আশ্বিন শেষ হতে চললো। তারপরও কাশফুলে ভরা যৌবন, আকাশে শারদীয় মেঘ। চেনা চেনা প্রকৃতি, তাও দৃশ্যপট মনমুগ্ধকর। এই সময়ে শুভ্রতায় মাখামাখি করতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন পদ্মায়।
Published : 05 Oct 2017, 02:45 PM
শরতের বৃষ্টি আমাদের কাশফুল দেখার আকাঙ্ক্ষা ভুলিয়ে দিতে পারেনি। তাই একদিন দলবল নিয়ে পদ্মার চরে কাশবন উপভোগের আশায় শহর ছাড়লাম।
এর আগে গাবতলী, আমিনবাজার, শালিপুর, হেমায়েতপুর হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একদিন ঘুরে এলাম, গেলাম বুড়িগঙ্গা পারের ঝিলমিল প্রজেক্টে, আর একদিন ঘুরে এলাম দিয়াবাড়ি।
চারিদিকে কাশবনের শোভা আর হেলিয়া-দুলিয়া নৃত্য দেখে চোখ-মুখে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। আসলে এমন শরত, সাদা পালকের মতো কাশফুলের সমারোহ, সোনারঙা রোদ্দুর আর পেঁজো তুলোর মতো হালকা হাওয়ায় ভাসা মেঘের চোখ জুড়ানো সম্মিলন দেখে যে কারও চোখ জুঁড়িয়ে যেতে বাধ্য।
আগে থেকেই বলা ছিল হাদিরাতুল জান্নাত, রোজি, ফাহিম, সম্রাট, মোহম্মদ আলী, হাসিবুলসহ জনাদশেক বন্ধুকে। এভাবেই গত মাসের শেষ দিন আমাদের পদ্মাপারের কাশবনের দিকে ছুটে চলা। আমরা বুড়িগঙ্গা আর ধলেশ্বরী জোড়া ব্রিজ হয়ে পদ্মাপারের ভাগ্যকূল গ্রামে পৌঁছি সকাল সাড়ে নয়টায়।
আমাদের নিয়ে এগিয়ে চললো শিবচর আর চর জানাজাতের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকৃতির মনোভাবে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এখন দিগন্তজোড়া চনমনে রোদ, আকাশে ভাসছে সাদা মেঘ। তবে বিশাল পদ্মা নির্বিকার। কেমন হতশ্রী আর রুক্ষ তার রূপ। নদীতে দেখা পেলাম না কোনো মাছ ধরার নৌকা।
গতবছর এই সময় পদ্মায় ঘুরে গেছি। পদ্মার প্রমত্তা রূপ দেখেছি। কত্ত সব মাছের নৌকা। অবাক হয়ে দেখলাম এবার, পদ্মার এখানে সেখানে চর পড়েছে। সেজন্য সোজা পথে না গিয়ে ট্রলার অনেকটা পথ ঘুরে যাচ্ছে।
এভাবেই প্রথমকাশ ফুল দেখা হয়ে যায়। পরিমাণে অল্প হলেও, সদ্য জেগে ওঠা ছোট্ট সে চরে সাদা কাশফুল খেলা করছে বাতাসের তালে।
নৌকার মাঝি খোকনের ভাষায়, “নদী চর জানাজাতের এই অংশের প্রায় দুইমাইল খেয়ে ফেলেছে।”
আমরা এখানে নামতেই বৃষ্টি হানা দিল। ২০ মিনিট বৃষ্টি মাথায় পায়ে হেঁটে চলে এলাম যেখানে সেটি একটি বাজার। চা পাওয়া গেল না।
দোকানির কাছে চা না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি লম্বা বক্তৃতা শুরু করলেন।
দোকানির হাহাকারের সঙ্গে আমাদের মনেও হাহাকার শুরু হয়েছে। কারণ তখন পর্যন্ত আমরা কাঙ্ক্ষিত কাশবনের দেখা পাইনি।
এখানে আমরা হালকা নাস্তা করে আবার নৌকায় চড়ে বসি। এভাবে চলে আধাঘণ্টা। এরমধ্যে দেখা হয় দুই-একটা জেলে নৌকার।
আমি চিৎকার করে জেলেদের কাছে জানতে চাই- “মাছ আছে নি ভাই।”
পদ্মার প্রেম আসলে এমনি, ভাবতে ভাবতে দেখি খোকন নৌকা পাশের চরে ঘাট করতে বলছে। এটা গোবরগন্ড, চর জানাজাতের আরেক অংশ, যা দেখে আমাদের সবার চোখ ছানাবড়া। চকচকে নতুন টাকার মতো বা লম্বা সোনালি বর্শার মতো রোদ্দুর পুরো চরে খেলা করছে, তার সে খেলার সঙ্গী লম্বা সব কাশফুল। তারমানে আমরা কাশবনে এসে গেছি!
