ভোটের আগে আবারও এরশাদ-নাটক

মহাজোটের সিদ্ধান্তই ‘চূড়ান্ত’ বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উল্টে গেলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2018, 03:47 PM
Updated : 27 Dec 2018, 05:59 PM

বিকালে বারিধারার বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্য ‘ভুলভাবে’ গণমাধ্যমে এসেছে দাবি করে রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, মহাজোটের বাইরেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা ভোটের লড়াইয়ে থাকবেন।

নাটকীয় অসুস্থতা নিয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরার পরদিন বৃহস্পতিবারই এই নাটকীয়তার জন্ম দেন এরশাদ।

গণআন্দোলনে ক্ষমতা হারানো সামরিক শাসক বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য আলোচিত-সমালোচিত।

বিষয়টি স্বীকার করে নিজেই একবার বলেছিলেন,“ তোমরা সবসময় বলো, আমি কথা ঠিক রাখি না। সকালে এক কথা বলি, বিকেলে আরেক কথা বলি।

“এটা কিছুটা হলেও সত্য। কিন্তু আমার অবস্থা তোমরা বুঝতে চাও না। আমার দুঃখের কথা তোমরা শুনতে চাও না।”

২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন সংসদ নির্বাচনের আগে বর্জনের ঘোষণা দিয়ে নাটকীয়ভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ।

সেবার হাসপাতালে থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান এরশাদ, পরে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতও হন। তার দল সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার পাশাপাশি সরকারেও যোগ দেয়, স্ত্রী রওশন এরশাদ হন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা।

এরপর গত ৫ বছরে ‘বঞ্চনা’ ও আওয়ামী লীগের কাছে ‘প্রাপ্য সম্মান’ না পাওয়ার অনুযোগ করে এলেও বিএনপি ভোটে এলে আওয়ামী লীগের মহাজোটে থাকার সিদ্ধান্তই জানিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু মহাজোট থেকে পাওয়া ২৬টি আসনে সন্তুষ্ট না হওয়া জাতীয় পার্টি শতাধিক আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী রেখে দেয়, যা নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে দেখা দেয় উদ্বেগ।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফিরে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এর মধ্যে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার মধ্যে আবার অসুস্থতা নিয়ে এরশাদ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হলে শুরু হয় গুঞ্জন। তার অসুস্থতা নিয়েও আসে নানা রকম বক্তব্য।

জাতীয় পার্টির জোটসঙ্গী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেন, এরশাদের এবারের অসুস্থতা ‘রাজনৈতিক’ নয়; তিনি ‘সত্যিই’ অসুস্থ।

জাতীয় পার্টির নেতারা বলেন, ‘রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায়’ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ৮৮ বছর বয়সী এরশাদ। দেশে থাকতে তাকে নিয়মিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতে হচ্ছিল।

তবে এরশাদের ভাই জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছিলেন, এই বয়সে যতটা অসুস্থ হয় মানুষ, তার ভাই তেমনই অসুস্থ।

এরপর গত ১২ ডিসেম্বর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান এরশাদ। যাওয়ার আগে দলের মহাসচিব বদলে যান তিনি। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মশিউর রহমান রাঙ্গাঁকে ওই পদে বসান তিনি।

দুই সপ্তাহ পর দেশে ফেরার পরদিনই বারিধারার বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন এরশাদ; তার সঙ্গে ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, যিনি সিঙ্গাপুরেও এরশাদের সঙ্গী ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে এইচ এম এরশাদের সঙ্গে ছিলেন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু

সংবাদ সম্মেলনে এসে এরশাদ আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়ে ঢাকা-১৭ ও সাতক্ষীরা-৭ আসনে ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। শুধু রংপুর-৩ আসনে মহাজোটের একক প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানান।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টিকে যে আসনগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়, রংপুর-৩ আসন তার একটি। এরশাদ বরাবরই পৈত্রিক এলাকার ওই আসনটিতে ভোট করছেন।  

