এক গ্রামে থাকতো ছোট্ট এক মেয়ে, সে ছিলো খুব সুন্দর। তার নাম ক্যারেন। পুরো গ্রীষ্মে সে খালি পায়ে হাঁটতো, কারণ সে ছিলো গরিব। আর শীতে সে কাঠের জুতো পরতো, আর সেই খটখটে জুতো পরে তার তুলতুলে পা ব্যাথায় ফুলে উঠতো।
Published : 10 Apr 2018, 07:02 PM
গ্রামের মধ্যে এক বুড়ি থাকতেন, তিনি ছিলেন কাপড়ের জুতো বানানোর দর্জি। একদিন ক্যারেনকে দেখে তার খুব মায়া হলো। তিনি ক্যারেনকে সঙ্গে করে তার বাড়ি নিয়ে এলেন ও নিজের মেয়ের মতোই আদর-যত্ন করতে লাগলেন। লাল কাপড়ের টুকরো কাচি দিয়ে কেটে সেলাই মেশিনে সেলাই করে তিনি ক্যারেনকে দুটো জুতো বানিয়ে দিলেন।
আরও একটু বড় হয়ে ক্যারেন একদিন তার প্রিয় লাল জুতো পরে বুড়ির সঙ্গে গির্জায় গেলো প্রার্থনা করতে। প্রার্থনা করতে করতে ক্যারেন বারবার তার জুতোর দিকেই তাকাচ্ছিলো, জুতোজোড়া ছিলো সত্যি খুব সুন্দর।
প্রার্থনা শেষে বুড়ি ক্যারেনকে একটু বকা দিলেন, বললেন- ‘গির্জার ভেতর জুতো পরে আসা ঠিক নয়।’ পরের রোববারেও গির্জায় অনুষ্ঠানে ক্যারেন তার লাল জুতো পরে গেলো। এবারো প্রার্থনার পুরো সময়টা ক্যারেন তাকে দেখতে কেমন লাগছে শুধু সেসব নিয়েই ভাবতে লাগলো।
তারপর গির্জা থেকে বের হয়ে আসার সময় ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এক মোটা মহিলা। তিনি ঘোড়ার গাড়ি থেকে ক্যারেনকে দেখতে পেলেন ও তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন। বললেন, ‘এই মেয়েটি তো দেখছি ভারি সুন্দর, একে আমি সঙ্গে নিয়ে যাবো।’ মোটা মহিলার সঙ্গে চললো ক্যারেন।
ক্যারেন বুঝতে পারলো, সে লাল জুতো পরেছিলো বলেই তাকে সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে, পায়ের পাতায় জুতোজোড়া চকচক করছিলো। কিন্তু মোটা মহিলা বললেন- জুতোগুলো খুব বিচ্ছিরি, ওগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা উচিৎ। কিন্তু ক্যারেন খুব সুন্দর জামা-কাপড় পরেছিলো। লোকজন বলছে, ‘ক্যারেন তুমি অনেক সুন্দর।’ কিন্তু ক্যারেন যখন তার আয়নার সামনে দাঁড়ায় তখন আয়না বলে ওঠে, ‘লোকজন যতটুকু বলে তুমি তার চেয়েও সুন্দর।’
আরেকদিন ক্যারেন বুড়ির সঙ্গে গির্জায় গেলো। সবাই যখন প্রার্থনা করছিলো তখন ক্যারেন হাঁটু পর্যন্ত মাথা ঝুঁকিয়ে তার জুতো দেখছিলো। সে প্রার্থনা করতে ভুলেই গেলো। বুড়ির সঙ্গে গির্জা থেকে ক্যারেন যখন বেরিয়ে এলো তখন লাল দাড়িওয়ালা এক সৈনিক তার পায়ের দিকে তাকালো, বললো- ‘বাহ! কি সুন্দর জুতো, যেন পা দুটো নাচছে।’ এই কথা শুনে ক্যারেন তার ছোট্ট পা দুটো একটু নাচের মতো দোলালো।
কিন্তু একবার দোলানোর পর ক্যারেন তার জুতো দুটোকে যেন থামাতে পারছে না। জুতো দুটো নিজের মতো নেচেই যাচ্ছে। ক্যারেন চেষ্টা করছে থামাতে, কিন্তু লাল জুতো নেচেই যাচ্ছে। ক্যারেন যতোই থামতে চায় তার জুতোগুলো আপনা আপনি জীবন্ত হয়ে ওঠে। যখন তারা গির্জা থেকে গাড়িয়ে উঠে তখনো জুতোগুলো নাচানাচি করছিলো।
ভয়ে ক্যারেন তার পা থেকে জুতো খুলে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু জুতোগুলো তার পায়ের সঙ্গে পুরোপুরি আটকে যায়। মাঠে, ঝোপে, বৃষ্টিতে, রোদে, বনে নাচতেই থাকে, নাচতেই থাকে। ক্যারেন আকাশে গাছের আড়ালে দেখলো পেলো চাঁদ। কিন্তু সেটা চাঁদ ছিলো না, ছিলো ওই লাল দাড়িওয়ালা সৈনিকের মুখ। সে ক্যারেনের পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো- ‘বাহ! খুব সুন্দর জুতো।’
তখনো নাচ বন্ধ হয়নি। নেচে নেচে সে একদিন গোরস্থানে চলে গেলো। সেখানে ক্যারেন একটি ডানাওয়ালা পরি দেখতে পায়। পরি তাকে বলে, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমাকে নেচে যেতে হবে। তুমি নাচতে থাকবে, তোমার শরীরে যখন শুধু হাড় ছাড়া আর কিছুই থাকবে না তখনো নাচ বন্ধ হবে না।’
ক্যারেন নাচতে থাকে। তার পায়ের চামড়া ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। তবু পাহাড়, মরুভুমি ও কাঁটাওয়ালা ঝোপঝাড়ে অবিরাম নেচে যায়। বিরক্ত হয়ে অবশেষে ক্যারেন একজন কসাইয়ের কাছে এসে তার পা কেটে ফেলতে অনুরোধ করে, যেন সে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।
কসাই ক্যারেনের ইচ্ছা অনুয়ায়ী কাজটি করলো। কিন্তু তার শরীর থেকে আলাদা হয়েও পায়ের সঙ্গে জুতোগুলো তখনো নেচে চলছিল। ক্যারেন কসাইয়ের হাতে একটা চুমু দিলো, যে হাত দিয়ে লোকটি ক্যারেনের পা কেটে দিয়েছে। কসাই তাকে কাঠ দিয়ে বানানো ছোট পা ও একজোড়া ক্রাচ বানিয়ে দিলো।
ক্যারেন আবার একদিন গির্জায় যায়। কিন্তু যখনই সে গির্জায় যায়, তার লাল জুতাজোড়া সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর গির্জার দরজার সামনে নাচতে থাকে। তখন ডানাওয়ালা পরি আবার ক্যারেনের কাছে আসে। সে ক্যারেনের কান্না দেখে তার ছোট ঘরটিকে একটি গির্জা বানিয়ে দেয়, যাতে সে প্রার্থনা করতে পারে। ক্যারেন এতে খুশি হয় আর তার হৃদয় ভরে ওঠে সূর্যালোকে।
অনুবাদকের কথা: ডেনমার্কের কবি ও লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন (১৮০৫-১৮৭৫)। ১৮৪৫ সালে ড্যানিশ ভাষায় ডেনমার্কের রূপকথার এ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। অ্যান্ডারসন দুটো কারণে বিখ্যাত- তার লেখা রূপকথা ও ভ্রমণ ডায়েরি।