চাঁদপুরের খোরশেদ আলম তালুদার (৪৩) শ্রমিকের ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া এসেছিলেন ১৯৯৪ সালে।
Published : 24 Jul 2017, 07:37 PM
গত ২৩ বছর ধরে তিনি দেশটির পেরাক শহর থেকে প্রায় ৩০ কি.মি. দূরে আইয়ের পানাস নামক একটি জায়গায় পাথরের পাহাড় ভাঙ্গার কাজ করে আসছেন।
মাঝখানে তিনি কিছুদিন অবৈধ ছিলেন৷ ভিসা নবায়ন করতে গিয়ে পড়েছিলেন দালালের খপ্পরে৷ পাসপোর্ট আর টাকা দুই-ই হারিয়ে দিশাহারা ছিলেন প্রায় চার বছর৷
জীবনের ঘানি টানতে টানতে ২৩টি বছর পার করে দিয়েছেন খোরশেদ৷ তিনি এবার মনস্থির করলেন, তার ছোট্ট ছেলেকে মালয়েশিয়াতে আনবেন, তার জায়গাতে কাজে লাগিয়ে তিনি দেশে ফিরবেন৷ আর কতোকাল মালয়েশিয়াতে পাথর ভাঙ্গবেন?
খুব সুন্দর বাস্তবমুখি একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন খোরশেদ৷ ছেলেকে আনার জন্য বৈধ প্রক্রিয়ার সন্ধান করতে শুরু করলেন তিনি৷ নিজের বিশ্বস্ত ভাতিজা দেলোয়ারকে জানালেন, তার মনে উঁকি দেওয়া স্বপ্নটুকুর কথা৷
২০১৬ সালের শেষের দিকে দেলোয়ার নিজের ছেলে ও চাচাত ভাইকে( খোরশেদ আলমের ছেলেকে) মালয়েশিয়াতে বৈধভাবে আনার জন্য একজন ভালো‘দালালে’র সন্ধান বের করেন৷‘দালাল’ ভদ্রলোকের নাম মামুন৷ দেলোয়ারের দীর্ঘদিনের পরিচিত৷
খোরশেদ আলমের কাছে দালাল মামুনকে নিয়ে আসলো ভাতিজা দেলোয়ার৷ মামুন সাহেবের মিষ্টি কথা আর ভাতিজার জোড় সমর্থনে চাচা রাজি হলেন ছেলেকে বৈধ ভিসা দিয়ে আনবেন মালয়েশিয়াতে৷
মামুন মোট ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে পাসপোট আর ১ লাখ টাকা অগ্রিম দাবি করলেন৷ বৈধ ভিসা দিয়ে ৩ মাস ১৫ দিনে তিনি মালয়েশিয়া আনিয়েদেবেন বলে কথা দিলেন।
দেখতে দেখতে দুইমাস পার হলো।মামুনের কাছে ভিসা সম্পর্কে জানতে চাইলে, উত্তরে মামুন বিভিন্ন অজুহাত দেখায়৷ ৩ মাস হয়ে গেলে মামুন খোরশেদ আলমকে বলেন, চাচা এখন তো কোন বৈধ ভিসা পাচ্ছি না৷ তাহলে টুরিস্ট ভিসায় ৩ দিনে আনতে পারবো৷
খোরশেদ আলম কোনও ভাবেই ছেলেকে ভ্রমণ ভিসায় আনবেনা৷ তখন মামুন বলেন, তাহলে আরো ৩ মাস অপেক্ষা করতে হবে৷ তাতেও খোরশেদ আলম রাজি হলেন৷
হঠাৎ একদিন মামুন ফোন দিয়ে বলেন, চাচা সব টাকা পয়সা রেডি করেন, ভিসা হয়ে গেছে এই সাপ্তাহে ফ্লাইট হবে৷ খোরশেদ আলম অনেক কষ্ট করে সব টাকা রেডি করলেন৷ এখন টাকার পরিমাণ সাড়ে ৩ লাখ টাকা৷
খোরশেদ আলম দেশের জমি বন্ধক রেখে, গয়না বন্ধক দিয়ে ২লাখ১৬হাজার টাকা নগদ দেন।এ নিয়ে মামুনকে মোট দেয়া হলো ৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
মামুন জানালেন, খোরশেদের ছেলে আছে‘রিসিভ ঘর’ নামক একটি ঘরে৷ সেইখানে খোরশেদ আলমের ছেলের মতো আরও ৪৫ থেকে ৫০ জন ছেলে আছে৷ টাকা দেওয়ার পর ১৮ দিন কেটে যায় ছেলের সন্ধান পাওয়া যায় না৷ যখনি কল দেয় ছেলে খুব কান্না-কাটি করেন আর বলে, “আমারে মালয়েশিয়া না এনে মেরে ফেলতেন তাইলে ভাল ছিল৷ খুব মারধর করে এহানে৷”
খোরশেদ আলমের খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা৷ মামুনের কাছে জানতে চাইলে বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছে মামুন৷
এই অবস্থায় খোরশেদ আলম ও দেলোয়ার সবকিছু খুলে বললেন আমার কাছে( লেখক)। আমি এখানে গড়ে তুলেছি শ্রমিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বাংলার নতুন সেনা কেএল”।
