মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া অসংখ্য শহীদদের স্মরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ ও ভাস্কর্য।
Published : 16 Dec 2014, 04:26 PM
বিজয়ের এই মাসে এসব স্মৃতিময় স্থাপনগুলো দেখে আসতে পারেন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ
রাজধানী থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নবীনগরে নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণউৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।
১৯৮২ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এর স্থপতি সৈয়দ মঈনুল হোসেন। সৌধটির উচ্চতা ১৫০ফুট। সাতজোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সৌধটি। কংক্রিটের এই সাত জোড়া দেয়ালের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি সময়কাল নির্দেশ করা হয়েছে।
মোট ১০৮ একর উঁচু নিচু টিলা আকৃতির জায়গার উপর বিস্তৃত সবুজ ঘাসের গালিচায় আবৃত দেশি বিদেশি গাছের বাগান আর লাল ইটের রাস্তা সমৃদ্ধ এই সৌধ ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে।
স্মৃতিসৌধ চত্বরের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের দশটি গণকবর। আর এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে কৃত্রিম লেইক। জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে কোন প্রবেশ মূল্য লাগে না। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।
জাগ্রত চৌরঙ্গী
ভাস্কর্যটি অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা বলিষ্ঠ এক মুক্তিযোদ্ধার। উচ্চতায় এটি প্রায় একশ ফুট। এর দু’পাশের ফলকে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০৭ জন শহীদ সৈনিকের নাম খোদাই করা আছে।
শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ময়মনসিংহ
সৌধটির চারদিকের চারটি দেয়ালে রয়েছে চার-রকমের প্রাচীরচিত্র। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রামের বিমূর্ত চিত্র।
বিজয় ৭১
ভাস্কর্যটিতে একজন নারী, একজন কৃষক ও একজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি রয়েছে। কৃষক মুক্তিযোদ্ধাটির হাতে বাংলাদেশের পতাকা। পাশেই রাইফেল হাতে বাংলার সংগ্রামী এক নারী দৃঢ় চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের দীপ্ত আহ্বান জানাচ্ছেন। তার পাশে একজন যোদ্ধা ছাত্র গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গিমায় হাতে রাইফেল নিয়ে দণ্ডায়মান।
ভাস্কর্যটির দেয়াল জুড়ে আছে পোড়া মাটিতে খোদাই করা মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাবলি। ২০০০ সালে নির্মিত এ ভাস্কর্যের শিল্পী শ্যামল চৌধুরী।
কামালপুর স্মৃতিসৌধ
এসব শহীদদের স্মরণেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে এ স্মৃতিসৌধ।
সাবাশ বাংলাদেশ
প্রায় চল্লিশ বর্গফুট জায়গার উপরে ভাস্কর্যটি নির্মিত। এই স্মৃতিস্তম্ভে আছে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি। একজন অসম সাহসের প্রতীক, অন্য মুক্তিযোদ্ধার হাত বিজয়ের উল্লাসে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে পতাকার লাল সূর্যের মাঝে। এ দুইজন মুক্তিযোদ্ধার পেছনে আছে ৩৬ ফুট উঁচু একটি দেয়াল। এর উপরের দিকে আছে একটি শূণ্য বৃত্ত, যা দেখতে অনেকটা সূর্যের মতো।
ভাস্কর্যের নিচে ডান ও বামে দুটি দেয়ালে খোদাই করা আছে যুদ্ধের কিছু চিত্র।
স্মৃতি অম্লান
সৌধে মোট তিনটি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে ২৪টি করে ধাপ, ধাপগুলোর বৈশিষ্ট্য হল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আন্দোলনের ক্রমবিবর্তণ ও স্বাধীনতার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের নির্দেশ করা হয়েছে স্তম্ভের গায়ের ৩০টি ছিদ্রের মাধ্যমে। প্রতিটি স্তম্ভে রয়েছে ১০টি করে ছিদ্র। বেদিমূলে রাখা আছে নীল শুভ্র পাথরের আচ্ছাদন, যা দুই লাখ নির্যাতিত নারীর বেদনাময় আর্তির কথা ইঙ্গিত করে।
সৌধের চূড়ায় রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের লালগোলক যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সমাধি
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মহানন্দা নদী অতিক্রম করে শত্রু সৈন্যদের ধ্বংস করার জন্য নবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি শত্রুদের অনেকগুলো দুর্ভেদ্য অবস্থান ধ্বংস করেন। একটি মাত্র শত্রু শিবির ধ্বংস করা বাকি থাকতে মুখোমুখি সংঘর্ষে শত্রুর বুলেটে শহীদ হন তিনি।
১৫ ডিসেম্বর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। সোনা মসজিদের দক্ষিণ পাশেই আছে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতিসৌধ।
সোনা মসজিদ থেকে স্থল বন্দরের দিকে কিছুটা সামনে সড়কের পশ্চিম পাশে আছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গণকবর।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
১৯৭১ সালের এই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল এখানে উদ্বোধন করা হয় এই স্মৃতিসৌধ। এটির নকশা প্রণয়ন করেন স্থপতি তানভীর করিম।
সৌধটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য হল ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের উপর মূল বেদিটি কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চি পুরু ২৩টি দেয়াল রয়েছে। যা উদীয়মান সূর্যের প্রতিকৃতি ধারণ করে। সৌধের ২৩টি স্তম্ভ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের সংগ্রমের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে বসানো হয়েছে ৩০ লাখ পাথর।
অদম্য বাংলা
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক এটি।
একটি উঁচু বেদির উপরে স্থাপিত হয়েছে মূল ভাস্কর্য। বেদীর চারদিকের পোড়া মাটির প্রাচীরচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, জাতীয় চার নেতার প্রতিকৃতি, বধ্যভূমির বর্বরতা ও পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের চিত্র। এটির স্থপতি শিল্পী গোপাল চন্দ্র পাল।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ
তবে ধলই সীমান্তে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিসৌধ। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সৌধটির দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার।
আলোকচিত্র: মুস্তাফিজ মামুন