Published : 16 Dec 2015, 12:39 PM
স্বাধীনতার কবি যখন দুঃসহ বেদনার কন্টক পথ বেয়ে এক সাগর রক্তের দামে পাওয়া বিজয়ের মহাকাব্যিক চিত্রকল্প আঁকেন, তাঁর প্রতিটি প্রচ্ছদপটেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের চির বিদ্রোহী ধূমকেতুর মতো মহাবিস্ময় নিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ প্রতিভাত হয়। রক্ত লাল জোয়ার উঠে জনসমুদ্রে, অমিত তেজ নিয়ে সূর্য উঠে পূর্ব দিগন্তে, দেশপ্রেমির রক্তে খেলা করে অবিনাশী আগুন। আর অসাধারণ স্মৃতি জাগানিয়া সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদের মাঝে প্রতিবার নিয়ে আসে ১৬ ডিসেম্বর।
মহান বিজয় দিবস আজ। চুয়াল্লিশ পেরিয়ে পঁয়তাল্লিশে পা রাখল প্রিয় বাংলাদেশ।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ অকুতভয় বীর শহীদের প্রাণ ও সর্বস্ব ত্যাগী ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পরাশক্তিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হানাদারদের শোষণ বঞ্চনার নাগপাশ ছিঁড়ে ১৬ ডিসেম্বর অভ্যুদয় ঘটে বিশ্বের চির বিস্ময় বাংলাদেশের। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সেই ক্ষুদ্র আয়তনিক বাংলাদেশ আজ তাঁর শির উন্নত রেখে চলেছে।
একসময় আমাদের রাজনীতি পুরোদস্তুর নিয়ন্ত্রণ করত দাতা দেশ, বিশ্বব্যাংক বা আমেরিকা-বৃটেনের মতো পরাশক্তিরা। কিন্তু এই চুয়াল্লিশ বছরের বয়সী ঋদ্ধতায় এসে আমরা মোড়লদের ছড়ি ঘুরানোর ওপর প্রতিবাদ করতে শিখে গেছি। আমরা এখন বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারছি।
আমাদের সাফল্যে ক্রিকেট বিশ্ব আজ কুর্ণিশ করে। বাংলাদেশের টাইগাররা ক্রিকেট পরাশক্তিদের হরহামেশা পদানত করে চলেছে। সাকিব আল হাসানরা থাকছেন বিশ্ব সেরাদের শীর্ষে। তরুণ মোস্তাফিজুর রহমানের কাটার যাদুতে মুগ্ধ হচ্ছেন বিশ্ব লিজেন্ডরাও। আমাদের নারী ক্রিকেটাররা নাম লেখাচ্ছেন বিশ্বকাপের বর্ণিল ক্রিকেট শোভায়।
দেশের কৃতি সন্তান আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী জাহিদ হাসান যখন পঁচাশি বছরের প্রতীক্ষিত অধরা কণা ফার্মিয়ন, ভাইল ফার্মিয়ন খুঁজে পান, তখন বিস্ময়ে বিমুগ্ধ না হয়ে পারা যায়? মুঠোফোন ও কম্পিউটার নির্ভর ডিজিটাল যুগে তাঁর এই আবিষ্কার এক যুগান্তকারী ঘটনা। এমন সাফল্যের গর্বে আমাদের বুক প্রসারিত হয়ে যায়।
পোশাক রপ্তানি, বৈদেশিক রেমিটান্স বা তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর কর্মযজ্ঞ ও মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্জিত নিম্ন মধ্যম আয়ের সক্ষমতা দিয়ে নিজেদের একক প্রচেষ্টায় আমাদের মর্যাদার সোপান আমরাই নির্মাণ করতে শিখে গেছি। কোনোও টাকা ছাড় হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে নিজেদের সরিয়ে নিলেও আমাদের এখন আর কিছু এসে যায় না। সকল দোলাচল ও অনিশ্চয়তা পেছনে ফেলে এই ক্ষুদ্র দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ৬.১৮ কিঃমিঃ দীর্ঘ পদ্মা সেতুর নির্মাণের মহা কর্মযজ্ঞ এই বিজয়ের মাসেই শুরু হয়েছে। দারিদ্রতা দূর, জিডিপি উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিসহ যে সেতু হবে আমাদের স্বাবলম্বিতা, সক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক।
মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সেই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, স্যানিটেশনসহ প্রায় সকল আর্থ সামাজিক সূচকে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছি। বিশ্ব শান্তি ও নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবস্থান এখন শীর্ষে। পোশাক রপ্তানিতে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাল, মাছ ও ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে শীর্ষ দশে আমাদের অবস্থান। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সৌর বিদ্যুতায়নেও আমরা বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। ধর্মান্ধদের ক্রমবর্ধমান অশুভ আস্ফালন সত্ত্বেও সক্ষমতায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারী।
