রুশ সামরিক বাহিনীকে সহায়তার কথা বলে এই ভারতীয়দের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে প্রশিক্ষণের কথা বলে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়- বলছে পরিবার।
Published : 28 Feb 2024, 09:30 PM
প্রতারণার শিকার হচ্ছে ভারতীয়রা। দালালের খপ্পরে পড়ে রুশ বাহিনীর হয়ে লড়তে ইউক্রেইনে গেছে অন্তত এক ডজন ভারতীয়। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সেখানে একজন নিহত হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকা জানায়, গত সপ্তাহে গুজরাট রাজ্যের বাসিন্দা হেমাল অশ্বিনভাই ইউক্রেইনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন।
হেমালের বাবা গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিবিসি-কে জানান, তিনদিন আগে ছেলের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। তিনি বলেন, হেমালকে ইউক্রেইন সীমান্ত থেকে ২০–২২ কিলোমিটার ভেতরে মোতায়েন করা হয়েছিল। মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এলেই বাবাকে ফোন করত সে।
প্রতারণার শিকার বাকি যে ভারতীয়রা আছে, তাদের পরিবার এখন তাদেরকে ঘরে ফেরাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেছে।
এই ভারতীয়দের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে, তাদের ২২ থেকে ৩১ বছর বয়সী স্বজনরা প্রতারণার শিকার হয়েছে। রুশ সামরিক বাহিনীকে সহায়তার কথা বলে তাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে প্রশিক্ষণের কথা বলে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।
রাশিয়ার ভারতীয় কয়েকটি সূত্র বলছে, কয়েক ডজন ভারতীয় রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তবে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র ‘দ্য হিন্দু’-কে জানিয়েছে, গত এক বছরে প্রায় ১০০ জন ভারতীয়কে নিয়োগ করা হয়েছে।
বিবিসি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত রুশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এখন পর্যন্ত কোনও সাড়া পায়নি। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে যে, কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে সহায়ক কাজের জন্য নাম লিখিয়েছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা মস্কোয় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের নজরে আনা হয়েছে। সেগুলো রুশ কর্তৃপক্ষের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া, যেসব বিষয় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নজরে আনা হয়েছে, সেগুলো নয়াদিল্লির রুশ দূতাবাসকে জানানো হয়েছে। ফলে কয়েকজন ভারতীয়কে এরই মধ্যে রুশ বাহিনী থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব ভারতীয় নাগরিককে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সংঘাতে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
প্রতারণার শিকার কয়েকজন ভারতীয়র একাধিক ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে তারা বলেছেন, কীভাবে দালালরা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছে। এতে তাদের পরিবারও বড় ধাক্কা খেয়েছে। নিম্নবিত্ত এই ভারতীয়দের পরিবারের সদস্যরা অটোরিকশা চালিয়ে, চা বিক্রি করে কিংবা ঠেলাগাড়িতে পণ্য বিক্রি করে জীবনধারণ করে।
রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া ভারতীয় ও তাদের পরিবারের অভিযোগ, সামরিক বাহিনীতে কয়েক মাস কাজের পর তাদেরকে রুশ পাসপোর্ট দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল দালালরা। এর বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ৩ লাখ রুপি চায় তারা।
ভারত ছাড়াও দালালরা সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে মানুষ সংগ্রহ করেছে। কারও কারও কাছ থেকে এ জন্য ১২ লাখ রুপিও নেওয়া হয়েছে। এমনই একজন ভারতীয়র বাবা বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কর্ণাটক রাজ্যে ঠেলাগাড়িতে করে চা ও ডিম বিক্রেতা ওই বাবা বলেন, “আমার ২৮ বছর বয়সী ছেলে দুবাইয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। সেখানে সে ও তার তিন বন্ধু একজন দালালের ভিডিও দেখেছিল। তাতে রাশিয়ায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ রুপি বেতনের চাকরির কথা বলা হয়েছিল। সে সময় আমার ছেলে ও তার বন্ধুরা দুবাইয়ে বেতন পেত ৩৫ থেকে ৪০ হাজার রুপি। রাশিয়ায় যেতে তারা ঋণ করে ওই দালালকে ৩ লাখ রুপি দেয়। দয়া করে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনুন।”
