সৌদি-ইরান চুক্তিতে চীনের ভূমিকায় কঠিন পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ভূমিকা ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের ব্যাপক অস্বস্তিতে ফেলেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2023, 09:05 AM
Updated : 11 March 2023, 09:05 AM

সম্পর্ক পুনর্স্থাপনে সৌদি আরব ও ইরানের আকস্মিক চুক্তি তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে লাগাম টানার সম্ভাব্য পথ আর ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিতের সুযোগসহ যুক্তরাষ্ট্রকে কৌতুহলী হয়ে ওঠার অনেক উপাদানই দিচ্ছে।

এতে আরও একটি উপাদান আছে, যা ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের ব্যাপক অস্বস্তিতে ফেলেছে। সেটি হল- শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ভূমিকা, তাও এমন এক অঞ্চলে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের প্রভাবের কথা সুবিদিত।

বেইজিংয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে চারদিনের আলোচনার পর শুক্রবার এ চুক্তির ঘোষণা আসে; চুক্তির আগে ওই আলোচনার খবর প্রকাশ্যে আসেনি বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কারবি শুক্রবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত না থাকলেও, সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়মিতই মার্কিন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য থেকে শুরু করে গুপ্তচরবৃত্তিসহ নানান ইস্যুতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্রমাগত তিক্ত হয়েছে। দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি নিজেদের সীমানা থেকে অনেক দূরে প্রভাব বিস্তার নিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতেছে।

কারবি শুক্রবার ঘোষিত চু্ক্তিতে চীনের ভূমিকাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বলেছেন, ইরান ও এর প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর হামলার পাল্টায় কার্যকর সৌদি প্রতিরোধসহ ভেতরে-বাইরে নানান চাপই তেহরানকে আলোচনার টেবিলে বসিয়েছে বলে মনে করে হোয়াইট হাউস।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেফরি ফেল্টম্যানের মতে, ছয় বছর পর একে অপরের দেশে দূতাবাস খুলতে ইরান-সৌদি আরবের রাজি হওয়ার চেয়েও চীনের ভূমিকাই এই চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক বলে মনে হচ্ছে।

“এটি ব্যাখ্যা করা হবে বাইডেন প্রশাসনের গালে চপেটাঘাত ও চীনের উত্থানের প্রমাণ হিসেবে, যা সম্ভবত সঠিকই হবে,” বলেছেন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো ফেল্টম্যান। 

পরমাণু আলোচনা

এমন এক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে এই চুক্তি হল, যখন তেহরানের পারমাণবিক বোমা অর্জন আটকাতে ২০১৫ সালে তাদের সঙ্গে হওয়া ছয় বিশ্বশক্তির চুক্তি পুনরুজ্জীবনে যুক্তরাষ্ট্রের দুই বছরের ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির গতি বাড়িয়েছে।

ইরানজুড়ে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে কর্তৃপক্ষের সহিংস দমনপীড়ন ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে তেহরানের ওপর কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের এই প্রচেষ্টা খানিকটা ব্যাহত হয়েছে।

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ব্রায়ান কাতুলিস বলছেন, সুন্নি ও শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্স্থাপনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ইরানের পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে থমকে থাকা আলোচনা নতুন করে শুরুর ‘সম্ভাব্য একটি পথ করে দিতে পারে’, কেননা এবার তারা রিয়াদকেও সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে ধরতে পারবে।

“সৌদি আরব ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যদি দুই দেশের মধ্যে নতুন চুক্তিটিকে অর্থবহ ও প্রভাবশালী করতে হয়, তাহলে রিয়াদকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে তার উদ্বেগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে। নাহলে এই চুক্তি কেবলই নামকাওয়াস্তে থেকে যাবে,” বলেছেন তিনি। 

শুক্রবারের চুক্তি ইয়েমেনে শান্তি টেকসই করার সম্ভাবনাও বাড়াচ্ছে; ২০১৪ সাল থেকে দেশটিতে চলে আসা সংঘাতকে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ছায়া যুদ্ধ হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গত বছরের এপ্রিলে ইয়েমেনের বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল, অক্টোবরে চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদ বাড়াতে পক্ষগুলোর মধ্যে আর কোনো নতুন চুক্তি না হলেও এখন সেখানে পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত রয়েছে।

ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত গেরাল্ড ফিয়েরেস্টেইন বলছেন, “কিছু না পেয়ে রিয়াদ এই চুক্তির পথে যেত না, হতে পারে সেটা ইয়েমেনে বা অন্য কোথাও, যা দেখা শক্ত।”

চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব

চুক্তি স্বাক্ষরে চীনের সংশ্লিষ্টতা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ‘বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে’ বলে মনে করছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দূতের দায়িত্ব পালন করা ড্যানিয়েল রাসেল।

তিনি বলছেন, বিবাদের পক্ষ না হয়েও এমন একটি কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরে চীনের নিজ থেকে সহায়তার ঘটনা বেশ অস্বাভাবিক।

“প্রশ্নটা হচ্ছে, এটা কি আসন্ন কোনো কিছুর ইঙ্গিত? যখন শি মস্কো সফরে যাবেন, তখন ইউক্রেইন ও রাশিয়ার মধ্যে চীনা মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে এই চুক্তি কি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করবে?,” বলেছেন তিনি। 

যখন ইরানের কথা আসে, তখন এটি স্পষ্ট নয় যে এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে কি আনবে না, বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ ইরান বিষয়ক বিশ্লেষক নায়সান রাফাতি।

“এমন এক সময়ে এই চুক্তি হল, যখন ওয়াশিংটন ও তার পশ্চিমা অংশীদাররা ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির ওপর চাপ ক্রমশ বাড়াচ্ছিল। চীনের ভূমিকার কারণে এখন তেহরান বিশ্বাস করতে পারবে যে তারা বড় একটি পরাশক্তির ছায়ায় আছে, এটি তাদের ওপর থাকা পশ্চিমা চাপ সরিয়ে দিতে পারবে,” বলেছেন রাফাতি। 

চুক্তিতে চীনের সংশ্লিষ্টতা এরই মধ্যে বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে ওয়াশিংটনকে সংশয়ে ফেলে দিয়েছে।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান প্রতিনিধি মাইকেল ম্যাকল শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে, তাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “বেইজিং দায়িত্বশীল অংশীদার নয় আর তাদেরকে ন্যায্য বা নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিশ্বাস করা যায় না।”

কারবি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যত্র বেইজিংয়ের আচরণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

“চীনের প্রভাব, সেটা আফ্রিকায় হোক বা লাতিন আমেরিকায়, এমন নয় যে আমরা চোখ বুজে রয়েছি। চীন নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অংশে প্রভাব বিস্তার বা পা রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আমরাও তাদের ওপর নজর রাখা অব্যাহত রেখেছি,” বলেছেন তিনি। 

এতকিছুর পরও ইরান-সৌদি চুক্তিতে বেইজিংয়ের সংশ্লিষ্টতা চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিসামর্থ্য ও প্রভাবের বিষয়টিই দৃষ্টিগোচর করছে, যা একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি যে সঙ্কুচিত হচ্ছে, সেই অ্যাখ্যানকেই শক্তিশালী করছে, বলেছেন ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান।

“জোর গলায় না বলেও চীন আসলে যে বার্তাটি দিচ্ছে, তা হল- উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী হলেও, চীনও ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং তাদের কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে,” বলেছেন অল্টারম্যান।

আরও পড়ুন:

Also Read: বৈরিতা ভুলে এক হচ্ছে ইরান-সৌদি আরব, ফের চালু হচ্ছে দূতাবাস