এই মাঠেই অনুশীলন করে আর খেলে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে নিজেদের মেলে ধরেছেন ক্রিকেটার আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, তামিম ইকবাল, নাফিস ইকবাল, আফতাব আহমেদ, নাজিম উদ্দিন, ফুটবলার আশীষ ভদ্রসহ অনেকেই।
Published : 01 Sep 2020, 11:54 AM
চট্টগ্রামে খেলোয়াড় তৈরির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এমএ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন আউটার স্টেডিয়ামটির সেই সোনাঝরা দিন আর নেই। আশপাশে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও উপেক্ষিত এই মাঠ। অযত্ন-অবহেলায় মাঠে এখন হাঁটারও জো নেই।
আউটার স্টেডিয়ামের মতো দশা নগরীর পলোগ্রাউন্ড ও প্যারেড মাঠেরও। বছরের বেশিরভাগ সময় মেলা, নানা অনুষ্ঠানের পর যে সময়টুকু মাঠগুলো ফাঁকা থাকে, তখন আর সেখানে খেলাধুলা করার মতো অবস্থা থাকে না।
নগরীর প্রধান এই তিনটি মাঠে খেলাধুলার সুযোগ কমতে থাকায় জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করার মতো খেলোয়াড়ও ইদানিং উঠে আসছে না চট্টগ্রাম থেকে।
এ মাঠ দেখভালের দায়িত্বে আছে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস), যার সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সদ্য বিদায়ী মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।
২০১১ সালে সিজেকেএসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আউটার স্টেডিয়াম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। টানা তিন দফায় নয় বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন নাছির, ছিলেন চট্টগ্রামের সিটি মেয়র।
মাঠের এক পাশে সুইমিং পুল, অন্য পাশে মুক্তমঞ্চ করা হয়েছে। আশপাশে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হলেও মাঠ আর খেলাধুলার উপোযোগী নেই।
স্বাভাবিক সময়ে এই মাঠ বছরের কয়েক মাস দখলে থাকে বিভিন্ন মেলার। আর মহামারীর এই সময়ে মাঠে মেলা না থাকলেও ময়লা কাদা-পানি আর বড় বড় ঘাস দখল করে রেখেছে মাঠটি।
শনিবার মাঠের পশ্চিম কোণে নেটে ক্রিকেট অনুশীলন করছিলেন কয়েকজন ক্ষুদে ক্রিকেটার। কথা হয় তাদের সাথে।
তারা জানান, মাঠে এখন আর অনুশীলন করা যায় না। ময়লা পানি থেকে রোগ সংক্রমণের ভয়ও কাজ করে তাদের মনে।
মো. সাদেক নামের একজন ক্রিকেটার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মাঠে জমে থাকা পানি পচে গেছে। সেখানে বল পড়লেই নষ্ট হয়ে যায়।
ইসতিয়াক আজাদ আকিব নামের আরেকজন বললেন, “আগে মাঠে মেলা হত। সে কারণে অনুশীলন করা যেত না। এখন মেলা নেই। কিন্তু বৃষ্টির কারণে পানি জমে আছে। মাঠের এক পাশে নেটে ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলন করা গেলেও ফিল্ডিং করতে পারি না।”
কাজীর দেউড়ি এলাকার এই আউটার স্টেডিয়ামে বছর কয়েক আগেও হতো দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল, বয়সভিত্তিক এবং বিভিন্ন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। চলত বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমি এবং ফুটবল দলের অনুশীলন।
এছাড়া আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বয়সী মানুষ সকাল-বিকাল এই মাঠে খেলতে আসতেন ক্রিকেট, ফুটবল। তবে এখন আর কেউ আসেন না।
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আউটার স্টেডিয়াম সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ঠিকাদার নিয়োগ করা আছে আগে থেকে। ‘গ্রো-ইন ডিজাইন’ অনুযায়ী সেখানে ‘ওয়াকওয়েসহ’ মাঠ হবে।
এর প্রক্রিয়া চলছে দাবি করে তিনি বলেন, “মুক্তমঞ্চ তৈরির সময় থেকেই কাজ শুরু হয়েছে।”
আউটার স্টেডিয়ামের মতেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বাইরের ক্রিকেট অনুশীলনের নেটটি। এখন সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়ি রাখা হয়। অভিযোগ আছে, নেটে এখন অনুশীলন করতে দেয়া হয় না।