সাব্বির ইসলাম সংগঠনটির অন্যতম সংগঠক৷ আমরা দু’জনে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করি৷ সাব্বির ইসলামের নেতৃত্বে সংগঠন থেকে বাছাই করে সাহসী,দেশপ্রেমী ও শ্রমিকবান্ধব ৬ সদস্যের একটি দল ঠিক করি ছেলে দু’টিকে মুক্ত করার জন্য৷
সাব্বির ইসলামসহ আমি টানা চার দিন পরিকল্পনা করে এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আইনের সহযোগিতা নিলে সবাই গ্রেপ্তার হবে৷ আর দালালদের অনেক বেশি ক্ষমতার বলে, তারা ঠিকই বের হয়ে যাবে৷
আটক করতে হবে দালাল মামুনকে৷ আমাদের দলের বাকি সদস্যরা হলেন- রাজবাড়ির ইদ্রিস শেখ,রনি হোসেন, মফিজুল ও ঠিকাদার সুমন৷ সাব্বির ইসলামের নেতৃত্বে অপরেশন শুরু করেইদ্রিস শেখ ও ঠিকাদার সুমন ফাঁদ ফেলেন। তারা মামুনের ফোনে কল দিয়ে লোক আনার লোভনীয় অফার দেন৷
মামুন ৬ দিনপর এক সন্ধ্যায় চলে আসেন দেখা করতে৷ মফিজুল আর রনি মামুনকে আমাদের লক্ষ্যে খোরশেদ আলমের ফ্যাক্টরিতে পৌঁছায়৷সেখানে মামুনের কাছে ঘটনাটি জানতে চাইলে, তিনি সবকিছু স্বীকার করেন৷ পরে ২৮তম দিনে মামুনের কাছে পাসপোর্টসহ ছেলে দু’টি ফেরত চাইলে, মামুন জানান পাসপোর্ট আরেক দালাল ভিসার জন্য অফিসে জমা দিয়েছেন৷
খোরশেদ আলম ও দেলোয়ার তাদের ছেলে দু’টিকে জীবিত ফেরত চান৷ পাসপোর্ট পরে, আগে ভিসা লাগিয়ে দিলে হবে৷ পরদিন সকালেই ‘রিসিভ ঘর’ থেকে ছাড়া পেয়ে বাবার বুকে ছুটে আসে আদরের ছেলে৷
এদিকে ছেলে দুটি ‘রিসিভ ঘরে’ বসে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে বাকিদের সাথে৷ তাদের কাছে খবর নিলে জানা যায়, এক সপ্তাহে ছেলেদের বিভিন্ন জাগায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাসপোর্ট ছাড়াই৷ কেউ পাসপোর্ট হাতে পায়নি, তাদের বিক্রি করা হয়েছে ক্রীতদাসের মতো৷
৩০ জুনের পর খোরশেদ আলম ও তার ছেলে পুলিশের ভয়ে জঙ্গলে অবস্থান করেন সন্ধ্যার পর৷ছেলেকে বৈধভাবে এনেও জঙ্গলে রাত কাটাতে হয় পিতা-পুত্রকে৷ একটাই কারণ, ছেলের পাসপোর্ট নেই৷
মালয়েশিয়ার সরকার অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ হবার সুযোগ করে দিলেও এতোগুলো শ্রমিক কেন অবৈধ! এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আসবে আমাদের দেশের অবৈধ শ্রমিকদের পাসপোর্ট ও টাকা জিম্মি রয়েছে দালালের কাছে৷সমাধানের একমাত্র উপায়, দালালদের দেশে ফেরত নিয়ে আইনের আওতায় নেওয় হোক৷
আমরা সেই দিন জানতাম, বিদেশে এমন কাজটি মোটেও ভালো নয় আমাদের জন্য৷সাব্বির ইসলাম বলেল, আমার বাবা সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সদস্য। বাবা বলতেন, “যারা দেশের জন্য কাজ করেন, তারাই প্রকৃত বীর”। তাই সেই দিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করে একটি রাজাকারের, দালালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলাম৷
আমরা আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিযোদ্ধার বাঁচাতে চাই৷দেশের জন্য কল্যাণ করতে চাই৷সরকারের সহযোগিতা পেলে এই ধরণের স্বাধীনতার চেতনাবাহী কাজ আরো সহজ হবে।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ফেইসবুক পেইজ-
www.facebook.com/bdnewsenakl
ই-মেইল- [email protected]
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |