নাফ নদীতে টহলের সময় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীবাহিনী- বিজিপির হাতে অপহৃত হওয়ার আটদিন পর দেশে ফিরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, তিনি সুস্থ আছেন।
Published : 25 Jun 2015, 06:59 PM
একসপ্তাহ ‘টালবাহানা’ শেষে বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের মংডুতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পতাকা বৈঠক করে রাজ্জাককে বিজিবি কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করে বিজিপি।
কক্সবাজার বিজিবির উপ অধিনায়ক মেজর আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিকাল সোয়া ৪টার দিকে হস্তান্তরের পরপরই রাজ্জাককে পরীক্ষা করেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থাকা মেডিকেল অফিসার মেজর মো. শাহ আলম। পরে তারা স্পিড বোটে করে দেশের পথে রওনা হন।
নায়েক রাজ্জাককে নিয়ে টেকনাফ ৪২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু জার আল জাহিদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা টেকনাফ স্থলবন্দরের পুলিশ ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে পৌঁছান সন্ধ্যা সোয়া ৬টায়।
সেখান থেকে বিজিবির টেকনাফ সদরদপ্তরে রওনা হওয়ার আগে রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, “আমি সুস্থ আছি।”
বৃষ্টির মধ্যে বোট থেকে নেমে রাজ্জাককে পায়ে হেঁটেই ঘাটে উঠে আসতে দেখা যায়। পুরোদস্তর বাহিনীর পোশাকে থাকা এই বিজিবি সদস্যের মুখে ছিল দাড়ি, নাকে ছিল কাটা দাগ।
বিজিপি নির্যাতন করেছে কি না জানতে চাইলে রাজ্জাক চুপ করে থাকেন। নাকের ক্ষতের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলেন, ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় কেটে গেছে।
পরে রাজ্জাককে বিজিবির ৪২ ব্যাটালিয়নের সদরদপ্তরে নিয়ে যান বিজিবি কর্মকর্তারা। কোনো শর্ত ছাড়াই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলে বিজিবি প্রধান জানিয়েছেন।
এদিকে রাজ্জাকের মুক্তির খবরে নাটোরে তার গ্রামের বাড়িতে শঙ্কার মেঘ কেটে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তার স্ত্রী আসমা বেগম স্বামীর কোলে তাদের তৃতীয় সন্তানকে তুলে দেয়ার অপেক্ষায় আছেন, যার জন্ম হয় রাজ্জাককে ধরে নেওয়ার চার দিন পর।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে গত ১৭ জুন কক্সবাজার টেকনাফ সীমান্তে নাফ নদীতে গোলাগুলির পর বিজিবি সদস্য রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায় বিজিপি। ওই ঘটনায় বিপ্লব কুমার নামে একজন সিপাহী গুলিবিদ্ধ হন।
রাজ্জাকের মা বুলবুলি বেগম বলেন, ছেলে বাড়ি ফিরলেই নাতীর নাম রেখে আকিকা হবে, আনন্দ হবে।
পাঁচ ঘণ্টার পতাকা বৈঠক
এক সপ্তাহের অনিশ্চয়তার পর আবদুর রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনতে বৃহস্পতিবার সকালে মিয়ানমারের মংডুর পথে রওনা হয় বিজিবির সাত সদস্যের প্রতিনিধি দল।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিয়ানমারের ‘দেওয়ান নান্দি হলে’ শুরু হয় পতাকা বৈঠক।
এতে সাত সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন টেকনাফ ৪২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ। মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ২ বর্ডার গার্ড পুলিশের লেফটেন্যান্ট কর্নেল থি হান।
আবু জার বলেন, বৈঠকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষা বাহিনী তাদের কথা বলেছে এবং রাজ্জাকের সঙ্গে থাকা সব জিনিসপত্র ও অস্ত্র ফেরত দিয়েছে।
এদিকে বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নায়েক রাজ্জাকের ব্যক্তিগত অস্ত্র (এসএমজি), ম্যাগাজিন ও গোলাবারুদও বিজিপি ফেরত দিয়েছে। এ ধরনের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে বিষয়েও দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়।
‘শর্ত ছাড়াই রাজ্জাককে আনা হয়েছে’
বিকালে পিলখানায় বিজিবির সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি) মহাপরিচালক আজিজ আহমেদ বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই মিয়ানমার থেকে নায়েক রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
মিয়ানমার রাজ্জাককে ফিরিয়ে দিতে অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে সাগর থেকে উদ্ধার ৫৫৫ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার শর্ত দিয়েছিল বলে বিজিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন।
“আমাদের পক্ষ থেকে তাদের এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে বলা হয়, কোনো বিজিবি সদস্য পোশাক ছাড়া ডিউটি দেয় না। আর সেই দিন রাজ্জাক সীমান্ত অতিক্রম করেনি। বিজিপি সদস্যরাই পোশাক ছাড়া এসে আমাদের লোকজনের উপর হামলা করে রাজ্জাককে নিয়ে যায়।”
হাতকড়া পরা রাজ্জাকের ছবি ফেইসবুকে আপলোড করার বিষয়ে বিজিপির কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে তদন্ত করবে বলে তারা জানিয়েছে।”
এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ১৯৮০ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি মেনে চলার বিষয়ে বৈঠকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “এখন থেকে বিজিবি-বিজিপি তথ্য আদান-প্রদান করবে এবং সীমান্ত অতিক্রম করতে হলে তা একে-অপরকে জানিয়ে করবে।”
এক সপ্তাহের টালবাহানা
রোহিঙ্গাদের নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে গত ১৭ জুন ভোরে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে নাফ নদীতে গোলাগুলির পর বিজিবি সদস্য রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায় বিজিপি। ওই ঘটনায় সিপাহী বিপ্লব নামে আরেক বিজিবি সদস্য গুলিবিদ্ধ হন।
বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, নায়েক রাজ্জাকের নেতৃত্বে বিজিবির একটি দল নাফ নদীতে মাদক পাচারকারীদের নৌকায় তল্লাশি চালানোর সময় বিজিপির একটি ট্রলার সেখানে আসে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয় এবং মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা রাজ্জাককে তুলে নিয়ে যায়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ওইদিন বলেন, ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে এ ঘটনা ঘটেছে। রাজ্জাককে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু ওদিক থেকে সাড়া না পেয়ে পরদিন ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। অপহৃত বিজিবি সদস্যকে দ্রুত ফেরত পাঠাতে বলা হয় তাকে।
বিজিপির ফেইসবুক পেইজে এরই মধ্যে নায়েক রাজ্জাকের দুটো ছবি প্রকাশ করা হয়, যাতে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাতকড়া হাতে দেখা যায়। এ অবস্থায় রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম গত রোববার সকালে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।
বিষয়টি সংবাদের শিরোনাম হলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে মিয়ানমারের সমালোচনা করেন অনেকে। জাতীয় সংসদেও এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন একজন আইনপ্রণেতা।
একপর্যায়ে রাজ্জাককে ফেরত দিতে বাংলাদেশ সরকারকে শর্তও দেয় মিয়ানমার। তারা দাবি করে, মিয়ানমার উপকূলে পাচারকারীদের নৌকা থেকে উদ্ধার ৫৫৫ জনকেও বিজিবি সদস্যে রাজ্জাকের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কামাল গত মঙ্গলবার বলেন, মিয়ানমার ‘অতিরিক্ত করছে’।
এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বিজিপির পতাকা বৈঠকের চিঠি পাওয়ার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। এর ধারাবাকিতায় বৃহস্পতিবার দেশে ফিরলেন নায়েক রাজ্জাক।