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, মহাজোটের সমর্থনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেবেন। মহাজোট থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হবে, তাই মেনে নিতে হবে। 

তবে তিনি একইসঙ্গে বলেছিলেন, “যেখানে জয়ের সম্ভাবনা আছে, তারা প্রত্যাহার করবেন না।”

মহাজোট প্রার্থীদের সমর্থনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা ভোটের মাঠ ছেড়ে দেবেন বলে এরশাদের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর রাতে এরশাদের স্বাক্ষরে আসা বিবৃতিটিতে ভিন্ন কথা বলা হয়।

এতে বলা হয়, “বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমার বক্তব্য ভুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে জেনে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। মহাজোট ব্যতিত জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মুক্তভাবে নিজ নিজ আসনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। কেউ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না। তাদেরকে নির্বাচনের মাঠে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল।”

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদের উপ প্রেসসচিব খোন্দকার দেলোয়ার জালালীর মাধ্যমে সাংবাদিকদের কাছে তার বিবৃতিটি আসে।

অবস্থান বদলে এই বিবৃতির বিষয়ে কথা বলতে জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ, প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায়কে ফোন করা হলেও কেউ ধরেননি।

জাতীয় পার্টির দপ্তর সম্পাদক সুলতান মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাতক্ষীরা থেকে স্যার (এরশাদ) নির্বাচন করবেন না। ঢাকা-১৭ ছেড়ে দিয়েছেন ফারুককে। রংপুর -৩ এ কনফার্ম।”

এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাননি জাতীয় পার্টির কোনো নেতা।

সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পর বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে এইচ এম এরশাদ

এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, মহাজোটকে সমর্থন করবে জাতীয় পার্টি। মহাজোট যে সিদ্ধান্ত নেবে প্রার্থীদের তা মেনে নিতে হবে।

কিন্তু বিবৃতিতে তার অবস্থান বদলে যাওয়ায় শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের সঙ্গে লাঙ্গলও লড়াইয়ে থাকবে। তাতে ভোট ভাগ হয়ে গেলে প্রতিপক্ষরা সেই সুবিধা পেয়ে যাবেন বলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে আশঙ্কা।

তবে এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বোন’ সম্বোধন করে বলেছিলেন, তাকে সহযোগিতা করে যাবেন।

“আমার বোন শেখ হাসিনাকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। আমি নির্বাচনে বোন শেখ হাসিনাকে সর্বোত সহযোগিতা করব।”

ঢাকা-১৭ আসনে নৌকার প্রার্থী চিত্রনায়ক ফারুককে সমর্থনের কথা জানিয়ে এরশাদ বলেন, “সিদ্ধান্ত নিয়েছি নির্বাচনে মহাজোটকে সমর্থন করব। ঢাকা-১৭ আসনে আমি নির্বাচন করতাম, নানাবিধ কারণে আমি বিরত থেকে ফারুককে সমর্থন করলাম।

“শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমি রংপুর যেতে পারি নাই৷ তবে ভালো হয়ে যাবো। আশা করি, রংপুরের মানুষ সদয় হয়ে রংপুর-৩ আসন আমাকে উপহার দেবে।”

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও ভোটের আগের পরিস্থিতি নিয়েও সন্তোষ জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিএনপি সমালোচনামুখর হলেও তা নিয়ে নীরব থাকেন এরশাদ।

সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সন্তুষ্টির মধ্য থেকে নির্বাচন শেষ হবে।”

বিএনপির বিষয়ে তিনি বলেন, “বিএনপির অবস্থান ভালো না। তদের অতীত রেকর্ড ভালো না। জয়ের সম্ভাবনা নেই বিএনপির।”

সাংবাদিকরা শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে এরশাদ বলেন, “আমি ভালো আছি তোমাদের দোয়ায়।”

এরশাদের আরও খবর