তেলেঙ্গানা, গুজরাট, কাশ্মীর, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা অন্যান্যরাও কর্ণাটকের ওই চা বিক্রেতা বাবার মতো একই কথা বলেছেন। তবে এতগুলো ঘটনার মধ্যে মাত্র একজন সফলভাবে মস্কো থেকে পালিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন।
জানুয়ারির শেষদিকে মস্কোর একটি গোপন জায়গায় ধারণ করা ভিডিওতে উত্তর প্রদেশের একজন বলেন, এক ভারতীয়র পরিচালিত 'বাবাভ্লগ’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে তারা সেখানে গেছেন। তাদেরকে প্রতি মাসে দেড় লাখ রুপি বেতনের চাকরির কথা বলা হয়েছিল। তবে রুশ সেনাবাহিনীতে পাঠানো হবে, তা জানানো হয়নি। বিবিসি ওই চ্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনও সাড়া পায়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে একইভাবে প্রতারণায় পড়েন উত্তর প্রদেশের আরেকজন। এক ভিডিওতে তিনি বলেন,“মস্কোয় আমরা রুশ ভাষায় লেখা একটি চুক্তিতে সই করি। এরপর আমরা রাজি না থাকার পরও আমাদেরকে যুদ্ধে পাঠানো হয়।”
তিনি জানান, তাদের কারোরই যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ নেই। তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনিসহ আরও দুই ভারতীয় আহত হয়েছেন। তার ডান হাতে আঘাতের চিহ্নও দেখান তিনি।
এই ভারতীয় বলেন, “দয়া করে আমাদেরকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান। অন্যথায় তারা আমাদেরকে সম্মুখ সমরে পাঠিয়ে দেবে। এখানে চারিদিকে কামান ও ড্রোন হামলা হচ্ছে। আমাদের যুদ্ধ করার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। দালালরা আমাদেরকে এই বিপদে ফেলেছে।”
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে আটকে আছেন কাশ্মীরের একজন। তিনি জানান, এক ভারতীয় সঙ্গী এবং নেপাল ও কিউবার নয়জনের সঙ্গে ইউক্রেইনের মারিউপোলে আটকে আছেন তারা। অনুশীলনের সময় পায়ে চোট পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
বলেন, “আমাদের কমান্ডার বলতেই থাকেন, ডান হাত দিয়ে গুলি করো, বাঁ হাত দিয়ে গুলি করো, ওপরে গুলি করো, নিচে গুলি করো। এর আগে আমি কখনো বন্দুক ধরিনি। সেখানে খুবই ঠান্ডা ছিল। আর বাঁ হাতে বন্দুক ধরা অবস্থায় শেষ পর্যন্ত আমার পায়েই গুলি করে ফেলি।”
আটকে পড়াদের একজনের ভাই বলেন, প্রতারণার শিকার ভারতীয়রা ওয়াগনার ভাড়াটে সেনাদল নাকি রুশ সেনাবাহিনীতে ছিল তা তিনি জানেন না। তারা ইউক্রেইন সীমান্ত থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার (২৪ মাইল) দূরে। তিন মাসের মধ্যে তাদের রুশ নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
কেবল গুজরাটের আহমেদাবাদের ২৪ বছর বয়সি শেখ মহম্মদ তাহির যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া এড়াতে পেরেছিলেন। একটি গাড়ি ব্যাটারি ওয়ার্কশপে কাজ করতেন বলে জানান তিনি। গত সপ্তাহে তিনি ভারতে ফেরেন।
হায়দরাবাদ শহরের সংসদ সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই প্রতারণার ঘটনা সামনে আনার পর বিষয়টি সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি আটকে পড়া ভারতীয়দের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন তিনি।
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের অভিযোগ, গত এক বছরে প্রায় ১০০ জন ভারতীয়কে রুশ সেনাবাহিনীতে সহায়ক কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের অনেককে রাশিয়া-ইউক্রেইন সীমান্তে রুশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা যাতে দেশে ফিরতে না পারে, সেজন্য তাদের অনেকের পাসপোর্ট ও নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে।
২০২২ সালে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর কয়েকজন ভারতীয় স্বেচ্ছায় ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে ভারতীয়দের উপস্থিতির এমন খবর এই প্রথম পাওয়া গেছে।
বিবিসি রাশিয়ায় এক ভারতীয়ের সঙ্গেও কথা বলেছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে একসময় ছিলেন তিনি। তার কথায়, রাশিয়ার সেনাবাহিনী সবসময় স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে এবং বিভিন্ন চুক্তির তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করে বলেই তিনি জানেন। যারা রাশিয়ানদের সম্পর্কে জানে না তারাই দালালদের খপ্পরে পড়ছে বলে মত তার।