বর্ষার রূপ উপভোগের চেয়ে রাস্তায় জমে থাকা বৃষ্টিজলে নাকাল হতে হবে, এটা রাজধানীবাসীর ফি বছরের আতঙ্ক। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। জুনের প্রথম দিনই ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়েছে ঢাকার অনেক রাস্তা; অথচ বর্ষা ঋতু আসতে বাকি আরও কয়েকদিন।
Published : 09 Jun 2021, 09:55 PM
জলজটের ভোগান্তি যে সহসাই কাটবে না, তা নগরবিদ আর ঢাকার দুই মেয়রের কথাতেও স্পষ্ট হয়েছে।
ঢাকার দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যার জন্য সেবাসংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করা হচ্ছিল। সেজন্য রাজধানীর বৃষ্টির পানি সরানোর দায়িত্ব ওয়াসার কাছ থেকে দেওয়া হয়েছে দুই সিটি করপোরেশনকে।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সমঝোতার পর এ বছর ৪ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের হাতে তুলে দেয় ঢাকা ওয়াসা।
এখন ঢাকার খাল ও ৩৬০ কিলোমিটার ড্রেনেজ সিস্টেম দুই সিটি করপোরেশনের কাছে। এর আগে থেকেই ২৩০০ কিলোমিটার ড্রেনেজ সিটি করপোরেশনের হাতে।
সিটি করপোরেশন দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ মাসেই রাজধানীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় রাতারাতি উন্নতি ঘটবে এমনটা আশা করা যায় না। তবে কতদিন লাগবে এ থেকে মুক্তি পেতে এমন প্রশ্নে ঢাকার দুই মেয়র বলছেন, ফল পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই শহরে জলজট থেকে আশু মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্য সামনে আসা অনেক চ্যালেঞ্জ সামলাতে হবে দুই মেয়রকে।
গত ১ জুনের বৃষ্টিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মিরপুর ১০ নম্বর, কাজীপাড়া, মিরপুর ১৩ নম্বর, মিরপুর ১ নম্বর, পীরেরবাগ, বনানীর কিছু অংশ, মহাখালীর চেয়ারম্যানবাড়ি, উত্তরার কয়েকটি সড়কে পানি জমে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ধানমণ্ডি, তেজতুরীবাজার, গ্রিনরোড, কাজী আলাউদ্দিন রোড, মালিবাগসহ কয়েকটি এলাকার রাস্তায় পানিতে তলিয়ে যায়।
জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে স্থায়ী নগরবাসীকে আরও অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
মেয়র তাপস জানান, ঢাকার রাস্তাঘাটসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে৷ পানি নিষ্কাশনে ভূমিকা রাখা ৬৫টি খালও এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢাকা ওয়াসা অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট বানিয়েছে তা পানি নিষ্কাশনে তেমন কাজে আসছে না।
তাপস বলেন, ২ জানুয়ারি খাল ও বক্স কালভার্টগুলো থেকে পলি-বর্জ্য অপসারণ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮ লাখ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।
“ওয়াসার দুটি পাম্প স্টেশন বুঝে পেয়েছি। এরমধ্যে কমলাপুর পাম্প স্টেশনের একটি এবং ধোলাইখাল পাম্প স্টেশনের দুটি মেশিন সচল করেছি। বাকী ৩টি পাম্প সচল করার চেষ্টা চলছে। ওয়াসার কাছ থেকে পাওয়া ১৮৫ কিলোমিটার নর্দমা পরিষ্কারের কাজ চলছে, জুনেই তা শেষ হবে।”
“হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই জনদুর্ভোগ বিবেচনায় নিজ উদ্যোগে সেসব অচল স্লুইসগেট সচল করার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছি। একইসাথে আমরা স্থানান্তরযোগ্য ৩০টি পাম্প কেনার কার্যক্রমও হাতে নিয়েছি।”
১ ও ৫ জুনের বৃষ্টিতে যেসব জায়গায় জলবদ্ধতা হয়েছে সেসব স্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
“আমাদের লক্ষ্য হল, সাধারণ মাত্রার বৃষ্টিপাত হলে ঢাকা শহরে যেন পানি না জমে। অতি ভারী মাত্রার বৃষ্টিপাত হলে তিন ঘণ্টার মধ্যে, ভারী বৃষ্টিপাত হলে দুই ঘণ্টার মধ্যে এবং মাঝারি ভারী বৃষ্টি হলে যেন এক ঘণ্টার মধ্যেই পানি নিষ্কাশন করা যায়।”
জলাবদ্ধতা দূর করার পদক্ষেপ সম্পর্কে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ১ জুনের বৃষ্টির পর যেসব সড়কে পানি জমেছে তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ছয়টি এলাকাকে ‘হটস্পট’ ধরা হয়েছে। এসব এলাকার ১০৩টি স্থানকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
“আপাতত সমাধান হিসেবে ডিএনসিসি খাল ও নিষ্কাশন নালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছে। পাশাপাশি চলছে খাল উদ্ধার। মুখে বলে দিলেই সমস্যা সমাধান হবে না, কাজটা করে দেখাতে হবে। আমি মনে করি এজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সিটি করপোরেশন চেষ্টা করবে, অন্যদের পাশে থাকতে হবে। আমার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খালের সীমানা নির্ধারণ করা। এবারের বাজেটে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটা বড় বাজেট থাকবে।”
তবে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে বলে মনে করেন উত্তরের মেয়র।
“আগে তিন থেকে চারদিন পানি জমে থাকত। এখন তা তিন ঘণ্টায় নিয়ে এসেছি। আমাদের চাওয়া এটা আরও কমিয়ে নিয়ে আসব। এ বছর যেমন আছে আগামী বছর পরিস্থিতি আরও একটু উন্নতি হবে। আমরা ধীরে ধীরে উন্নতি করব।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খানের মতে, সিটি করপোরেশন পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব নিলেও পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
তিনি বলেন, “বর্তমান অবস্থায় জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির সহজ সরল কোনো সমাধান নাই, সহসা মুক্তির কোনো উপায় নাই। ৩০-৪০ বছরে যে জঞ্জাল তৈরি করেছি তা ওভারনাইট পরিবর্তন করা যাবে না।”
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, পরিকল্পনার অভাবে ঢাকা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে বৃষ্টি হলে সব পানি ড্রেনেজ ব্যবস্থায় পড়ে। সবুজ এলাকা কম থাকায় পানি ভূগর্ভে যেতে পারে না।
ঢাকার দখল হয়ে যাওয়া খালের জমিতে স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে ওঠায় সেগুলো দখলমুক্ত করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।
“সিটি করপোরেশনের পক্ষে অল্প সময়ে এত অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে খাল খনন করা সম্ভব হবে না। এসব স্থাপনা ভাঙতে গেলে সিটি করপোরেশনকে অনেক ধরনের আইনি জটিলতায় পড়তে হবে।”
আরও পড়ুন-