গেল ০১ আগস্ট ভারত ও বাংলাদেশের সফল কূটনীতিতে ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটেছে ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর। তারা সবাই নতুন দেশ পেয়েছেন। বাংলাদেশে সংযুক্ত ছিটবাসীরা এই প্রথম নতুন দেশ পেয়ে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে পরিবেশ মোকাবেলায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখায় এ বছর জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার 'চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ' পেয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশকে বিশ্বের রোল মডেল, ইমার্জিং টাইগার নামে ডাকা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলা পরাশক্তিগুলোর সেক্রেটারি মিনিস্টাররা অন্তরের অনিচ্ছাকে কবর দিয়ে মুখাবয়বে রিংকেল পড়া হাসির রেশ টেনে প্রশংসায় পঞ্চমুখও হচ্ছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতির বিগ প্লেয়ার। আর মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যাননরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন ম্যাটার করে।
তবে চুয়াল্লিশ বছরে সবচেয়ে গর্বের ও শহীদ পরিবারের সান্ত্বনার জায়গাটি হলো, আওয়ামীলীগের ২০০৮ সালের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী পাকপ্রেমীরা ভেবেছিল ওরা সমস্ত বিচার বা শাস্তির উর্ধ্বে। সেই অলীক ধারণা ভুল প্রমাণ করা গেছে। ইতোমধ্যে চারজন মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবি হত্যার নীলনকশাকার এক মানবতাবিরোধী অপরাধীও রয়েছেন। আর দেশবিরোধীতা ও গণহত্যার প্রতীক মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযম ৯০ বছর কারাবাসের দন্ড মাথায় নিয়ে দেহত্যাগ করেছেন।
কিন্তু মানবাতাবিরোধীদের দন্ড কার্যকর ইস্যুতে বিজয়ের এই সময়ে এসে একাত্তরে নিজেদের ঘৃণ্য ভূমিকা অস্বীকার করবার ঔদ্ধত্ব দেখিয়েছে পাকিস্তান। যার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পাকিস্তান হাই কমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি(রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদের সাথে বাংলাদেশে তৎপর জঙ্গিদের সাথে যোগসাজশের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এমন প্রেক্ষিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ স্বীকার করে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়াটা এখন গণদাবি। অথচ আমরা কিনা সৌদি আরবের নেতৃত্বে পাকিস্তানকে সঙ্গি করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফ্রিকা ও এশিয়ার ৩৪টি দেশ নিয়ে গঠিত নতুন এক সামরিক জোটে নিজেদের নাম লিখিয়েছি। যেখানে ঐ জোটভূক্ত সৌদি, কাতার, আরব আমিরাতের বিরুদ্ধেই জঙ্গি অর্থায়নে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
সমাজের নানা ক্ষেত্রে বিশাল অর্জন থাকলেও মানুষে মানুষে বিদ্বেষের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারেনি দেশ। কলুষমুক্ত হয়নি এতদাঞ্চলের স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় রাষ্ট্র এখনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি নাগরিকদের ধর্ম পালন বা ধর্ম পালন না করার অধিকারের। চার দশকেও প্রকৃতার্থে দেশদরদি বা মানবহিতৈষী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক জান্তা শাসনের কাঁটাছিড়া ও খুনোখুনিতেই পার হয়েছে বেশ বড় সময়। এখনও অস্বীকারিক এক অদৃশ্য ধর্মভিত্তিক জঙ্গির ধুয়া তোলে ধর্মের নামে মানুষ খুন হয়ে চলেছে। দেশকে মানুষে মানুষে ভালোবাসার বসতঘর করে গড়ে তোলা যায়নি এখনও!
