পূর্ণিমায় এক মেঘের সীমান্ত ধরে নতুন কোনো সূর্যাস্ত দেখার স্বপ্নজাল বোনা শুরু হয়েছিল। অবশেষে বছর দুয়েক পর সেই অধরা পূর্ণ হল। ঠেগামুখ বা থেগামুখ বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা জনপদ। জনপদ বলতে. কেবল একটি বাজার। রয়েছে পাহাড়ি বিশেষ করে চাকমা জাতিগোষ্ঠীর বসতবাড়ি।
Published : 04 May 2018, 03:19 PM
পাহাড় থেকে বয়ে আসা ঠেগা ছড়া। এখানে এসে কর্ণফুলিতে মিলিত হয়েছে। তাই ছড়ার নামেই ঠেগার নামকরণ।
ভারতের মিজোরামের সীমান্ত ঘেঁষা ঠেগা হয়ে বয়ে আসে কর্ণফুলির মূল স্রোত। মিজোরামের ব্লু মাউন্টেইন বা নীল পাহাড়ের (লুসাই পাহাড়) স্রোতধারা এসে মিশেছে বাংলাদেশের ঠেগামুখ সীমান্তে।
নদীর দুপাশে, সীমান্তে, দুই দেশেই চাকমাদের বসতি। তাই সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট। ছোট কর্ণফুলীর দূরত্ব এখানে বাধা হতে পারেনি।
বড়হরিণা, মরা থেগা, থেগাসহ একাধিক সীমান্ত চৌকিতে বিজিবি জোয়ানদের উপস্থিতি। দিন-রাত টহল চলে এখানকার সীমান্ত পাহারা। কর্ণফুলির উজান নদীর মাঝ বরাবর ‘শূন্য রেখা’। ভারত বাংলাদেশের পতাকাবাহী নৌকা চলছে নদীর পথে। বছরের পর বছর ধরে এখানে দু’দেশের মানুষ সীমান্তের বসবাস করছে। তবে ছোট হরিণার পর নিরাপত্তার জন্য বাঙালিদের চলাচল করার অনুমতি নেই।
বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় নৌ বন্দরের তালিকায় রয়েছে ঠেগামুখ। রয়েছে ঠেগামুখের বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। হৃদ আর ছোট পাহাড়ের ঘেঁষা রাঙামাটি। যার বেশ বড় অংশ জুড়ে সংরক্ষিত বন, অনাবিষ্কৃত ঝরনা, অদেখা পাহাড় এবং নৃতাত্ত্বিক মানুষের বসবাস। ঠেগামুখের গন্তব্য এবারের রৌদ্র ঝলমল দিনের হাত ধরে।
রাঙামাটি থেকে শুভলংয়ের বিরতি শেষ করে সরাসরি বরকল যাত্রা। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত ৭৬ কি.লি জলের পথ। এই পথে কেবল অচেনা পাখি, পাহাড় আর জলের মিলনের সুর। বরকল বাজার থেকে ছোট হরিণার পথে রওনা দিতে বিকেল প্রায় ছুঁই ছুঁই। এর আগে লংগদু হয়ে আমাদের যাত্রা হত শুভলং বাজার। সেখান থেকে দুপুর আড়াইটায় বরকলের শেষ লঞ্চ ধরতে হত। বরকল হয়ে হরিণা যেতে সময় লাগবে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। এবার লেকের পানি কমে যাওয়ায় রাঙামাটি থেকেই সরাসরি কান্ট্রি বোটে বরকল ।
পাহাড়ের কোলে জুমঘর। মেঘের ছায়ায় ঢেকে আছে গ্রামগুলো। কাশবন ঘেঁষা পাহাড়ের কোলজুড়ে রংধনুর রেখা, সবুজ পাহাড়কে যেন আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। শেষ বিকেলের শান্ত জলপথ। সন্ধ্যার সোনালি উজ্জ্বল আকাশ! এ যেন পূর্ণিমার আলোয় ডুবে থাকা নীরব-নিঝুম পাহাড়। কর্নফুলির দুধারে এমন নিরবিচ্ছিন্ন পাহাড়ের সারি আর কোথাও বোধহয় পাওয়া যাবে না। তবে লেকের পানি কম হওয়ায় কোথাও কোথাও আটকে যায় বোটের তলানি।
ক্যাম্পের ভেতরে বাঁশ দিয়ে সাজানো দারুণ শৈলির বৈঠকখানা। সেই দীর্ঘ নৌযাত্রার পর অসাধারণ সন্ধ্যার ভোজ। এত দুর্গমেও অসাধারণ খাবারের স্বাদ।
ক্যাম্প থেকে বিদায় নিয়ে বাজার দিকে রওনা হলাম আমাদের রাতের থাকার জায়গা। পাহাড় আর নদী ঘেঁষা ছোট হরিণা বাজার। ধবধবে জোছনায় আলোকিত পুরো সীমান্ত। নদীর জলে ধুয়ে যাচ্ছে চাঁদের আলো। কি মুগ্ধ করা রাত! পাহাড় ঘেঁষে থাকা চাঁদের আলোয় রূপালি জলের ধারা। তীব্র স্রোতে ভেসে যাওয়ার এই তো সময়।
পাহাড়ে ভাঁজে ভাঁজে পাহাড়িদের বসতি। বড় হরিণা ক্যাম্পে ক্ষণিকের বিরতি। ক্যাম্পের উল্টোদিকে জিরা’র খামার। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর দেখা মেলে মিজোরাম সীমান্ত।
বিএসএফ এর নিরাপত্তা চৌকি। সুদূরে উঁচু পাহাড়ের সীমানা। পথে পথে মিজোদের যাতায়াত। কর্ণফুলির পাড় ঘেঁষে অচেনা মিজো গ্রামের নান্দনিক বসতবাড়ি। ওপারে সীমান্তে মেলে নাগরিক জীবনের সকল সুবিধা। মিজোরামে পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ সবই আছে। কোথাও কোথাও ভারতীয় পতাকাবাহী নৌকায় মিজোদের যাতায়াত।
ঠেগামুখ বাজারে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। বাজারটা সরকারিকরণ হয় ২০০৩ সালে। সব মিলিয়ে ১৫-২০টি দোকান। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার বাজার বসে। সেদিন দূর-দূরান্তের বাসিন্দারা বাজারে এসে মিলিত হয়। দুই দেশের মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম থাকে বাজার।
দোকানদার রুমা চাকমা (৩২) জানান, “আট বছর ধরে এখানে দোকান করছি। ভালোই বেঁচাকেনা হয়। সীমান্ত কাছের হওয়ায় বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য থাকে।”
আরও বলেন, “দুই পাড়ের মানুষের সাথে আত্মীয়তার সর্ম্পক রয়েছে। ঠেগামুখ বাজারে নিত্য পণ্য কিনে আবার ফিরে যাচ্ছে মিজোরামে নাগরিকেরা। বছরে পর বছর এখানে এভাবে চলে লেনদেন।”
প্রয়োজনীয় তথ্য
জলযানে রাঙামাটি থেকে বরকল। সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। বরকল থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ ছোট হরিণা। তবে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় সময় আরও বেশি লাগতে পারে।
প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে ০১৮১৫-৮৫৬৪৯৭ নম্বরে ফোন করতে পারেন।