জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের হয়ে তার চেয়ে বেশি রান কেবল বড় ভাই অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের। বাঁহাতি স্পিনে ছিলেন কার্যকর, ফিল্ডিংয়ে দুর্দান্ত। ২০১০ সাল থেকে বছর তিনেক ছিলেন জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং কোচ। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানের ব্যাটিং কোচ। গত ২৫ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দেখেছেন তিনি নানা রূপে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিখ্যাত ফ্লাওয়ার ভাইদের ছোটজন কথা বললেন তার ক্যারিয়ার, বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের নানান সময় নিয়ে।
Published : 29 Feb 2016, 08:20 PM
প্রশ্ন: অনেকবারই বাংলাদেশে এসেছেন, ক্রিকেটার হিসেবে, এখন কোচের ভূমিকায়। কেমন লাগে এই দেশ?
গ্রান্ট ফ্লাওয়ার: চ্যালেঞ্জিং, সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। ব্যাটসম্যান হিসেবে চ্যালেঞ্জিং ছিল, এখন ব্যাটিং কোচ হিসেবেও। এখানকার কন্ডিশন সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং।
এবার এশিয়া কাপের উইকেটও ব্যাটিং কোচদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। উইকেট দেখে নিশ্চয়ই চমকে গেছেন?
ফ্লাওয়ার: ব্যাটসম্যানদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং। কখনও কখনও এটা খারাপ নয়, খেলার স্বাদটা বদলে যায়। তবে ভালো ব্যাটসম্যানরা সব সময়ই মানিয়ে নেয়।
ব্যাটিং কোচ হিসেবে আপনার কি মনে হয়, এই উইকেটে কিভাবে খেলা উচিত?
ফ্লাওয়ার: বিরাট কোহলি পাকিস্তানের বিপক্ষে যেভাবে খেলল, সেভাবে। সব ব্যাটসম্যানের জন্য সেটি হতে পারে উদাহরণ। এখানে ‘ইনটেন্ট’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক থাকতে হবে। সেটা শুধু শট খেলায় নয়। ডিফেন্স করা বা বল ছেড়ে দেওয়াতেও ইতিবাচক থাকতে হবে। সবসময় চার মারতে হবে না, সিঙ্গেল নিয়ে স্কোরকার্ড সচল রাখতেও হবে।
ফ্লাওয়ার: হ্যাঁ, সেটা ছিল ওই সময়ের বাস্তবতা। বাংলাদেশ দলকে প্রথম দেখেছি সম্ভবত ১৯৯০ আইসিসি ট্রফিতে। সেমি-ফাইনালে ওদেরকেই হারিয়েছিলাম আমরা। পরে অনেকবারই হারিয়েছি।
নব্বই দশক বা ২০০০ সালের আশেপাশের সময়ের কথা যদি বলেন, ওই সময় আমাদের জিম্বাবুয়ে দলটি ছিল অনেক অভিজ্ঞ। দারুণ সব ক্রিকেটারও ছিল আমাদের। বাংলাদেশ তখনও পায়ের নিচে জমি খুঁজে ফিরছিল। মাঠ, অবকাঠামোও ততটা ভালো ছিল না। এখন তো মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবকিছুই একদম ঠিকঠাক!
ফ্লাওয়ার: ক্রিকেট এখানে যতটা জনপ্রিয়, আমরা জানতাম বাংলাদেশ উন্নতি করবেই। হয়ত সময়টা একটু বেশি নিয়েছে। তবে এখন দলটা দারুণ। কোনো দলই বাংলাদেশকে হালকা করে দেখতে পারে না।
বাইরে থেকে দেখে কি মনে হয়, বাংলাদেশের এই দলটার বিশেষত্ব কি?
ফ্লাওয়ার: অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছে এই দলটিতে। বোঝা যায়, দল নির্বাচনের একটা ধারাবাহিকতা ছিল। কিছু ক্রিকেটারকে বেছে নেওয়া হয়েছিল, যারা দলকে এগিয়ে নেবে। সেটাই হয়েছে। এই দলের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটাররা সবাই একসঙ্গে অনেক দিন ধরে খেলছে।
এখনকার কোচিং স্টাফও দারুণ। যতদূর জানি, সবাই খুব আন্তরিক ভাবে একসঙ্গে কাজ করে। আর আমি শুনেছি, প্রস্তুতিটা খুব ভালো নেয় বাংলাদেশ দল। বিন্দুমাত্র ঘাটতি রাখতে চায় না।
এই দলের অধিনায়কের প্রথম আন্তর্জাতিক শিকার কিন্তু আপনি।
ফ্লাওয়ার: কে? মুর্তজা? তাই নাকি!
হ্যাঁ, মাশরাফির প্রথম টেস্ট উইকেট আপনি, প্রথম ওয়ানডে উইকেটও।
ফ্লাওয়ার: এটা মনে নেই। কিভাবে আউট হয়েছিলাম? যাই হোক, ব্যাপারটা খারাপ হয়নি! মুর্তজা আমাকে আজীবন মনে রাখবে!
ফ্লাওয়ার: অবশ্যই, খুব ভালো ভাবে মনে আছে। খুব ভালো বোলার ছিল। দারুণ গতিময়, বল মুভ করাতে পারত। সুইং ছিল, এখানকার পেস প্রতিকূল উইকেটেও সিম মুভমেন্ট আদায় করে নিয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে এরকম একজন ফাস্ট বোলার দেখা আমাদের জন্য ছিল সত্যিই বড় বিস্ময়।
আরেকটা ব্যাপার আমাদের নজর কেড়েছিল, তরুণ হলেও ওর হৃদয়টা ছিল বিশাল। নিজেকে উজার করে বোলিং করত। সিংহ হৃদয়!