এর আগে বিগত সরকারের আমলে একই সময়ে ৬৩ জেলায় জঙ্গীদের বোমা হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটক এবং ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাও জাতিকে অবলোকন করতে হয়েছে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামীলীগ দুই দলই বেশ গোলমেলে অবস্থায় আছে। জামায়াতে ইসলামীর সাথে তাঁদের আদর্শগত মিল নেই, কেবল নির্বাচন ও আন্দোলনের ভিত্তিতে তাঁরা জোটবদ্ধ এমন বক্তব্যে বিএনপি নেতারা হরহামেশা মুখে খৈ ফুটান। বরং কার্যকরণে দেখা যায়, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মান্ধ জামায়াতের কাছে বিএনপির রয়েছে একধরণের রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ।
অন্যদিকে পতিত স্বৈরশাসক ও দুর্নীতির বরপুত্র এরশাদকে নিয়ে এক ধরণের সমঝোতার সরকার চালাচ্ছে আওয়ামীলীগ। এসময়ের আওয়ামীলীগ ধর্মনিরপেক্ষ নাকি চরম সাম্প্রদায়িক এই বিষয়টিতে ইতোমধ্যে একধরণের ভজঘট পেকে গেছে। কারণ উগ্র সাম্প্রদায়িকতা চর্চাকারী ও ধর্মান্ধ ২০ সহস্রাধিক জামায়াত বা হেফাজতের নেতাকর্মীরা এখন আওয়ামীলীগে ভীড়ে গিয়ে তাদের পিঠ বাঁচাচ্ছেন। কাজেই দুই বড় রাজনৈতিক দলেরই একপ্রকারের অনাদর্শিক রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা রয়েই গেছে। এ থেকে মুক্তি কিভাবে হবে কারো জানা নাই।
সম্প্রতি ঢাকার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলাদেশ গড়তে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টান, বৈধার্মিক সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে'। হতে পারে কথাগুলো আশা জাগানিয়া। কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার বা প্রকাশক হত্যা, সুফিবাদী হত্যা, তাজিয়া মিছিলে হামলা, শিয়া মসজিদে গুলি, কীর্তন, যাত্রা উৎসব বা বাউল মেলায় হামলা গুলি, হিন্দু মন্দিরে ভাংচুর, হিন্দু বসতিতে অগ্নিসংযোগ, খৃস্টান ধর্ম যাজকদের মেরে ফেলার প্রবণতা, জাপানী ও ইটালি নাগরিক হত্যার মতো ঘটনাগুলোর কোনোটারই কি প্রকৃত রহস্য উদঘাটন বা বিচারিক কাজ সুরাহা করা গেছে?
দেশে বিরুদ্ধ মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু এই অপ্রকাশিত মতেরা চাপে পড়ে রীতিমতো অবসেশনে ভোগে একসময় বিস্ফোরিত হতে পারে। কারণ মতের ধর্ম প্রকাশ হওয়া। গণতন্ত্র চর্চা বা রাজনীতির সুষম অধিকারের জায়গা থেকে সেই সুযোগ আর কতকাল সীমিত রাখা যাবে? বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে বলে ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে এমন নজির প্রত্যক্ষ করা গেছে। নির্বাচন কমিশন আদৌ শক্ত সোমত্ত কোনো প্রতিষ্ঠান এখন এমনটা বলা দুষ্কর।
আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গতিচেতনা বিষয়ক কাব্য 'বলাকা'তে বলেছিলেন, যত পাই তত পেয়ে পেয়ে/ তত চেয়ে চেয়ে/ পাওয়া মোর চাওয়া মোর শুধু বেড়ে যায়/ অনন্ত সে দায়/ সহিতে না পারি হায়! আমরাও আজ শপথ নিই, দেশের কাছে চেয়ে চেয়ে আকুল না হয়ে দেশকে বরং কতটুকু দিতে পারি সেই ভাবনায় এবার গা ঝাড়া দিই। এটাই হতে পারে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'।
হাজারো ঘটন অঘটন শেষেও আমরা পরাভব না মানা বিজয়ী জাতি। ধর্মান্ধতা, কূপমুন্ডকতা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, ছলচাতুরী, মিথ্যাচার বা কোনো প্রকার অসাধুতা আমাদেরকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারবে না। সত্য ও সুন্দরের সাধনায় এগিয়ে যাবেই আমার প্রাণের বাংলাদেশ। মহান বিজয় দিবসে এটাই হোক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গিকার।
লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
১৬ ডিসেম্বর ২০১৫