বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে ৫ বছরে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শীর্ষ কূটনীতিকের পা পড়ল।
Published : 18 Jun 2023, 02:20 PM
বাণিজ্য, তাইওয়ানসহ নানান ইস্যু নিয়ে টালমাটাল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে চীন সফর শুরু করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
রোববার তার বেইজিংয়ে নামার মধ্য দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে ৫ বছরে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শীর্ষ কূটনীতিকের পা পড়ল, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
অবশ্য ব্লিনকেনের এই সফরেও ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যকার বরফ গলার আশা দেখছেন না মার্কিন কর্মকর্তারা। তাদের প্রত্যাশা, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে আরও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের দ্বার খুলুক।
ফেব্রুয়ারিতেই ব্লিনকেনের চীন সফরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ওড়া সন্দেহজনক এক চীনা গোয়েন্দা বেলুনকাণ্ডে সেই সফর স্থগিত করেছিলেন তিনি। যে পদক্ষেপ চীনকে আরও তাঁতিয়ে দেয়।
জো বাইডেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ব্লিনকেনই এখন পর্যন্ত নতুন ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যিনি চীন গেলেন।
আলোচনার পথ খোলা রাখতে এবং বিরোধ যেন সংঘাতে না গড়ায় তা নিশ্চিতে দুই দিনের এই সফরে তার চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং ও দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই-র সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। তিনি এমনকী চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও বৈঠক করতে পারেন। তবে জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক হবে কিনা, এখনও কোনো পক্ষ তা নিশ্চিত করেনি।
ব্লিনকেনের সফর সামনের মাসগুলোতে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন ও বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডোর সফরের দ্বারও খুলতে পারে বলে অনেকে আশা করছেন। এই সফর এমনকী চলতি বছরের শেষদিকে একটি বহুজাতিক সম্মেলনে শি ও বাইডেনের বৈঠকের মঞ্চও প্রস্তুত করতে পারে।
শনিবার বাইডেন বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি-র সঙ্গে বৈঠক করার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
গত বছরের নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এই দুই নেতার বৈঠক নতুন স্নায়ু যুদ্ধের আশঙ্কা অনেকটাই কমিয়ে এনেছিল, কিন্তু সন্দেহজনক চীনা গোয়েন্দা বেলুনকাণ্ড দুই দেশের উচ্চ-পর্যায়ের যোগাযোগ প্রায় ধসিয়ে দেয়।
অবশ্য কেবল এই দুই দেশই নয়, চীনে ব্লিনকেনের সফরের ওপর বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও চোখ থাকবে। কেননা, বিশ্ব অর্থনীতির এই দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেলে তা শেয়ার বাজার থেকে শুরু করে বাণিজ্যের রুট ও রীতি এবং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
নানান ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছালেও বেইজিং-ওয়াশিংটনের মধ্যকার বিরোধের অন্যতম প্রধান বিন্দু হচ্ছে তাইওয়ান।
স্বশাসিত এই দ্বীপকে চীন নিজেদের বিচ্ছিন্ন অংশ মনে করে, মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানকে একীভূত করতে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করার হুমকিও দিয়ে রেখেছে বেইজিং।
ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে এক চীন নীতি, অর্থ্যাৎ তাইওয়ান চীনের অংশ বলে মানলেও এখনকার স্থিতাবস্থা বহাল রাখতেই আগ্রহী। তাইওয়ান আক্রান্ত হলে তাদের সামরিকভাবে সহযোগিতা করতেও তারা আইনগতভাবে বাধ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সফর বাড়ছে, তাইওয়ানের স্বাধীনতায় সমর্থন দেওয়ার কথাবার্তা মার্কিন অনেক আইনপ্রণেতাই বলাবলি করছেন। গত বছর দ্বীপটিতে তখনকার মার্কিন নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফরকে ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছিল।
এই তাইওয়ানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধ শেষ পর্যন্ত সংঘাতে গড়াবে বলেই অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন।
ব্লিনকেনের সফরে এই বিষয়টি আলোচনায় স্থান পেলেও দুই পক্ষের অবস্থানে কোনো বড় রদবদল দেখা যাবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে বিরোধও প্রকট। যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে চেপে ধরতে চাইছে, বেইজিংয়ের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়েও তারা বেশ উচ্চকিত।
এদিকে প্রশান্ত মহাসাগর, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের ‘ক্রমবর্ধমান’ আগ্রাসী চেহারা নিয়ে চীনের প্রতিবেশীরাও বেশ চিন্তিত। সংঘাত এড়াতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিয়মিত সামরিক বাহিনী পর্যায়ে বৈঠক হোক এমনটা প্রত্যাশাও করছে তারা। এ ধরনের বৈঠকের ব্যাপারে ওয়াশিংটন একের পর এক উদ্যোগ নিলেও চীনের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি, বলছে রয়টার্স।
বেইজিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে ব্লিনকেন বলেছেন, তার এই সফরের মূল লক্ষ্য তিনটি। সংকটকালীন ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি ঠিক করা, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এ সংশ্লিষ্ট উদ্বেগগুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলা ও সম্ভাব্য সহযোগিতার জায়গাগুলো খুঁজে বের করা।
এবারের সফরে চীনে আটক মার্কিন নাগরিকদের প্রসঙ্গও তোলা হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে আশ্বস্ত করেছেন ব্লিনকেন। ওয়াশিংটন এসব আটককে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ অ্যাখ্যা দিয়ে আসছে।
চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্লিনকেনের আলোচনায় স্থান পাওয়া অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যিক ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টিও থাকতে পারে, জানিয়েছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। এই পদক্ষেপ দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন তিনি।
তবে ব্লিনকেনের সফরে শেষ পর্যন্ত কোনো বড় ইস্যুতে ‘ব্রেক থ্রু’ দেখছেন না বেশিরভাগ মার্কিন কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তারা বলছেন, এসব বিষয়ে সহযোগিতার কোনো আগ্রহই চীনের দিক থেকে দেখা যায়নি।