আড়াই বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলানো এই ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে এখন ট্রাস আমলের বিপর্যয় সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর গুরুদায়িত্ব নিতে হবে।
Published : 25 Oct 2022, 04:17 PM
তীব্র জ্বালানি সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে দিশাহীন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি, সঙ্গে সামাল দিতে হবে চরম বিভক্ত ও গভীরভাবে আস্থাহীন হয়ে পড়া একটি দলকে। একইসঙ্গে বড় এই দুই সংকট মোকাবেলা করে ঋষি সুনাক কী হয়ে উঠতে পারবেন যুক্তরাজ্যের ত্রাতা?
সিএনএন লিখেছে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে এরই মধ্যে একাধিক রেকর্ড গড়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাবেক চ্যান্সেলর ঋষি সুনাক। গত জুলাই মাস থেকেই যিনি যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে আলোচিত চরিত্র হয়ে ওঠেন।
গত ৫ জুলাই হঠাৎ করেই চ্যান্সেলরের (ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী) পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন সুনাক। তার পরপরই ওই সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের পদত্যাগের ঘোষণা আসে। ব্যক্তিগত নানা কেলেঙ্কারিতে নাজুক অবস্থায় থাকা বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রীত্বে শেষ ধাক্কা হিসেবে দেখা হয় গুরুত্বপূর্ণ ওই দুই মন্ত্রীর পদত্যাগকে।
কারণ, তাদের পদত্যাগের দুইদিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী জনসন পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তার পদত্যাগের পর যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের পরবর্তী নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কে হচ্ছেন সেই আলোচনায়ও জোরেশোরে উচ্চারিত হয় ঋষি সুনাকের নাম। এমনকী দলের বেশিরভাগ এমপি’র সমর্থনও ছিল তার প্রতি। নেতা নির্বাচিত করার প্রথমদফা ভোটে তিনি বিজয়ীও হয়েছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত ভোটে লিজ ট্রাসের কছে হেরে যান।
প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস অবশ্য খুব বেশি দিন ক্ষমতায় টিকতে পারেননি। তার প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদ মাত্র ৪৫ দিন, সঙ্গে পদত্যাগের ঘোষণার পর আরও তিন দিন। কর ছাড়ের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের মন জিতে ঋষিকে পেছনে ফেলেছিলেন ট্রাস, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে চূড়ান্ত ব্যর্থ হওয়ার খেসারত দিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
এরপর আবারও দৃশ্যপটে হাজির ঋষি সুনাক। ট্রাসের পদত্যাগের পর কে হচ্ছেন দল ও দেশের নতুন কাণ্ডারী তা নিয়ে আলোচনায় এবারও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ রাজনীতিক।
পেনি মর্ডান্ট শুরুতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার ঘোষণা দেন। তবে এবার যে দুটি নাম নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছিল তা হল জনসন ও সুনাক। দলের বেশিরভাগ এমপি সরাসরি সুনাককে সমর্থন দেওয়ার কথা জানান। ফলে সহজেই তিনি প্রয়োজনীয় ১০০ এমপির সমর্থন পেয়ে যান।
সোমবার বরিস জনসন নতুন নেতা হওয়ার লড়াইয়ে নামছেন না বলে জানিয়ে দেওয়ার পর তাকে সমর্থন করা এমপিরাও সুনাককে সমর্থন দেন। মোট ১৯৩ জন এমপি সরাসরি সুনাককে সমর্থন করেন।
সমর্থনের লড়াইয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়া মর্ডান্ট পরে এক বিবৃতিতে নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিলে সুনাক হয়ে যান একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী।
ফলে কনজারভেটিভ পার্টির ১৯২২ কমিটির প্রধান গ্রাহাম ব্র্যাডি দেরি না করে দলের নতুন নেতা হিসেবে সুনাকের নাম ঘোষণা করে দেন।
দুই শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে ৪২ বছরের ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনিই সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এজন্য তিনি সময় নিয়েছেন মাত্র সাত বছর।
মঙ্গলবার বাকিংহাম প্যালেসে গিয়ে রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হাতে নেবেন সুনাক। জনসনের সময় আড়াই বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলানো এই ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে এখন ট্রাস আমলের বিপর্যয় সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর গুরুদায়িত্ব নিতে হবে।
চলতি বছরই ট্রাসের সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের লড়াইয়ে নামার সময় তিনি যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাজির করেছিলেন, তার মাধ্যমেই তিনি সেটা করতে পারবেন বলেই অনেকে মনে করছেন।
সুনাক ট্রাসের কর হ্রাস ও ধার করে প্রতিদিনের ব্যয় সামলানোর পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেছিলেন; বলেছিলেন, ওই পরিকল্পনা অর্থনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে।
দেড় মাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ট্রাস তার ‘মিনি বাজেট’ হাজির করে সুনাকের আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে ছেড়েছেন। ওই মিনি বাজেট পাউন্ডের দর কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নিয়ে যায়, বন্ডের দাম ধসিয়ে দেয়, ব্রিটিশ অর্থনীতিকে তুমুল অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেয়।
