Published : 13 Jun 2020, 05:10 PM
‘মেয়েরা ভয়ঙ্কর!’
‘রেগে গেলে অগ্নিসম!’
‘মেয়েরা মেয়েদের শত্রু!’
এমন কত কথা প্রচলিত আছে। ছেলেরাও নিজেরা যখন অন্যকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলে, তখন এমনও বলা হয়- মেয়েদের মতো কর কেন?
কিছু কথা এমনভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেন মেয়েরাই সেটা করে। তাই গালিও মেয়ে দিয়ে.. সেই দীর্ঘ আলাপে না গিয়ে ম্যালেফিসেন্ট নিয়েই গল্প করা যাক।
গল্পের শুরু অরণ্যের রাজকন্যাকে নিয়ে। তার আছে দুটো পাখা। অরণ্যকে বশ করার ক্ষমতা এবং অপরূপ সৌন্দর্য। তার নাম ম্যালেফিসেন্ট । প্রতিটা মানুষের মাঝেই আছে সুর-অসুর। তা কবি বলুক বা ব্যবসায়ী। খল বলুক বা নায়ক। আসলেই আছে। কারণ যে খল সেও তো মানুষই। নারীর মাঝেও দূর্গা আর কালীর সহাবস্থান নিয়ে আলাপ- সংলাপ বা সাহিত্যের অন্ত নেই।
ম্যালেফিসেন্ট ছবিটিকে অ্যাঞ্জিলিনা জোলির চরিত্রটি বড় হয়েছে দূর্গা রূপেই। পাখাটা কালো হলেও স্বর্নালি হাসি আর ঢেউ তোলা চুল দেখে কে বলবে এই মেয়েটি কাঁদবে?
মেয়েটি কেঁদেছিল বটে। কাঁদিয়েছিল একজন। ছেলেবেলার হঠাৎ দেখা – সত্যি ভালোবাসার আশায় দেওয়া চুমু আর জড়িয়ে ধরার মানুষটির কারণে।
সেই মানুষটি ফিরে আসে। কারণ এই পাখাওয়ালা ‘নারীরূপী’ পৃথিবীর চোখে অসুর তার রাজ্যকে প্রতিহত করেছে অরণ্য উজার করতে। নারীরা যেভাবে সর্বশক্তি দিয়ে সর্বরূপে বিরাজ হয়ে নিজের পৃথিবীকে সামলায়- ম্যালেফিসেন্ট ও তাই করেছিল। আর তাতেই যে হল – সিনেমার ডাইনি।
ছেলেটি ফিরে আসে অরণ্যে। ভালোবাসে। আর কেটে নেয় ম্যালেফিসেন্ট -এর পাখা।
ম্যালেফিসেন্ট কাঁদে। চিৎকার করে কাঁদে। আর সেই ভালোবাসার মানুষটি কাটা পাখা নিয়ে চলে যায় রাজ্যের রাজা হতে। নারীর পাখার বিনিময়ে ভালোবাসার বিশ্বাসের দামে সে হয় শক্তিশালী রাজা। আর নারীর পাখাকে করে রাখে বন্দী। নারীকে করে ফেলে চীর অবাঞ্ছিত – রাজ্যের চোখে।
কিছু মিলছে বন্ধুরা? কত নারীর পাখা এভাবে কাটা গেছে - কারও সঙ্গে কী গল্প মেলে?
