পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে ইমরান খানের নামোল্লেখ করা হচ্ছে না, প্রচার হচ্ছে না তার ছবি ও বক্তব্যও।
Published : 10 Jun 2023, 12:29 AM
অদ্ভুত এক মুহূর্ত ছিল সেটি; মঙ্গলবার রাতে লাইভ টিভি শো চলাকালীন পাকিস্তানি উপস্থাপক কাশিফ আব্বাসি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের বিরুদ্ধে এক আইনজীবীর করা লিগ্যাল পিটিশনের ব্যাপারে কথা বলছিলেন। ইমরান খানের নাম উচ্চারণ করেন তিনি, এর পরপরই থেমে যান।
আব্বাসি বলেন, “অনুচ্ছেদ ৬ এর অধীনে তিনি (আইনজীবী) একটি আবেদন করেছেন ইমরান খানের বিরুদ্ধে…দুঃখিত, পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।”
বিবিসি লিখেছে, তারা টিভি উপস্থাপক আব্বাসির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলোতে গত সপ্তাহ থেকে ইমরান খানের নাম উচ্চারণ কিংবা তার ছবি প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না।
সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই কঠোর পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে দুর্নীতির এক মামলায় মাসখানেক আগে ইমরানকে গ্রেপ্তারের ঘটনা, যাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কেউ কেউ শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করেন, যদিও কোথায় আবার সহিংস বিক্ষোভও হয়।
ওই সময়ে লাহোরের সবচেয়ে সিনিয়র সামরিক কমান্ডারের বাড়িসহ বেশ কয়েকটি সামরিক অবকাঠামো এবং কয়েকটি সেনানিবাসে আক্রমণ হয়েছিল। এসব ঘটনায় ইমরান খানের হাজারো সমর্থককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এসব ব্যক্তিদের সামরিক আদালতে বিচার করতে চায় দেশটির সেনাবাহিনী। কিন্তু সামরিক আদালতে বিচার হলে তা আন্তর্জাতিক আইন বিরুদ্ধ হবে বলে জানায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
পাকিস্তানের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ-পেমরা গত ৩১ মে দেশটির সংবাদ চ্যানেলগুলোতে একটি নির্দেশনা পাঠায়। গত ৯ মে’র সেই ঘটনা উল্লেখ করে নির্দেশনায় বলা হয়, বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা ছড়ানো ব্যক্তিদের সংবাদ চ্যানেলে প্রচার থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
ওই নির্দেশনায় ইমরান খানের নাম উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি; যারা বলেছেন, তাদের চ্যানেলে স্পষ্ট ভাষায় সেই বার্তাটিই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
ওই ব্যক্তিদের বরাতে বিবিসি লিখেছে, ইমরান খানের নামোল্লেখ করা হচ্ছে না, তার ছবি দেখানো হচ্ছে না, তার বক্তব্যও প্রচার করা হচ্ছে না। এমনকি চ্যানেলের টিকারেও তার নামোল্লেখ করার অনুমতি নেই। যদি তাকে উল্লেখ করার প্রয়োজনই হয়, তবে সেক্ষেত্রে তার পদবী ‘পিটিআই চেয়ারম্যান’ দিয়ে তাকে বোঝানো হচ্ছে।
দুটি সূত্রের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, তারা টিভি চ্যানেল মালিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। এসব মালিকদের পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। কর্মকর্তারা তাদের প্রত্যাশা বা নির্দেশনা স্পষ্টভাষায় টিভি চ্যানেল মালিকদের বলে দিয়েছেন।
পাকিস্তান টিভিতে কাজ করা একটি সূত্র বলছে, “মালিকদের বলা হয়েছে, তার (ইমরান খান) নাম রয়েছে এমন কোনো সংবাদ আপনারা প্রচার করবেন না। যদি সেটি করেন, তবে তার দায়ও আপনাদেরই।”
টিভি স্টেশনগুলোর যারা এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তাদের কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি। বিবিসি জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও তারা যোগযোগের চেষ্টা করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু তারা জানায়নি।
পেমরার ডিরেক্টর জেনারেল বলেছেন, তারা টিভি চ্যানেলগুলোতে ওই নির্দেশনা পাঠিয়েছেন, তবে ইমরান খানের নাম উল্লেখ না করার কোনো নির্দেশনা তারা দেননি।
পাকিস্তানে কোনো রাজনীতিককে এমন নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার ঘটনা এটিই প্রথম নয়; এর আগে ইমারন খানের মেয়াদেও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বক্তব্য প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
পাকিস্তানি এক সাংবাদিক বিবিসির ইসলামাবাদ সংবাদদাতা ক্যারোলিন ডেভিসকে বলেন, “পাকিস্তানে সবসময়ই কোনো না কোনোভাবে সেন্সরশিপ ছিল। আমি আইএসপিআর(সেনাবাহিনীর প্রেসউইং) থেকে ফোন পেতাম। বলা হতো, ইমরান খান সম্পর্কে সমালোচনা মূলক কথা বললে তার পরিণতি দেখতে হবে।
“তখন বক্তব্য নেওয়ার জন্য বিরোধী নেতাদের খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল, কারণ তারা জেলে ছিলেন। এখন পিটিআই থেকে কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইমরান খানে রমেয়াদ আর এখনকার সময়ের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো ৯ মে’র সহিংসতার ঘটনায় এসব নিষেধাজ্ঞাকে তারা নায্যতা দিচ্ছে।”