অবশ্য ট্রাস আসার আগে থেকেই ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বড় ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে জনসন নিজেই সম্মত হয়েছিলেন, সেই চুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লংঘনের একের পর এক হুমকিসহ একাধিক কেলেঙ্কারি যুক্তরাজ্যকে নিয়ে বিশ্বনেতাদের অস্বস্তি ক্রমেই বাড়িয়ে তুলেছিল। ওই কেলেঙ্কারিগুলোর ধাক্কাতেই শেষ পর্যন্ত জনসনকে ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়তে হয়।
তবে তার মানে এই নয় যে, বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাজ্য ব্রাত্য হয়ে গেছে। ইউক্রেইন বিষয়ে লন্ডনের সর্বাত্মক সমর্থন পশ্চিমা নেতাদের কাছে যুক্তরাজ্য, বিশেষ করে জনসনের মর্যাদা অনেকখানি বাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন সোমবার পলিটিকোতে লিখেছেন, “ইউক্রেইনকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে ব্রিটেন সামনের সারিতেই আছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস এই ত্রিমূর্তির অধীনে লন্ডন রাজনৈতিক সংকল্প ও নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিল।”
সুনাকের ক্ষমতায় আরোহন গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাজ্যে যে অস্থিরতা চলছে, তা নিরসনে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় অর্থনীতি দেখভালের দায়িত্বে থাকা, বিপুল পরিমাণ সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সহায়তা করে অসংখ্য লোকের জীবিকা বাঁচিয়ে ব্যাপক প্রশংসা পাওয়া এ রাজনীতিকের এখন একটাই কাজ, দলে ও অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা নিরসন করা। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করা।
সুনাকের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তাকে এখন এমন একটি রাজনৈতিক দল সামলাতে হবে, যেটি শেষ কয়েক বছর ধরে নিজেরাই নিজেদের ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। ২০২২ সালে এসে কনজারভেটিভ পার্টিকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এটি বহুধাবিভক্ত; এর মধ্যে এত এত উপদল যে তা জনসন এবং ট্রাস দুইজনের বিদায়ঘণ্টা বাজাতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কনজারভেটিভ এমপি আর উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন স্বস্তিতে আছেন, কেউ আবার বিরক্ত, চিন্তিত, অনেকেই ভীত।
এদের কেউ কেউ ভাবছেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে খানিকটা মুক্তি জনসাধারণকে স্বস্তি দেবে, কেউ আবার জনসনকে দৃশ্যপট থেকে সরাতে পেরেই তুষ্ট। কেউ কেউ ভাবছেন, সুনাক সম্ভবত ব্রেক্সিট নিয়ে নরম ভূমিকা নেবেন। কেউ আবার আগামী নির্বাচনে কনজারভেটিভদের নিশ্চিত পরাজয়ই দেখতে পাচ্ছেন।
তাত্ত্বিকভাবে সুনাকের হাতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দুই বছরের মতো সময় আছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এ সময়টা কম নয়। সেটা করে জনমত জরিপগুলোতে বেশ পিছিয়ে থাকা টোরিদেরকে জাতীয় নির্বাচনের আগে ফের শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে পুরো দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
কিন্তু কনজারভেটিভ দল যদি শেষ পর্যন্ত গত কয়েক সপ্তাহের মতোই চলে, তাহলে সুনাক দেশের দিকে মনোযোগ দেবেন কী, দল সামলাতেই তার অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠতে পারে।
সুনাককে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হবে দলের ভেতরকার ব্রেক্সিটপন্থি পপুলিস্ট অংশকে নিয়ে, যেটা জনসনের পকেটে আছে।
“বাস্তবতা হচ্ছে, কট্টর ডানপন্থিরা এই মুহূর্তে সম্ভবত কাউকেই সমর্থন দেবে না, কারণ তারা জানে, ব্রেক্সিটের কিছু বিষয় নিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
“সুনাকের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে ব্রেক্সিট পরবর্তী চুক্তির বিতর্কিত নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রটোকল নিয়ে দরকষাকষির বিষয়টি। এটা যদি শেষ পর্যন্ত ওই কট্টর ব্রেক্সিটপন্থি অংশের পছন্দমতো না হয়, তাহলে তারা বাগড়া দিতে পারে,” সিএনএনকে এমনটাই বলেছেন কনজারভেটিভদের সাবেক উপদেষ্টা সালমা শাহ।
ওই অংশকে তুষ্ট করতে সুনাককে মন্ত্রিসভায় এমন অনেককে রাখতে হতে পারে, যারা তাকে জনসনের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য হয়তো কখনোই ক্ষমা করবে না।
অর্থ্যাৎ, নতুন প্রধানমন্ত্রীকে খানিকটা নমনীয় হতে হবে; জনসন ও ট্রাসের জন্যও করার মতো কিছু খুঁজে বের করে দিতে হবে।
সেরকমটা না করতে পারলে আর জনসন যদি ‘প্রতিশোধ পরায়ন’ হয়ে ওঠেন সেক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকরা ব্যাকবেঞ্চ থেকে সুনাকের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারেন।
তবে সুনাকের হাতেও বেশ কার্যকর অস্ত্র থাকছে, তা হল- অর্থনৈতিক নীতি ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক।
“তিনি এমন একজন, রাজনীতির বাইরেই যার ব্যাপক বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা আছে, চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক চরিত্রগুলোর সঙ্গে লেনদেনও করেছেন।
“তিনি যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ সাবলীল এবং অর্থনীতির প্রসঙ্গ এলে কী বলতে হবে তা জানেন। তাই আমার মনে হয়, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাকে বেশ ভালোভাবেই স্বাগত জানাবে,” বলেছেন কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক টিম বেল।