আচ্ছা, সিনেমার গল্পে ফিরি।
এরপর ম্যালেফিসেন্ট আঘাতে রুক্ষ হয়। রাগে অদম্য। ভালোবাসায় হেরে ঘৃণায় সিক্ত হয়ে রাজার মেয়েকে দেয় অভিশাপ। সত্যিকারের ভালোবাসা না মিললে ষোল বছর বাদে সে আর ঘুম থেকে উঠবে না।
কিন্তু আবার এই ‘দুষ্টু’ নারীই নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রেমিকের কন্যাকে দেখে শুনে রাখে। মুখে বলে ‘বিস্টি’- ‘আই হেইট ইউ’ কিন্তু ভালোবাসার অরণ্যের ছায়া দিয়ে ধরে রাখে প্রেমিকের মেয়েকে। এই সন্তান তারও তো হতে পারতো।
কিন্তু নারী ভালোবাসা দেখালেই দুর্বল- পাখা কাটার সেই ব্যাথা ম্যালেফিসেন্টকে বাধা দেয় অরোরার কাছে আসতে।
কিন্তু অভিশাপ ফলে। অরোরা ঘুমায়। কোনো রাজপুত্র তার ঘুম ভাঙাতে পারে না। রাজাও বলে- পৃথিবীতে সত্যিকারের ভালোবাসা বলে কিছু নেই।
আর তার পরেই ম্যালেফিসেন্ট-এর চুমুতে জেগে ওঠে রাজকন্যা অরোরা। সত্যিকারের ভালোবাসার স্পর্শে।
কিন্তু আবার নারীর কাছে হারবে রাজা? এ কী করে হয়। রাজা সর্ব শক্তি দিয়ে ম্যালেফিসেন্টকে মারতে চায়। অরোরা তখন পাখা মুক্ত করে শক্তিশালী করে তোলে আবার ম্যালিকে।
এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটি দেখা যায়।
রাজা ম্যালেফিসেন্ট-এর পায়ে শেকল জড়িয়ে বলে মারো ওকে। তখন ম্যালেফিসেন্ট পাখা পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে পায়ের বাধন থাকা স্বত্বেও প্রাসাদ ভেঙে বের হয়। রাজাকেও মুক্ত করতে চায়।
কিন্তু রাজা তাকে মেরেই ফেলতে চায়। অবশেষে রাজার মৃত্যু।
ম্যালেফিসেন্টর মুক্তি আর অরোরার ঘরে ফিরে আসা।
সহজ একটি রাজকন্যার গল্পে নারীর বাধা- ক্রোধ আর ভালোবাসার যে বয়ান তা কতটুকু সফল কে জানে। কিন্তু আসলেই নারীর কাছে জয় পরাজয় কোনো বিষয় নয়। যদি ভালোবাসা থাকে। থাকে একটু মায়া। সে প্রতারক প্রেমিকের সন্তানের কাছ থেকে হোক বা অরন্যের বোবা গাছই হোক।
পাখাওয়ালা নারী মানে যদি আত্মনির্ভরশীল নারীর রূপ হয়- সে তো সমাজের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। পাখা তো কেটে নেবেই – তাকে সমাজের চোখে খারাপও প্রমাণ করবে। আর সেটা শুধু মেয়েরা করে না। নারী-পুরুষ মিলে নারীর কণ্ঠকে – পাখাকে দাবিয়ে রাখার প্রচলন বহু পুরানো। এজন্যই অনেক বাস্তব প্রেক্ষাপটেও দেখা গেছে লম্পট রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে আবারও মসনদে বসানো হয়- আর কালো তালিকায় থাকে তার লালসার শিকার হওয়া নারী।
ম্যালেফিসেন্ট এমনই ভালোবাসার ‘শিকার’ হওয়া এক নারী। যে কি-না গল্প বলেই হয়ত পাখা ফেরত পেয়েছে। আর পেয়েছে ভালোবাসার মানুষকে।
আর বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার তা হল সত্যিকারের ভালোবাসার চুমুই। সেটা যে রূপেই আসুক।
১৯৫৯ সালে ফরাসি লেখক চার্লস পেরোর ‘দ্য স্লিপিং বিউটি’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল ‘স্লিপিং বিউটি’ ছবিটি। ৫৫ বছর পর ২০১৪ সালে দর্শকদের সামনে আসে এর রিমেক চলচ্চিত্র ‘ম্যালেফিসেন্ট’।
সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এবং প্রিন্সেস আরোরা চরিত্রে দেখা গেছে এল ফ্যানিংকে।
২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর মুক্তি পায় এর সিক্যুয়েল ‘ম্যালেফিসেন্ট: মিসট্রেস অব ইভিল’ । সে গল্প আরেকদিন!