চট্টগ্রাম নগরীর ফয়’স লেক সংলগ্ন উত্তর পাহাড়তলি ও খুলশী এলাকায় রেলওয়ের ৫০ একরের বেশি পাহাড়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
Published : 21 Jul 2020, 11:40 PM
বর্ষা মৌসুমে টানা কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের ঝুঁকি তৈরি হলেও তাদের সরাতে পারছে না প্রশাসন। এর কারণ হিসেবে সেখানে উচ্ছেদ অভিযানে উচ্চ আদালতের ‘স্থগিতাদেশ থাকার’ কথা বলছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও পরিবেশ অধিদপ্তর।
এই অবস্থায় টানা তিন দিন ধরে বন্দর নগরীতে বৃষ্টির পর মঙ্গলবার ওই এলাকাগুলো থেকে লোকজনকে সরে যেতে সতর্কতামূলক মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন।
২০০৭ সালের ১১ জুন টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় ও দেয়াল ধসে এবং মাটি চাপায় মৃত্যু হয়েছিল ১২৭ জনের। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
নগরীর আকবর শাহ থানার ফয়’স লেকের হ্রদটির পশ্চিম পাশে ঝিল ১, ২ ও ৩ নম্বর এলাকা, কনকর্ড এমিউজমেন্ট পার্কের ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের পাশে জিয়া নগর, মুজিব নগর ও মধ্যম নগর নামের বসতি এবং হ্রদের পাহাড়ের পেছনে শান্তিনগর ও লেকসিটি নামের এলাকা গড়ে উঠেছে।
এসব পাহাড়ে কাঁচা, সেমিপাকা ও বহুতল পাকা ভবনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনাও আছে। মাটি কেটে কয়েক ধাপে উপরে-নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
গত দুই দশক ধরে সবকটি এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের বসতি।
এদিকে লকডাউনের সুযোগে গত কয়েক মাসে এসব এলাকায় পাহাড় কেটে আরও নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে ওঠার কথা স্বীকার করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে রেলওয়ে ওই লিজ চুক্তি বাতিল করলে উচ্চ আদালতে রিট করে কনকর্ড। চলতি বছরের শুরুতে স্থিতাবস্থা জারি করে আদেশ দেয় আদালত।
লিজ নেওয়া জমির মধ্যে হ্রদ ও সংলগ্ন বিশাল অংশে কনকর্ড এমিউজমেন্ট পার্ক গড়ে তোলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটি। তবে শুরু থেকেই লিজের পুরো জমি তাদের দখলে ছিল না।
এই সুযোগে হ্রদ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা দখল করে একের পর এক বসতি গড়ে উঠেছে।
পূর্ব রেলের বিভাগীয় ভূ সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেখানে কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি থাকলেও বেশিরভাগ জমি রেলের। উচ্ছেদের পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হলে আমরা কিছু করতে পারছি না।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েক দিন আগেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, এসি ল্যান্ডসহ সেখানে আমরা গিয়েছি। বিশাল পাহাড়ি এলাকা দখল হয়ে গেছে। ভিতরে ভিতরে সম্প্রতি আরও পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ের উপর গরুর খামারও হয়েছে।
“শুধু ঝিল ১,২ ও ৩ নম্বর এলাকায় প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার পরিবারের বসবাস। সেখানে প্রবেশ পথ খুবই সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন করে যারা পাহাড় কাটছে তাদের শুনানিতে ডাকা হবে।”
পাহাড় দখল করে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা গড়ে তোলার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, “এটা প্রায় পুরোটাই রেলওয়ের জমি। দখলের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশনার কারণে অভিযান সম্ভব হচ্ছে না।”
স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব জমি হাত বদল ও বিক্রি করে। সেখানে দখলদারদের নিজস্ব বিভিন্ন কমিটি আছে। সরকারি কোনো সংস্থা সেখানে অভিযানে যেতে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে যায়।
এমনকি পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারীরা উচ্চ আদালতের রিট মামলায় আবেদন করে পক্ষভুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে বসবাসের অনুমতি চেয়ে তারা আদালতে আবেদনও করেছে।
স্থানীয় উত্তর পাহাড়তলি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে বেশিরভাগ জমি রেলের। পাশাপাশি গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কিছু জমি আছে। প্রায় ২০ বছর ধরে এসব বসতি গড়ে উঠেছে। দিন দিন আরও বাড়ছে।
“অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের উচ্ছেদ করতে চাওয়ায় তারা কনকর্ডের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিল বলে জানতাম। এখন বর্ষায় ঝুঁকি, তাই আমরা বারবার যাই তাদের সচেতন করতে।”
“এখন পার্কের আশপাশের প্রায় সব পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের অবস্থান। প্রায়ই পাহাড় থেকে এসে তারা কাঠ নিয়ে যায়। এমনকি লেকের মাছও চুরি করে।”
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এস এম জাকারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত পরশু আমি যোগ দিয়েছি। যতটুকু জানি পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিস্তারিত জেনে পরে জানাতে পারব।”
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “আজ আমরা সেখানে মাইকিং করে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলেছি। তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ভাবে সেখানে আছেন।”