সাধারণত সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, পাইকগাছা, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষি শ্রমিকরা আসেন এই হাটে।
Published : 30 Apr 2024, 04:02 PM
প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই যশোরের শার্শা উপজেলার নাভারন-সাতক্ষীরা মোড়ে বসে অন্যরকম এক বাজার। যেখানে কোনো পণ্য নয় বরং বেচা-কেনা চলে শ্রমের।
প্রতিবছর ধান কাটা, মাড়াই ও রোপণের সময় নিজের শ্রম বিক্রি করতে ‘দখিনের জোন’ নামে পরিচিত এই হাটে আসেন কৃষিশ্রমিকরা। আর চাষিরা আসেন ক্ষেতের ফসল দ্রুত ঘরে তুলতে দক্ষ শ্রমিকের খোঁজে।
তবে এবার এই হাটে আসা কোনো পক্ষই মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। স্থানীয় চাষিরা বলছেন, দাবদাহের কারণে এবার প্রায় দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দাবি করছেন দিনমজুররা। আর কৃষি শ্রমিকরা বলছেন, হাটে এবার অনেক শ্রমিক থাকায় তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
উপজেলার স্বরূপদাহ গ্রামের ধানচাষি আব্দুল মান্নান বলেন, “প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে এবার স্থানীয় জোন (শ্রমিক) পাওয়া যাচ্ছে না। এতে দখিনে জোনের কদর বেড়েছে। এই সুযোগে তারা মজুরিও প্রায় দ্বিগুণ চাচ্ছে।”
তিনি জানান, এবার প্রতিবিঘা জমির ধান কাটা, মাড়াইসহ যাবতীয় কাজের জন্য শ্রমিকরা দাবি করছেন, ছয় হাজার টাকা। যা গত বছর ছিল তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার উল্টোপুর গ্রাম থেকে দখিনের জোন হাটে আসা শ্রমিক মজিবর রহমান বলেন, “ছয় জনের একটি দল নিয়ে এইছি। কাল থেকে এখেনে আছি। দরদামে পুশাতেছ না, তাই কাজে যাইনি।
“মহাজনরা তিন বেলা খাওয়া দ্যেবে। কিন্তু গরমির মধ্যে জমির ধান কাটা, মাড়াইসহ সব কাজ করতি হবে। প্রতি বিঘায় ওনারা দিতে চেতেছে সাড়ে চার হাজার টাকা, আমরা চাতিছি পাঁচ হাজার টাকা।”
পাইকগাছার শ্রীকন্ঠপুর গ্রামের ৯ জনের দলনেতা ইমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাজ করতি হয় সুকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। খাটাখাটনির চেইতে এ মুজুরি খুবই কম। তবু অন্য কোনো উপায়নি, তাই আমরা এ কাজ করতিছি।”
শ্যামনগরের টেংরাখালী গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, “অন্যবারের চেইতে এবার কাজ বেশি। কিন্তু কাজের চেইতে বাজারে জোন (শ্রমিক) বেশি থাকায় আমাদের চাইদা কম। প্রতিদিন আবার সবার কাজও জোটে না।”
সাধারণত সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, পাইকগাছা, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষি শ্রমিকরা আসেন এই হাটে। কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়সের এই দিনমজুরদের একটাই লক্ষ্য কোনো ক্রেতা পেলে দর কষাকষি করে কাজ জুটিয়ে নেওয়া।
সাতক্ষীরায় বাড়ি নাভারন ফজিলাতুননেছা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যাপক গোপাল চন্দ্র দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাতক্ষীরায় মাছের চাষ বেশি হওয়ার কারণে ওখানে এখন কৃষি শ্রমিকদের কাজ থাকে না। লবণাক্ততার কারণে ইরি-বোরো চাষ হয় না। তাই অল্প সময়ে বেশি উপার্জনের আশায় দিনমজুররা এ ধরনের শ্রমের হাটে কাজ খুঁজতে আসেন।
শার্শার নাভারনের এই শ্রমবাজারের কোনো নিয়ন্ত্রক নেই। প্রতিদিন এই বাজারে অন্তত তিন শতাধিক শ্রমিক বেচাকেনা হয়ে থাকে বলে জানান স্থানীয়রা। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও কাজ না জোটায় তাহলে ফিরে যেতে হয় অনেককে। তারা পরদিন আবার আসেন কাজের খোঁজে।
শার্শার নাভারন কাজিরবেড় গ্রামের আনোয়ার হোসেন আনু মাখলার বিলে ত্রিশ বিঘা জমিতে ইরি ও বোরো ধান আবাদ করেছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে কোনো সময় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে, তাই ধান তোলা নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছি। প্রচণ্ড দাবদাহে মাঠে কাজ করার লোক পাচ্ছি না। শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর গ্রামের শাকের আলির পাঁচ সদস্যের একটি দলকে ধান কাটার জন্য বাজার থেকে নিয়ে এইছি।”
শ্রমিক নিতে আসা বেনাপোলের নটাদিঘা গ্রামের মিজানুর রহমান বলেন, “একযোগে সবার ধান কাটা শুরু করেছে, স্থানীয় শ্রমিকরা প্রতি বিঘা মজুরি নেচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা। তাই ধান কাটার জন্যই দখিনে জোন নিতে এসেছেন তিনি।
“এই বাজারে একসঙ্গে অনেক শ্রমিক পাওয়া যায়। তাদের শ্রমের মূল্যও তুলনামূলকভাবে কম”, বলে জানান মিজানুর।
শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপক কুমার সাহা বলেন, পুরোপুরি ধান কাটার উপযোগী হতে আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। ১০ মের ভেতরে সকল প্রকার ধান ঘরে তোলা সম্ভব হবে।
তবে ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কায় কৃষকরা আগে থেকেই ধান কাটা শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ২০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে শার্শায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ১২৫ বিঘা (২৩ হাজার ৩৫০শ হেক্টর) জমিতে ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আরও ৩ হাজার ৫৫৫ বিঘা বেশি জমিতে ধান চাষ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কাল বৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এবার উপজেলায় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮০ বিঘা জমিতে এক লাখ ৫২ হাজার ৩৩১ টন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
ধান কাটার শ্রমিক সংকট বিষয়ে জানতে চাইলে দীপক কুমার সাহা বলেন, ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাজাত করার জন্য উপজেলায় ৮টা হারভেস্টারে কাজ চলছে। এর মধ্যে দুইটা হারভেস্টার মেশিন ভাড়া করেছি। আরও দুইটি আনা হবে। প্রতিটি হারভেস্টারে ঘণ্টায় তিন বিঘা জমির ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাজাত করা সম্ভব।
কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয় থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে মাঠ থেকে ধান তোলায় ব্যস্ত এখানকার জমি মালিকরা। একই সঙ্গে সবাই ধান তোলা শুরু করায় উপজেলার সর্বত্র কৃষি শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে।
তবে বাইরের শ্রমিকরা আসায় সেই অভাব অনেকটা পূরণ হচ্ছে বলে জানান দীপক।