ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
Published : 21 May 2020, 04:56 PM
বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার রাতে ঘূর্ণিঝড়টি যখন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন দুই কোটি ২০ লাখের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, যা দেশের মোট গ্রাহকের প্রায় ৬০ শতাংশ।
ঝড়ের তীব্রতা কমার পর বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুর্গত এলাকায় সংযোগ পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু করে বিতরণ সংস্থাগুলো।
তবে দুপুর পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি, যা দেশের মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের প্রায় এক তৃতীয়াংশের বেশি।
এর মধ্যে গ্রিড সাব স্টেশনে আগুন লাগায় কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যুৎহীনতার কবলে পড়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোলা, বরগুনা, বরিশাল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকায় গাছ পড়ে বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, পোল ভেঙে পড়েছে।
“বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ৬০ শতাংশে রিকভার করা গেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ৯০ ভাগ এলাকা রিকভার করা যাবে।”
দেশে ছয়টি বিতরণ সংস্থার অধীনে রয়েছে তিন কোটি ৬৫ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহক। তার মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি গ্রাহকের সংযোগ বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত বন্ধ বা বিচ্ছিন্ন থাকায় চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে।
বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সচল এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ বেড়ে যায়। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে আরও অনেক এলাকায় সরবরাহ বন্ধ রাখা হয় বলে বিতরণ সংস্থাগুলো জানিয়েছে।
সরবরাহ ব্যবস্থার এই বিপর্যয়ের মধ্যে অনেক উৎপাদনকেন্দ্রও বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ভোর ৫টায় সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৬৮৩ মেগাওয়াটে নেমে আসে। দিনের প্রথমাংশে কিছু সংযোগ পুনস্থাপন করা হলেও বেলা ১টা পর্যন্ত চাহিদা সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটের ওপরে উঠেনি।
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত মার্চের শেষ দিকে সারাদেশে অবরুদ্ধ করার সময় বিদ্যুতের চাহিদা নেমেছিল সর্বনিম্ন ছয় হাজার মেগাওয়াটে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হতে চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াটে উঠে।
সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতের মোট গ্রাহক সংখ্যা দুই কোটি ৮৫ লাখ। তার মধ্যে প্রায় দুই কোটির সংযোগ সকালের দিকে বন্ধ ছিল জানিয়ে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অনজন কান্তি দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুপুর পর্যন্ত এক কোটি গ্রাহকের বিদ্যুৎ ফেরানো সম্ভব হয়েছে।
“২৫ হাজার স্পটে তার ছিঁড়ে পড়েছে। তিনশর মতো খুঁটি ভাঙার খবর পেয়েছি, সংখ্যাটা আরও বাড়ছে। প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহকের মিটার ভেঙে গেছে।”
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) জনসংযোগ শাখার পরিচালক এবিএম বদরুদ্দোজা সুমন বলেন, কুষ্টিয়া ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব স্টেশনে আগুন লেগে দুটি ট্রান্সফরমার জ্বলে গেছে। ফলে কুষ্টিয়াসহ পাশের কয়েকটি জেলায় দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে।
“তবে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলায় কোনো সমস্যা হয়নি। সেখানে বিতরণ সংস্থাগুলো লোড কমিয়ে দেওয়ার কারণে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। তারা যখনই চাইবেন বিদ্যুৎ পাবেন।”
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, “কুষ্টিয়াতে রিকভার করতে আরও ২/৩ দিন সময় লাগবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি সাবস্টেশন ঠিক করার আগেই সেখানে জরুরি মুহূর্তের কাজ চালানোর মতো বিদ্যুৎ দিতে। কুষ্টিয়ায় এখনই বড় আকারের বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না।”
রাজশাহীর আট জেলার বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) প্রধান প্রকৌশলী এসএম রেজাউল করিম বলেন, চাহিদা কমে যাওয়ায় জেলার ৪৪টি ৩৩ কেভি ফিডারের সবগুলোই বন্ধ করতে হয়েছিল। দুপুর পর্যন্ত ৩০টি চালু করা গেছে। বাকিগুলো চালু করতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে হাই ভোল্টেজের কারণে সচল ফিডারগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না।
“গাছ-গাছালি পড়ে কিছু পোল বাঁকা হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে প্রায় আট লাখ গ্রাহক রয়েছে। কিন্তু সবগুলো ফিডার একসাথে চালু না হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কারণ ভোল্টেজ বেড়ে যাওয়ার কারণে সচল লাইনগুলো লোড নিতে পারছে না। সবগুলো ফিডার চালু হলেই একসাথে বিদ্যুৎ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।”
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন জানান তাদের, মোট ১২ লাখ গ্রাহকের প্রায় সবাই ঝড়ের সময় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। দুপুর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছয় লাখ গ্রাহকের মাঝে বিদ্যুৎ দেওয়া গেছে। কিছু লাইন সচল হলেও ১১ কেভি ফিডার সচল করতে না পারায় বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছেনা।
তিনি বলেন, “ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এবং বরগুনায় বিদ্যুৎ দেওয়া যায়নি দুপুর পর্যন্ত। এসব এলাকায় মেরামত কাজ চলমান আছে।”
বিদ্যুতের একক ক্রেতা ও বিক্রেতা পিডিবির হাতে রয়েছে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট ও কুমিল্লার শহরাঞ্চলের বিতরণ ব্যবস্থা। এসব এলাকায় গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ।
পিডিবির জনসংযোগ শাখার পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঝড়ে পিডিবির বিতরণ লাইনে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও ময়মনসিংহে কিছু লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেগুলো দিনের মধ্যেই মেরামত করা সম্ভব হবে।”
ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ডিপিডিসি ও ডেসকোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঝড়ের কারণে তাদের সরবরাহ লাইনে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। সরবরাহ ব্যবস্থাতেরও বড় কোনো বিঘ্ন ঘটেনি।
তবে রাতে ঝড় বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতামূলকভাবে কিছুক্ষণের জন্য কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছিল।
ঝড়ের কারণে ঢাকার আমুলিয়া এলাকায় দুটি ৩৩কেভি লাইন ‘ট্রিপ’ করলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা মেরামত করা হয়েছে বলে জানান ডিপিডিসির এক কর্মকর্তা।
এদিকে এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা ওই ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “যে সমস্যাই হোক না কেন, অতি দ্রুত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করুন। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনে জেনারেটর সরবরাহ করে বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিন।”