‘শালগাছে ফুটেছে সারজম, মহুয়ায় ফুটেছে মাতকম’ গানে মাদলের তালে নেচে নেচে বসন্ত বরণ করল সাঁওতালরা।
Published : 04 Mar 2020, 08:16 PM
বুধবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার পশ্চিমে কামদিয়া ইউনিয়নের মোত্তালেব নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আয়োজন করে উৎসব।
সেখানে ছয়টি ইউনিয়নের ১৭ গ্রামের এক হাজার ১৬৯ সাঁওতাল পরিবারের বাস। তারা অংশ নেন বাহা পরব নামের এ বসন্ত উৎসবে।
সাঁওতালি ভাষার ‘বাহা’ শব্দের বাংলা অর্থ ফুল, আর উৎসব অর্থে ‘পরব’ শব্দটি বাংলা ভাষায়-ও অচেনা নয়। বসন্তের ফুলের এ উৎসবে প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যার এই মানুষরা।
বসন্তে প্রকৃতি সাজে নানা রঙের ফুলে। নতুন ফুল ফোটার আনন্দে ও দেবতাকে তুষ্ট করতে সাঁওতালরাও মাতে নাচে আর গানে। এ পরবকে ঘিরে নানা বিধিনিষেধ মেনে চলেনও তারা। প্রতিবছর বসন্তকে বরণ না করা পর্যন্ত সাঁওতালরা মাতকমের মধু খান না; খোঁপায় গোজেন না সারজম ফুল।
ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হয়ে থাকে বাহা পরব। প্রথম দিনকে বলে ‘উম’, দ্বিতীয় দিনটির নাম ‘বাহা সীরদি’। গ্রামের মানঝি (গ্রাম প্রধান) পরবের দিন নির্ধারণ করেন।
গ্রামের নাইকে (পুরোহিত) মঙ্গল টুডু বলেন, আমরা যেন আজ থেকে সারাবছর ভালোভাবে চলতে পারি। আমাদের যেন কোন অমঙ্গল না হয়, কষ্ট না হয় আর এ আনন্দ যেন সারা বছর একই রকম থাকে সেজন্য বাহা পূজা করা হয়।
বুধবার উৎসবের সকালে মঙ্গল টুডু ধবধবে সাদা ধুতি পড়ে পূজা জাহের থানে যান। তার হাতে কাঁসার থালাতে থাকে সিঁদুর, কলা, ধূপ আর নতুন নতুন ফুল। গোবর দিয়ে লেপা পূজার স্থানে বসে আচার পালন করেন তিনি।
এ সময় সাঁওতালদের তিন দেবতা জাহের এঁরা (ফুলের দেবী), মারাঙবুরু (সাঁওতাল দেবতা প্রধান), পারগানা বঙ্গা (এলাকার দেবতা) এর পূজা করেন এই নাইকে।
এরপর মুরগির মাথায় সিঁদুর দিয়ে সেটিকে খেতে দেন আতপ চাল। খাওয়া শেষে মুরগিটিকে বলি দেওয়া হয়।
আদিবাসী নেত্রী কেরিনা হাসদা বলেন, বাহা পরব সমতলের সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সাঁওতালদের দ্বিতীয় প্রধান উৎসব।
“আদিবাসীরা যতক্ষণ না ফুল উৎসব করতে পারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আদিবাসী সমাজে নতুন ফুল ব্যবহার করা হয় না।
“মেয়েরা তাদের খোপায়-মাথায় এ ফুল দিতে পারে না।”
এ দেশের প্রকৃতির সাথে আদিবাসী সমাজ মিশে আছে উল্লেখ করে এ নেত্রী আক্ষেপ করে বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় যেভাবে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, যেভাবে বনজঙ্গল উজাড় হয়ে যাচ্ছে, আদিবাসীরা জায়গা থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। তাতে সাঁওতালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আগের জৌলুস হারাতে চলেছে।
আদিবাসী নেতা ফিলিমন বাস্কে বলেন, “বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষা আর বহু জাতির সম্মিলনে বাংলাদেশ একটি জাতি-বৈচিত্র্যের দেশ।
“এ দেশের পাহাড় থেকে সমতলে ৪৫টি আদিবাসী জাতি বাস করে-যাদের রয়েছে স্বতন্ত্র্য ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি।
দেশের সংখ্যাগুরু বাঙালিদের সঙ্গে বৈচিত্র্যময় এসব আদিবাসীর ভাষা ও সংস্কৃতির তেমন কোন পরিচয় নাই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রধান জনগোষ্ঠীর অবহেলা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাবে আদিবাসীদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি আজ প্রায় বিপন্ন। কিছু কিছু এর মধ্যেই হয়ে গেছে বিলুপ্ত “
বিভিন্ন বর্ণের আদিবাসী-বাঙালির মিলন মেলায় পরিণত হয় এ উৎসব স্থল। মাঠে বসা সর্বজনীন মেলাও। মেলার স্টলে শোভা পায় আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সামগ্রীও।
বাহা পরব উদযাপন কমিটি আহ্বায়ক এ্যামিলি হেমব্রম আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন। বক্তব্য দেন-গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ প্রধান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রামকৃষ্ণ বর্মন, গাইবান্ধা উদীচীর সভাপতি জহুরুল কাইয়ুম, গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি মেহেদী হাসান, সাংস্কৃতিক কর্মী দেবাশিষ দাশ দেবু, রণজিৎ সরকার, অবলম্বনের নির্বাহী পরিচালক প্রবীর চক্রবর্তী, আদিবাসী নেতা ফিলিমন বাস্কে, আদিবাসী নেত্রী কেরিনা হাসদা প্রমুখ।
২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫৪টির বেশি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর আনুমানিক ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন মানুষ বাস করেন বলে বাংলাদেম ইন্ডেজেনাস পিপলস পোরামের এক প্রকাশনায় জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের এক সংস্থার গবেষণা জার্নালের এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী এসব জনগোষ্ঠীর ৯২ শতাংশই সাঁওতাল। বাংলাদেশ বাইরে ভারতের বিহার ও আসাম রাজ্য ছাড়াও নেপাল ও ভুটানে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। ২০০৬ সালের এক গবেষণাকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে-বিশ্বে সাত কোটি সাঁওতাল রয়েছে।