ইমরান খান সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রচার না করার ফলে পাকিস্তানি টিভি চ্যানেলগুলোতে কী প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কে কথা বলেছেন চ্যানেল সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বিষয়টি কীভাবে ম্যানেজ করবেন। ভয়ের বিষয় হলো, পিটিআই সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রচার না করে সরকারি সংবাদ সম্মেলনকে অগ্রাধিকার দিলে শিগগিরই চ্যানেলগুলো মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। এরপরও একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ টিভি চ্যানেলে নজর রাখেন, কারণ তারা ইমরান খান সম্পর্কে খবর পেতে চান। যেদিন তিনি গ্রেপ্তার হন, সেদিন অবিশ্বাস্যভাবে টিভি চ্যানেলগুলোর ভিউ বেড়ে গিয়েছিল।
বিচারবিভাগই একমাত্র আশা: ইমরান খান
ইমরানের গ্রেপ্তার ও মুক্তির পর পিটিআই এর অনেক নেতা দল ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মিডিয়ার ওপর এই সীমাবদ্ধতা এ বছরের শেষ দিকে নির্বাচনের আগে ইমরান খানের প্রভাব কমানোর সর্বশেষ প্রচেষ্টা মাত্র। মিডিয়ার ওপর এই নিয়ন্ত্রণকে যেভাবে দেখা হচ্ছে, সেটির সঙ্গে ভিন্ন মতও পোষণ করেছেন কেউ কেউ।
প্রাক্তন পিটিআই নেতা ও ইমরানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফয়সাল ভাওদা বলেন,“অনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য ইমরানের নাম নিষিদ্ধের কথা বলা হচ্ছে।”
২০২২ সালের শেষের দিকে পিটিআই ছাড়েন ফয়সাল। তার কথায়, পেমরার নির্দেশিকায় কোথাও আনুষ্ঠানিক ভাবে তার (ইমরান) সম্পর্কে বলা হয়নি।
“সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত যে কাউকে অথবা যেকোন ধরনের সহিংসতা মিডিয়ায় প্রচারের অনুমতি দেওয়া হবে না। এটিই এ দেশের মৌলিক আইন। যৌক্তিকভাবে তার নামই এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খায়; কারণ সহিংসতার নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে তিনিই একজন। সাক্ষীদের সকলেই বলছেন, তারা ইমরানের কাছ থেকেই নির্দেশনা পেয়েছিলেন।”
তবে ইমরান খান বলছেন, গোয়েন্দা বাহিনী এই সহিংসতা উস্কে দিয়েছে। যদিও এই বক্তব্যের পক্ষে তিনি প্রমাণ দিতে পারেননি।
এদিকে পেমরার নির্দেশনাকে হতাশাজনক বলে মনে করছেন সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। টিভি নিউজ চ্যানেলগুলোর একজন কন্ট্রিবিউটর বলছেন, ‘এটি (পেমরার নির্দেশনা) প্রহসন মূলক’। গত ৯ মে’র ঘটনা নিয়ে আলোচনায় তিনি অংশ নেন, কিন্তু সেখানে ইমরান খানের নাম নেওয়ার অনুমতি তাকে দেওয়া হয়নি।
ওই কন্ট্রিবিউটর বলেন, “সংবাদমাধ্যমে গেলে তারা আপনাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোনো ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ বা সংগঠন বা কোনো প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপের বিষয়ে কথা বলতে নিষেধ করে। কারণ তাদের ভয়, এটি সংবামাধ্যমটিকে সমস্যায় ফেলবে। এমনকি আপনি যদি তার (ইমরান) নাম উল্লেখও করেন, তার পরিবর্তে তারা ওইখানে বিপ সাউন্ড বসিয়ে দেবে। এটি কেবলই একটি ভয়ে রপরিবেশ। মনে হচ্ছে আমরা সামরিক আইনের অধীনে বাস করছি।”
বিবিসি লিখেছে, প্রভাবশালী সামরিক ও গোয়েন্দাবাহিনীকে বোঝাতে পাকিস্তানে সংক্ষিপ্তভাবে ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, দেশটিতে সাম্প্রতিক দমন-পীড়নের পেছনে তাদের হাত রয়েছে।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে নানা সীমাবদ্ধতার নজির থাকা সত্ত্বেও এটি রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০তম হয়েছে। উদ্বেগ রয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনা এর উপর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
এক সাংবাদিক বিবিসিকে বলেন, “আমি মনে করি (৯ মে থেকে) আমরা মোশাররফ আমল (পারভেজ মোশাররফ) থেকে যে জায়গাটি পেয়েছিলাম, সেটি হারিয়ে ফেলেছি। গত বছরে টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রে যেভাবে সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করা হয়েছিল, সেটি এর আগে কখনও দেখিনি।
“আমি মনে করি সেই জায়গাটি এখন ফিরিয়ে আনতে এক দশক না হলেও আমাদের কয়েক বছর সময় লাগবে।”
আরেক সাংবাদিক বলেন, “এটি একটি নজিরবিহীন পর্যায়। এটি সেই সেন্সরশিপ, যা আসলেই খুব খারাপ। কোনো কিছু করতে গেলে এটি আমাকে দ্বিতীয়বার ভাবায়, আমার টিমও বিষয়টি মাথায় রেখে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে। কোনো শিরোনাম দিতে বা কোনো বিশেষ অতিথিকে আমন্ত্রণ জানাতে ভুল হওয়ার ভয়ে তারা আমার কাছে আসে। কারণ সেই অতিথি ইমরান খানকে উল্লেখ করতে পারে বা তার দলের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে পারে।”
“আপনি জানেনই না যে কখন কাকে তুলে নেওয়া হতে পারে; সত্যিই চাপের মধ্যে আছি।”