এখন, এই মাশরাফিকে কেমন দেখছেন?
ফ্লাওয়ার: সে হয়ত গ্রেট ফাস্ট বোলার হয়ে উঠতে পারেনি। কারণটাও সবাই কম বেশি জানে। ইনজুরির কারণে কত কত প্রতিভাবান ফাস্ট বোলারের ক্যারিয়ার অকালে ঝরে গেছে! মুর্তজা ভাগ্যবান, এখনও খেলছে। সেই কৃতিত্বও তার। এটাও কম নয়।
ফ্লাওয়ার: গত বছর তো সরাসরি প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখেছি, পাকিস্তানকে হারাল বাংলাদেশ। যতটুকু দেখেছি, ওর ক্রিকেট মস্তিষ্ক দারুণ। আর সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়। চাপের সময় নিজে বোলিং করতে কিংবা সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিতে কখনোই ভয় পায় না। দারুণ সব সিদ্ধান্ত নেয়।
জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট এখন প্রায় দিশাহীন। হয়ত এরকম একজন নেতার খুব দরকার?
ফ্লাওয়ার: জিম্বাবুয়ের সমস্যাটা তো আসলে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরেই বেশি। সমস্যা ক্রিকেট প্রশাসনে, ক্রিকেট কাঠামোতে। সেই সমস্যাগুলো নিজেদেরই সৃষ্টি করা। সেখানে যেভাবে যা হচ্ছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুব ভালো কিছু নয়।
সবচেয়ে বড় সমস্যা কোনটি মনে হয়?
ফ্লাওয়ার: একের পর এক ক্রিকেটার চলে যাচ্ছে দেশের ক্রিকেট ছেড়ে। কেন ক্রিকেটাররা যাচ্ছে? যাচ্ছে অর্থের জন্য। কেন অর্থের সমস্যা? উত্তরটা সবারই জানা। সমাধান কেউ করছে না। অন্য দেশগুলোর মত টাকা দিলে ক্রিকেটাররা চলে যেত না! ওরা পেশাদার, জীবনধারণ তো করতে হবে!
দ্রুতই সমস্যা সমাধানের আশা কিছু করেন?
ফ্লাওয়ার: যদি সত্যিই সমাধান হতো, সেটি হতো আদর্শ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আশার জায়গা খুব বেশি দেখছি না।
আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একটু ফেরা যাক। দারুণ সব ইনিংস আছে, অনেক স্মৃতি। সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি কোনটি?
ফ্লাওয়ার: অভিষেক টেস্ট কখনোই ভোলার নয়। দেশেরও সেটি প্রথম টেস্ট, গোটা দেশের জন্যই ছিল বড় উপলক্ষ। খুব নার্ভাস ছিলাম আমি, ওপেন করেছিলাম। কপিল দেবের মতো বোলারকে খেলা, রান করা…সেঞ্চুরিটা পাইনি বলে খারাপ লেগেছিল (প্রায় ৬ ঘণ্টা খেলে ২৯৭ বলে করেছিলেন ৮২ রান)। তবে গর্বটাই বেশি ছিল।
পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম টেস্ট জয়ও স্মরণীয়। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো…ওই বিশ্বকাপের দলটি সম্ভবত আমাদের সেরা ওয়ানডে দল। ইংল্যান্ডকে সিরিজ হারানোও ছিল স্মরণীয় (১৯৯৬-৯৭)।
ফ্লাওয়ার: কখনোই ভোলার নয়। ৪২ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর জুটি বেধেছিলাম আমরা। ওয়াসিম আকরাম একের পর এক বাউন্সার ছুঁড়ছিল। সে সব সামলে ২৭০ (আসলে ২৬৯) রানের জুটি…আমি এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলাম, অ্যান্ডি শট খেলছিল। এরপর ওদের ফলোঅন করানো, দুই ইনিংসেই দুর্দান্ত বল করেছিল স্ট্রিকি (হিথ স্ট্রিক, ৬/৯০ ও ৩/১৫)। অসাধারণ জয় ছিল সেটি।
বড় ভাইয়ের সঙ্গে তো আরও দারুণ সব জুটি আছে আপনার। দুজনের জুটিতে ৫ হাজারের বেশি রান, ১৫ শতক, কোনটি বেশি স্মরণীয়?
ফ্লাওয়ার: প্রথম টেস্ট জয়ের জুটিটিই অবশ্যই সবার আগে। অ্যান্ডির সঙ্গে ব্যাটিং আমি উপভোগ করতাম। অনেক শিখেছি ওর কাছ থেকে। খুব ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা, পরস্পরকে ভালো বুঝতাম। সেটিও ব্যাটিংয়ের সময় কাজে লাগত।
এখন সম্পর্ক কেমন?
ফ্লাওয়ার: এখনও আমরা বন্ধু। পেশার কারণে হয়ত দেখা কম হয়। কিন্তু প্রচুর কথা হয় দুজনের। অনেক ব্যাপারেই আমরা পরস্পরের পরামর্শ, সাহায্য নেই।
ক্যারিয়ার নিয়ে ভবিষ্যত ভাবনা?
ফ্লাওয়ার: কোচিংয়েই থাকছি আপাতত। পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি আছে আরও মাস ছয়েক। তার পর দেখা যাক পিসিবি কী বলে। আশা করি, ভালো কিছুই হবে।