চট্টগ্রামের ক্রিকেট প্রশিক্ষক ও ক্রীড়া সাংবাদিক সাইফুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “এই নেটটি একমাত্র অনুশীলন নেট। জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট দলের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমির শতাধিক খেলোয়াড় এই নেটে অনুশীলন করেন।
“লকডাউন ওঠার পর ক্রীড়াঙ্গন স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এই নেটে কেউ অনুশীলন করতে পারে না। তালাবন্ধ করে রাখা হয়। এখানে খেলোয়াড়দের প্রবেশ করতে দেয় না, অথচ একটি প্রতিষ্ঠানকে গাড়ি রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
এ বিষয়ে সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক নাছির বলেন, “খেলাধুলা এখন বন্ধ থাকায় কভিড-১৯ রোগীদের দাফন ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আল মানহিল ফাউন্ডেশনের কর্মীরা ওখানে একটি ভবনে থাকেন। আগে তারা পর্যটন করপোরেশনের হোটেলে থাকতেন। এখন তাদের কোনো থাকার ব্যবস্থা না থাকায় এখানে থাকার ব্যবস্থা করেছি।”
তবে মাঠে গাড়ি রাখার বিষয়ে বলার পর তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “সেখানে গাড়ি রাখতে নিষেধ করেছি। গাড়ি রাখার কথা না। তারপরও যদি রাখে তাহলে সেটা উচিত হয়নি। রাখলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সাবেক মেয়র বলেন, “ক্রীড়া মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে খেলাধুলা করার অনুমতি দিয়েছে। সে হিসেবে ১ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ক্লাব প্রতিনিধিদের মিটিং আছে। খেলাধুলা শুরু হলে নেটটিতে আবার অনুশীলন করা যাবে।”
টাইগারপাস এলাকার এই মাঠটি বছরের অর্ধেক সময় জুড়ে থাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ বিভিন্ন মেলার জন্য বরাদ্দ। ফলে এখানেও খেলাধুলা হয় না বললেই চলে।
এ বছর মহামারীর কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। কিন্তু রেলওয়ের মালিকানাধীন মাঠটিতে এখনও পড়ে আছে স্টলের কাঠ-পাথর, পেরেক। এসবের মধ্যে ঝুঁকি নিয়েই অনুশীলন করেন ক্যাপ্টেন ক্রিকেট একাডেমির খেলোয়াড়রা।
একাডেমির কোচ মো. কামরুজ্জামান বলেন, মেলা শেষে মাঠ সাফসুতরো না করায় অনুশীলনের সময় দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে।
আরেকজন প্রশিক্ষক ফজলুল করিম লিটন বলেন, “চট্টগ্রামে সবসময়ই মাঠ সঙ্কট থাকে। যেগুলো আছে তাতেও থাকে মেলা। এ কারণে মাঠের অভাবে অনুশীলনে অনেক সমস্যা হয় খেলোয়াড়দের।”
অনুশীলনের অভাবে অনেক খেলোয়াড় হারিয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
এ মাঠের বিষয়ে রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম কলেজের মাঠটি প্যারেড মাঠ হিসেবেই বেশি পরিচিত নগরবাসীর কাছে। এই মাঠও একসময় নানা বয়সী মানুষের আনাগোনায় আর খেলাধুলায় সরগরম থাকত, এখন আছে অযত্ন-অবহেলায়।
করোনাভাইরাসের মহামারী শুরুর পর চকবাজারের কাঁচা বাজারকে এই মাঠে স্থানান্তর করেছিল পুলিশ। পরে ব্যবসায়ীরা তাদের পুরনো জায়গায় ফিরে গেলেও মাঠটি আর খেলার উপযোগী করা হয়নি।
ক্রিকেট প্রশিক্ষক সাইফুল্লাহ জানান, এই প্যারেড মাঠেও এক সময় ক্রিকেট, ফুটবলসহ বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্ট হতো। অনেক জাতীয় ক্রিকেটার এই মাঠে এক সময় খেলেছেন। কিন্তু অযত্ন আর অবহেলায় এ মাঠটিও খেলার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, বাজারের যেসব অস্থায়ী স্থাপনা এখনও মাঠে আছে, সেগুলো সরানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।
সার্বিকভাবে মাঠের অবস্থা ‘ভালো’ আছে দাবি করে তিনি বলেন, “এই মাঠে অনেকেই খেলতে আসে…কেউ ফুটবল, কেউ ক্রিকেট। ফলে গোলপোস্ট, ক্রিকেট স্ট্যাম্প বসানোর কারণে এখানে-ওখানে কিছু গর্ত আছে, সেসব সংস্কার করা হবে। তবে মাঠটি বেশ বড়, ফলে খেলার মতো জায়গা মাঠের অন্যান্য দিকে আরও আছে।”