রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে পশ্চিমাদের যেসব অস্ত্র পেয়েছে ইউক্রেইন

সম্প্রতি জার্মান সরকার ১৪টি লেপার্ড ২ ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে; আর যুক্তরাষ্ট্র পাঠাবে তাদের অত্যাধুনিক ৩১টি আব্রামস ট্যাংক।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2023, 03:28 AM
Updated : 30 Jan 2023, 03:28 AM

রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন ইউক্রেইনে আক্রমণ করে বসল, অনেকেই ভেবেছিলেন, কিইভের পরাজয় বুঝি সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে গত ১১ মাসে এটা নিশ্চিত হয়েছে, দুই পক্ষ সমঝোতায় না এলে এ যুদ্ধ সহসা থামার নয়। 

ইউক্রেইনের এই লড়াকু মনোভাব প্রশংসিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। আর এই দীর্ঘ সময় প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নানামুখি সহায়তা।

যুদ্ধের বছরপূর্তির আগে ইউক্রেইনকে আরও সামরিক সহায়তা দিতে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের ট্যাংক পাঠানোর স্দ্ধিান্ত নিয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, জার্মান সরকার ১৪টি লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে; আর যুক্তরাষ্ট্র পাঠাবে তাদের অত্যাধুনিক ৩১টি আব্রামস ট্যাংক। এছাড়া কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ জার্মানির তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠাতে সবুজ সংকেত পেয়েছে।

পশ্চিমা জোটের আরেক মিত্র যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে নিজেদের ১৪টি ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থনকে স্বাগতও জানিয়েছে ইউক্রেইন।

ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া হামলার পর ৩০টিরও বেশি দেশ ইউক্রেইনকে সমরাস্ত্র সহায়তা দিয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

এ পর্যন্ত কী কী অস্ত্র পেয়েছে ইউক্রেইন? সেসব যুদ্ধাস্ত্রের কার্যকারিতাই বা কেমন? বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে সেসব অস্ত্রের বৃত্তান্ত। 

ট্যাংক

যুদ্ধের ময়দানে ট্যাংক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র। আর সে কারণেই রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া অংশ পুনরুদ্ধার এবং নিজেদের সুরক্ষায় দ্রুত পশ্চিমা ট্যাংক হস্তান্তরের তাগাদা দিয়ে আসছেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি।

এদিকে পশ্চিমা অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, রাশিয়া এখন খুবই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় পশ্চিমা অত্যাধুনিক ট্যাংক ইউক্রেইনের জন্য দারুণ সহায়ক হতে পারে।

ইউরোপীয় দেশগুলোর ব্যবহৃত লেপার্ড-২ ট্যাংক রক্ষণাবেক্ষণ যেমন সহজ, অন্যান্য ট্যাংক থেকে এর জ্বালানিও কম লাগে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

রাশিয়া আক্রমণ শুরুর পরের মাসগুলোতে পশ্চিমা দেশগুলো ‘নেটোর ব্যবহৃত’ অস্ত্র সরবরাহের চেয়ে ওয়ারশ চুক্তির সক্ষমতা অনুসারে অস্ত্র সহায়তা দিতে চেয়েছে। কারণ ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনীর কাছে আগে থেকেই এসব অস্ত্রের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ছিল।

এদিকে নেটো স্ট্যান্ডার্ড বিভিন্ন অস্ত্র সরবরাহ করলে প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের সহায়তা নতুন করে দিতে হত, যা ইউক্রেইন সেনাদের কাছে ছিল না।

যুদ্ধের প্রায় এক বছর পেরিয়ে এসে নেটো স্ট্যান্ডার্ড সেসব অস্ত্র ব্যবহারে নিজেদের প্রস্তুত বলে মনে করছে কিইভ।

যুক্তরাজ্য ১৪টি চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক দিতে রাজি হয়েছে। এগুলোই দেশটির সমর বহরের প্রধান ট্যাংক।

চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক ১৯৯০ সালে তৈরি করা হলেও ইউক্রেইনের হাতে থাকা ট্যাংকগুলোর চেয়ে উন্নত।

রাশিয়ার আক্রমণের আগে ইউক্রেইন ওয়ারশ চুক্তির সময়ের টি-৭২ ট্যাংক ব্যবহার করে আসছিল। ফেব্রুয়ারির পর পোল্যান্ড ও চেক রিপাবলিকসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে ২০০টির বেশি টি-৭২ ট্যাংক সহায়তা পেয়েছিল ইউক্রেইন।

যুক্তরাষ্ট্রের ৩১টি আব্রামস ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণার সময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেগুলোকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ট্যাংক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, ইউক্রেইনের সেনাদের তারা এসব ট্যাংক ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করবেন।

কবে নাগাদ তা শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলেননি বাইডেন; তবে এসব ট্যাংক ও প্রশিক্ষণের তহবিল গঠন দীর্ঘমেয়াদী হওয়ায় আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এসব ট্যাংক ইউক্রেইনে মোতায়েন সম্ভব নয় বলে মনে করেন ওয়াশিংটনে বিবিসির সাংবাদিক গ্যারি ও’ডনোহ।

সাঁজোয়া যান

পেশাদার সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, যে কোনো সম্মুখ যুদ্ধে সফল হতে অনেক ধরনের সরঞ্জাম স্থাপন ও তত্ত্বাবধান করতে হয় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অনেক লজিস্টিক সাপোর্ট।

আর যুক্তরাষ্ট্রের দ্য স্ট্রাইকার এমনই একটি সাঁজোয়া যান, যা ইউক্রেইনকে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ৯০টি স্ট্রাইকার সাঁজোয়া যান দ্রুত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে।

অন্যান্য যু্দ্ধযানের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি দেওয়া ৫৯টি ‘ব্র্যাডলি’ সাঁজোয়া যানও রয়েছে। ইরাকে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল দেশটি।

আকাশসীমা প্রতিরক্ষা

২০২২ সালের ডিসেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম’ পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিল। সম্প্রতি জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসও সেই সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছে।

অত্যাধুনিক এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতা প্রায় ১০০ কিলোমিটার। এর কার্যকারিতা মূলত ক্ষেপণাস্ত্রের ধরনের ওপর নির্ভর করে। এ সিস্টেম ব্যবহারের জন্য অবশ্য বিশেষ প্রশিক্ষণও নিতে হবে ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীকে। জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে সেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে বিবিসি।

তবে এই সিস্টেম পরিচালনা বেশ ব্যয়বহুল, প্রতিটি প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেমের দাম প্রায় ৩০ লাখ ডলার।

যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেইন এখন পর্যন্ত সোভিয়েত আমলের এস-৩০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে আসছে। এই সিস্টেমও ভূমি থেকে আকাশসীমার সুরক্ষা দিতে সক্ষম।

যুদ্ধ শুরুর আগে ইউক্রেইনের কাছে প্রায় ২৫০টি এস-৩০০ ছিল। চেষ্টা ছিল প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে মজুদ থেকে এরকম কিছু সিস্টেম দিয়ে সেগুলো পূর্ণ করা হবে, যার কিছু এসেছিল স্লোভাকিয়া থেকে।

এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেইনকে নাসামস (ন্যাশনাল অ্যাডভান্সড সারফেইস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম) সরবরাহ করেছে, যার প্রথম চালানটি ২০২২ সালের নভেম্বরে পৌঁছেছিল।

আর যুক্তরাজ্য স্বল্প দূরত্বের মিসাইল ঠেকাতে সক্ষম স্টারস্ট্রেকসহ আকাশ প্রতিরক্ষার বেশ কিছু সরঞ্জাম ইউক্রেইনকে দিয়েছে।

জার্মানির দেওয়া বিভিন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে আইআরআইএস-টি। এটি ২০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকা মিসাইলেও আঘাত হানতে সক্ষম। 

