দেশের অন্যান্য স্থানের মতো জয়পুরহাটের মানুষও একাত্তরে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ করে, যুদ্ধকে সংগঠিত করে, জীবন দিয়ে অবদান রেখেছে মাতৃভূমির স্বাধীনতায়। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও তাদের অনেকেরই ভাগ্যে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদের স্বীকৃতি মেলেনি।
Published : 14 Mar 2022, 08:46 AM
জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আমজাদ হোসেন জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাশাপাশি অনেকেই দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণসহ অস্ত্র চালনা শিখে যুদ্ধে অংশ নেন।
আবার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছেন অনেকেই; তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যার স্বীকৃতি পাননি।
সরেজমিনে জয়পুরহাট সদর ও কালাই উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত অনেক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম পাওয়া গেছে, যাদের এখনও কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি।
এমন কয়েকজনের স্বজন ও সহযোদ্ধার সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়। তারা স্মৃতচারণ করে তুলে আনেন সেই বীর যোদ্ধাদের অবদান এবং স্বাধীন দেশে তাদের বঞ্চিত হওয়ার হতাশার গল্প।
আবুল কাশেমের স্বজনের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়। তাদের স্মৃতিচারণে মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা উঠে আসে।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবী শহীদ ডা. আবুল কাশেমকে ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই হাত-পা বেঁধে রাজাকাররা জয়পুরহাট শহরের দেবীপুরের বাড়ি থেকে সকালে জয়পুরহাট রেলস্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে গাছের সঙ্গে বেঁধে ভোর রাত পর্যন্ত নির্যাতন করে। পরে মাথায় কাপড় বেঁধে সদরের কুঠিবাড়ি ব্রিজ এলাকায় নিয়ে চোখ, হাতের নখ, দাঁত তুলে নির্যাতনের পর নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। শহীদ ডা. আবুল কাশেমসহ শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কার না করায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
আবুল কাশেমের পরিবারের পক্ষে কাজী আসাদুজ্জামান জয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও কোনো সুরাহা হয়নি।
সদর উপজেলার দোগাছীর ইয়াকুব আলী মন্ডলকেও পাকিস্তানি সেনারা জিপের পেছনে বেঁধে টেনে-হিঁছড়ে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে ভারত সীমান্তের চকবরকতের পাগলা দেওয়ান এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর বন্দুকের বেয়নেটের খোঁচায় মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং সেখানে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের লাশের সঙ্গে গণকবর দেয়।
শহীদ ইয়াকুব আলী মন্ডলের নাতি আরিফুর রহমান রকেট বলেন, ”১৯৭১ সালে পাকসেনারা আমার দাদাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এখনও শহীদের স্বীকৃতি পায়নি। যারা শহীদ হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক এবং মুক্তিযুদ্ধ করা লোক তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বা তালিকা নেই। তাদের সকলের তালিকা হওয়া দরকার।”
শহরের খনজনপুর মিশনের সাইকেল মেকার অমর সরকার বুড়ো লোহার কামান তৈরি করে যুদ্ধে অংশ নেন। তারও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি বলে অভিযোগ পরিবারের।
তিনি বলেন, “আমার বাবা যুদ্ধের সময় লোহা দিয়ে কামান বানিয়ে যুদ্ধ করেছিল। সেই কামান জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এখনও মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পাননি। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে।”
শহরের দক্ষিণ দেওয়ান পাড়ার মৃত আনজীর হোসেন চাঁদ মুক্তিযুদ্ধের সময় তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
তার পরিবারের সদস্যরা জানান, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জয়পুরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু স্বীকৃতি পাননি তিনিও। তার সন্তানরাও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এমন অভিযোগ অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের।
কালাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুনিশ চৌধুরী বলেন, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী আখন্দ ও একই উপজেলার বাইগুনী গ্রামের ভাষা সৈনিক মনমোহন চৌধুরী, বাখরা গ্রামের মৃত মজির হোসেন, মহেশপুর গ্রামের মৃত লুৎফর রহমান, দিঘিরাগাড়ি (প. কুজাইল) গ্রামের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মৃত বদিউজ্জামানসহ (পাকবাহিনীর হাতে নিহত) আরও অনেকেই একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেউ তাদের খোঁজ খবর রাখেনি বলে অভিযোগ করেন মুনিশ চৌধুরী।
সংস্কৃতিকর্মী টপি মো. এনামুল হক বলেন, ”ছোটবেলা থেকেই শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান দেখে আসছি। আমরা এখানে চেতনার চাষ করি। সরকারি-বেসরকারি, স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা কর্মসূচি হয় এ ময়দানে। শহীদ ডা. আবুল কাশেম একজন বুদ্ধিজীবী। তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ময়দানে কিছুই নেই।
তার জীবনী স্থাপনসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া খুবই প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়াও অনেকেই শহীদ হয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন অথচ স্বীকৃতি মেলেনি, তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
জয়পুরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী বলেন, অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি পাননি। শহীদ ডা. আবুল কাশেম, শহীদ ইয়াকুব আলীসহ অনেকের স্বীকৃতি পাওয়ার দরকার ছিল।
জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ আলী আরও বলেন, ”যারা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ আছে, আমার অন্তরে অন্তস্থল থেকে দাবি করব এই মানুষগুলোর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের মূল্যায়ন হোক।”
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম বলেন, “যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন তাদের অনেকেরই স্বীকৃতি মেলেনি। এমনকি অনেকে শহীদ হয়েছেন কিন্তু স্বীকৃতি পাননি।
”তারা বা তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করতে পারবেন। তদন্ত প্রতিবেদনসহ সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা পেলে শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের জন্য স্বীকৃতি বা রাষ্ট্রের যেকোনো সুযোগ সুবিধার নির্দেশনা পেলেই দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে এবং এসব প্রক্রিয়া শেষে তালিকাও করা সম্ভব হবে।