দেশবাসীকে মুরগির পা খাওয়ার পরামর্শ মিশর সরকারের

সরকারের এ পরামর্শ দেশটির চরম অর্থনৈতিক সংকটের নগ্নচিত্র সামনে এনেছে, ক্ষোভে ফুঁসছে জনগণ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2023, 02:55 PM
Updated : 19 March 2023, 02:55 PM

‘‘হা ঈশ্বর, আমাদের মুরগির পা খাওয়ার মত অবস্থায় নিয়ে ফেলো না”-মিশরের গিজা মার্কেটে পোল্ট্রি মুরগি বিক্রেতার পাশে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি এভাবেই ঈশ্বরের কাছে দয়া ভিক্ষা চাইছিলেন।

ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে মিশর। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে সেখানকার অনেক মানুষ পরিবারের জন্য প্রতিদিনের খাবার পর্যন্ত যোগাড় করতে পারছে না।

এ সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে পুষ্টি ঘাটতি পূরণের সর্বশেষ যে পরামর্শ, তাতে জনগণকে মুরগির পা রান্না করে খেতে বলা হয়েছে।

মুরগির পা উচ্চ-প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। কিন্তু মিশরে সাধারণত লোকজন মুরগির পা খায় না, ফেলে দেয়। সেগুলো রাস্তার কুকুর-বিড়ালের খাবারে পরিণত হয়।

সেই মুরগির পা খাওয়ার সরকারের পরামর্শ জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

টানা দুই বছর কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কার পরপরই ইউক্রেইন যুদ্ধ, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই যাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হু হু করে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। মূল্যস্ফীতি আকাশছোঁয়া। মার্চ মাসে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশের সামান্য ওপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় সবচেয়ে ভুগতে থাকা দেশগুলোর একটি মিশর।

সেখানে রান্নার তেল এবং পনিরের মত পণ্য যেগুলো আগে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের রান্নার প্রধান উপকরণ ছিলো সেগুলো আজ তাদের জন্য বিলাসিতা হয়ে গেছে। মিশরের বেশিরভাগ মানুষ এসব পণ্য কেনার সক্ষমতা হারিয়েছেন।

মাত্র কয়েক মাসে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে গেছে।

তিন সন্তানের মা উইদাদ, বয়স ৬০ এর কোঠায়। তিনি বিবিসি-কে বলেন, ‘‘আমি হয়ত মাসে একবার মাংস খেতে পারি, অথবা আমি এটা একদমই কিনতে পারছি না। আমি সপ্তাহে একবার মুরগি কিনি। এখন তো একটি ডিমের দামও ৫ মিশরীয় পাউন্ড (০.১৬ মার্কিন ডলার) হয়ে গেছে।”

মিশরের জনসংখ্যা ১০ কোটির বেশি। অভ্যন্তরীণ কৃষি নয় বরং দেশটি মারাত্মকভাবে আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর নির্ভরশীল। যা সেখানে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে।

এমনকী পোল্ট্রি মুরগির খাবারও মিশর আমদানি করে। গত ১২ ‍মাসে মিশরীয় পাউন্ডের মূল্যমান ডলারের বিপরীতে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

তাই যখন জানুয়ারিতে দেশটির সরকার আবার মূ্দ্রার অবমূল্যায়ন করে, তখন শস্যের মত অতিগুরুত্বপূর্ণ পণ্যের আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।

এক বছর আগেও উইদা তার মাসিক অবসরভাতা পাঁচ হাজার মিশরীয় পাউন্ড দিয়ে বেশ সাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারতেন। ‍তিনি নিজেকে তাই মধ্যবিত্ত বলতেন।

কিন্তু মিশরের অনেক নাগরিকের মতো তাকেও এখন মাস শেষে বাজারের হিসাব মেলাতে লড়াই করতে হচ্ছে। তাই এখন মুরগি কেনার অর্থ যোগাড় করতেও তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘‘একজন বিক্রেতা মুরগির হাড় ছাড়া মাংস এক কিলো ১৬০ মিশরীয় পাউন্ড বলছে। বাকিরা তো ১৭৫, ১৯০ এমনকি ২০০ মিশরীয় পাউন্ডও চাইছে।

‘‘মুরগির রান বিক্রি হচ্ছে ৯০ মিশরীয় ‍পাউন্ড কিলো। এখন এমনকী মুরগির হাড় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মুরগির পায়ের দাম ২০ মিশরীয় পাউন্ড।”

মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিস অবশ্য অর্থনৈতিক এ সংকটের জন্য কয়েকবারই ২০১১ সালের আরব বসন্তের জেরে সেদেশে হওয়া বিক্ষোভ এবং জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। কোভিড-১৯ মহামারী ও ইউক্রেইন যুদ্ধকেও দায়ী করেছেন তিনি।

মিশর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গম আমদানিকারক দেশ। তাদের গমের বেশিরভাগ যোগানই আসতো ইউক্রেইন ও রাশিয়া থেকে।

ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই গম ও গমজাত পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেইনের নাগরিকদের কাছে বেড়ানোর জনপ্রিয় স্থান ছিল মিশর। ফলে যুদ্ধের কারণে মিশরের পর্যটন খাতেও ভাটার টান পড়েছে।

মিশরে জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি আসে পর্যটন খাত থেকে। মহামারীতে যা আগেই বিধ্বস্ত ছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি যতটা না খারাপ, তার থেকেও বেশি খারাপ হয়েছে সরকারের কিছু ভুল পদক্ষেপের কারণে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের মতো উপসাগরীয় আরব দেশগুলো মিশরের বিনিয়োগ করে দেশটির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আরও বিনিয়গের জন্য তারা বেশ কঠোর সব শর্ত রেখেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিশর যদি দেউলিয়া হয়ে যায় তবে তার তীব্র প্রভাব দেশটির পশ্চিম এবং গল্ফ আরব প্রতিবেশীদের উপরও পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

 অতীতে মিশরে যখনই অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে, তখনই দাঙ্গা হয়েছে। সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক ও মোহাম্মেদ মোরসির পতন এভাবেই হয়েছে।

বর্তমানে দেশটিতে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তাতে জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে। যে ক্ষোভ পুরো দেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বালাতে পারে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট সিসির উপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে একজন নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘‘ওই কালো দিন, যেদিন আমরা আপনাকে ভোট দিতে গিয়েছিলাম, সেদিনের কথা মনে করে আমরা নারীরা যে কী পরিমাণ অনুতাপ করি তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।আপনি আমাদের জীবন জাহান্নাম করে ছেড়েছেন।”

ভিডিওত তিনি তার ব্যাগ থেকে অল্প কিছু অর্থ বের করে বলেন, কিভাবে তিনি এই সামান্য অর্থে তার বাচ্চাদের খাবার কিনবেন।

এ অবস্থা দেশটির বেশিরভাগ মানুষের।