দূরপাল্লার রকেট

যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দূরপাল্লার রকেট লঞ্চারের মধ্যে রয়েছে এম১৪২। এটি হাই মবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম বা হিমারস হিসেবে পরিচিত। কয়েকটি ইউরোপীয় দেশও একই রকম রকেট লঞ্চার ইউক্রেইনে পাঠিয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, ২০২২ সালের নভেম্বরে ইউক্রেইনের খেরসন অঞ্চল থেকে রাশিয়াকে পিছু হটাতে এই হিমারস সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

হিমারস দিয়ে কতটা দূরে আঘাত হানা যাবে, তা নির্ভর করে তাতে কী ধরনের গোলা ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। ধারণা করা হয়, এ সিস্টেম ইউক্রেইনকে দিলেও দীর্ঘ পাল্লার গোলা পশ্চিমারা তাদের সরবরাহ করেনি।

তবে ইউক্রেনকে যেসব গোলা সরবরাহ করা হয়েছে, হিমারসের মাধ্যমে সেগুলো দিয়ে ৮০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তূতে আঘাত হানা সম্ভব, যা রাশিয়ার ব্যবহৃত স্মের্চ রকেট সিস্টেমের পাল্লার চেয়ে বেশি।

এসব হিমারস রাশিয়ার রকেট সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম বলে বিবিসির ভাষ্য।

হাউইটজার কামান

আরেকটি সমরাস্ত্র ইউক্রেইনকে এ পর্যন্ত টিকে থাকতে সহায়তা করেছে বলে মনে করা হয়, তা হল এম৭৭৭ হাউইটজার কামান।

রাশিয়ার পিছু হটার পরবর্তী মাসগুলোতে বেশিরভাগ যুদ্ধ দেশটির পূর্বদিকে কেন্দ্রীভূত ছিল। ফলে সেখানে ছিল স্বল্প দূরে আঘাত হানার মত কামান সরবরাহের চাহিদা ছিল। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো এম৭৭৭ সেই চাহিদা অনেকটা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হয়।

পশ্চিমাদের পাঠানো এম৭৭৭ এর পাল্লা রাশিয়ার জিয়াতসিন্ত-বি হাউইটজার মত। তবে রাশিয়ার আরেকটি কামান ডি-৩০ টউট গানের চেয়ে এম৭৭৭ এর সক্ষমতা বেশি।

অ্যান্টি-ট্যাংক উইপন্স

ইউক্রেইনের সমর্থনে পশ্চিমা দেশগুলো কয়েক হাজার এনএলএডব্লিউ বা নেক্সট জেনারেশন লাইট অ্যান্টি-ট্যাংক উইপন সরবরাহ করেছে।এসব অস্ত্র এক শটে যে কোনো ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়।

রাশিয়ার আক্রমণের কয়েকদিনের মাথায় কিইভের অদূরে যতগুলো মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল, তা প্রতিরোধে এসব এনএলএডব্লিউ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

ড্রোন

রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে নজরদারি, লক্ষবস্তু নির্ধারণ ও ভারী সরঞ্জাম সরবরাহে ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে বিশ্লেষকদের ভাষ্য।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তুরস্ক তাদের তৈরি বায়রাক্তার টিবি২ নামের ‘বোমারু’ ড্রোন ইউক্রেইনের কাছে বিক্রি করেছে। ইউক্রেইনকে সমর্থন করতে এসব ড্রোনের খরচ গণ  চাঁদা থেকে সংগ্রহ করেছে তুরস্কের ড্রোন প্রস্তুতকারক কোম্পানি। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বায়রাক্তার টিবি২ ড্রোন খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে যুদ্ধে। এসব ড্রোন ২৫ হাজার ফুট উপরে উঠে নেমে আসার সময় লেজার নিয়ন্ত্রিত বোমা ফেলতে পারে লক্ষ্যবস্তুতে।