চিন্তা না করার কথা বলছিল। তারপরই শুনি এই ঘটনা। আমি এই নির্মমতার সুষ্ঠু বিচার চাই।”
সোমবার বিকালে নিহত দুই ভাইয়ের মরদেহ ময়নাতদন্তের পর নিজ বাড়িতে আনা হয়। সন্ধ্যার পর স্থানীয় একটি কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয় বলে স্বজনরা জানান।
জমি সংক্রান্ত বিরোধ জিইয়ে ছিল বংশানুক্রমে
স্থানীয় লোকজন ও নিহতের স্বজনদের ভাষ্যমতে, প্রয়াত ছমিরউদ্দিন বেপারীর তিন ছেলের মধ্যে মেজো সানাউল্লাহ ও ছোট মহিউদ্দিন। তাদের দুই পক্ষের মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিরোধ দীর্ঘবছর পুরোনো। বংশানুক্রমে এই দ্বন্দ্ব তাদের ছেলেদের মধ্যেও জিইয়ে ছিল।
জমির এই বিরোধ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলাও চলমান। এর আগে একাধিকবার উভয়পক্ষের মধ্যে মারামারির পর স্থানীয়ভাবে বিচার-সালিশও হয়েছে।
তাদের প্রতিবেশী দুই যুবক ও এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জমিজমা নিয়ে দুইপক্ষের দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। উভয়পক্ষই শক্তি-সামর্থ্যর জায়গা থেকে সমানে সমান। একপক্ষে তারা তিন ভাই অন্যপক্ষে চার ভাই। তাদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও ঝগড়াঝাঁটি হতো।
তবে এই ঝগড়ার জেরে এইরকম রক্তক্ষয়ী ঘটনা হবে তা প্রতিবেশীদের ধারণার বাইরে ছিল।
জমি সংক্রান্ত বিরোধে উভয়পক্ষকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদে সালিশও হয়েছিল বলে জানান কাঁচপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হাছান খান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দুই-তিন বছর আগেও আমরা ইউনিয়ন পরিষদে দুই পরিবারকে নিয়ে সালিশে বসেছিলাম। সালিশের পর তারা বাড়ির সীমানা প্রাচীর তৈরি করে।
“তারপর থেকে আমরা তেমন ঝগড়ার কথা শুনিনি। এর মধ্যেই পুরোনো এই ক্ষোভ এভাবে মাথাচাড়া দেবে, দু’জন মানুষকে খুন করবে তা আমরা ভাবতে পারিনি।”
অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করার আশ্বাস
এদিকে সোমবার দুপুর ১টার দিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমাসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হতাহতদের বাড়িতে যান।
এ সময় তারা হতাহতদের স্বজন, স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে কথা বলে আসামিদের ফাঁসির দাবির প্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। স্বজনদের ধৈর্য ধারণের অনুরোধও জানায় পুলিশ।
ডিআইজ নুরুল ইসলাম বলেন, “পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি দেখছে। এভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করার পর কারও ছাড় পাবার কোনো সুযোগ নেই।”
ডিআইজির নেতৃত্বে পুলিশের দলটি ঘটানস্থলও পরিদর্শন করেন। পরে নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “ঘটনার পর থেকেই পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) দোষীদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা চালাচ্ছে। অভিযুক্তদের আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। শীঘ্রই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
“আমরা চেষ্টা করবো দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার চার্জশিট দেয়ার মাধ্যমে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে।”
তুচ্ছ বিষয় থেকে নির্মম এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “হতাহত ও অভিযুক্তদের বাড়ির সামনের একটি ডোবার মালিকানা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় ১০ বছর ধরে বিরোধ চলছিল।
“রোববার সেই খালের সঙ্গে সরকারি একটি নালায় পাইপলাইন সংযোগ দেওয়া নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে তর্ক হয়। তর্ক থেকেই তাৎক্ষণিক হত্যার মতো ঘটনা ঘটে যায়। ছোট্ট ঘটনা থেকে এমনটা হয়ে যাবে তা কেউ আগে থেকে ভাবতে পারেনি।”
চাচা-চাচাতো ভাইদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ১
দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় বোন শামসুন্নাহার বাদী হয়ে চাচা ও চাচাতো ভাইসহ নয়জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
সোমবার বিকেল ৪টার দিকে মামলাটি রেকর্ড করা হয় বলে সোনারগাঁ থানার ওসি মাহবুব আলম জানান।
এর মধ্যে চাচা মহিউদ্দিনের মেয়ে ও মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মোর্শেদা বেগমকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অব্যাহত অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান ওসি।
এদিকে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্দ স্বজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী রোববার রাতে অভিযুক্তদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। এতে কেউ হতাহত না হলেও অভিযুক্তদের বসতবাড়িসহ কয়েকটি ঘর পুড়ে যায়। এই ঘটনার পর রাত থেকেই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।