ট্রলার চরে ভিড়তেই, ধুপধাপ সবাই নেমে পড়লো। তারপরের অনুভূতি যা হল তা লিখে বা ভাষায় প্রকাশের নয়।
জান্নাতের কাশবনে ছোটাছুটির মধ্যে আমার ক্যামেরা সচল হল। ক্যামেরা তখন ধরছে ছবি। শুধু কী ছবি নাকি ক্যামেরায় তৈরি হচ্ছে একেকটি কবিতা, একেকটি গল্প! সেই কবিতা বা গল্প কাশফুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার, গাল ছুঁয়ে যাওয়ার।
আমরা চর জানাজাতের গোবরগন্ড পাড়ের কাশবনে একঘণ্টা ছিলাম, অসাধারণ সে সময় পার করে পদ্মার জলে আবার নৌকা ভাসাই। এভাবেই আধা ঘণ্টা পর নামজানা একচরে কাশফুলের মেলা দেখে আবার সে চরে নেমে পরি।
সবাইকে তাড়া দিলাম পানি থেকে ডাঙ্গা বা নৌকায় চড়তে। আমরা চড়ে বসতেই মাঝি নৌকা ভাসালো সেই পদ্মার জলে। এভাবেই কাশফুলের শুভ্রতা নিয়ে আমাদের ফিরতি পথ ধরা। পদ্মার বুকে সন্ধ্যা এল, আবীর জমলো আকাশে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
পদ্মায় বেড়ানোর মজাই আলাদা। সঙ্গে কাশফুল সে ভালো লাগার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে বহুগুন। মন চাইলে এ সময় ঘুরে আসতে পারেন পদ্মা নদীতে।
পদ্মার চরে যেতে হলে আপনাকে যেতে হবে শ্রীনগরের ভাগ্যকূল বাজার। ঢাকার গুলিস্তান থেকে শ্রীনগরগামী আরাম বা মহানগর বাসে চেপে বালাসুর বাজারে নেমে পড়ুন। এখান থেকে পায়ে হেঁটে বা রিকশায় ভাগ্যকূল বাজার। তারপর ট্রলার ভাড়া করে ঘোরাঘুরি। এভাবেই পদ্মার বুকের চর জানাজাত ভূমিহীন বা নতুন কোনো চরে অনেকটা সময় কাটাতে পারেন। দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে পারবেন।
পদ্মার পাড়ে হোটেল বা খাবার পাওয়ার আশা না করে ভাগ্যকুল বাজার থেকে হালকা খাবার ও পানিজাতীয় কিছু কিনে তবেই নৌকায় উঠবেন।
ভাগ্যকূল বাজারে খাবারের অর্ডার দিয়ে যাবেন। যখনই ফিরবেন প্রচণ্ড ক্ষুধায় পেট মোচড়াবে। খাবার খেয়ে ভাগ্যকুল বাজারের চিত্তরঞ্জন সুইটমিটে অবশ্যই ঢুঁ মারবেন। এখানকার দই, মিষ্টি, সন্দেশ, বরফি আর ঘোল সেরা। খেয়ে আসুন সঙ্গে নিয়েও আসুন।
ছবি: লেখক।