আশাহীন মানুষ ছুটছে বিদেশে, মেধাশূন্য হচ্ছে শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কার মানুষ সরকারের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে। তাদের ভয়, ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ ভোটে আবারও নির্লজ্জদের পক্ষ নেবে। যা মধ্যবিত্তদের দেশত্যাগ ত্বরান্বিত করছে।

রয়টার্স
Published : 19 August 2022, 04:17 PM
Updated : 19 August 2022, 04:17 PM

নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে দেশ, সরকার ব্যবস্থাও বেসামাল। বিশৃঙ্খল এ অবস্থাকে পেছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করতে শ্রীলঙ্কা ছাড়ছেন অনেক মানুষ।

এমনই একজন শামলা ইউসুফ। যিনি কলম্বোতে একজন বিনিয়োগ গবেষক হিসেবে কাজ করতেন। শামলা তার তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে গত জুন মাসে দুবাই চলে যান। তাদের যাওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তার স্বামী দুবাইয়ে একটি কোম্পানির বিক্রয় ও বিপণন পরিচালক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছেন।

৩০ বছরের এই নারী জানেন না কবে নাগাদ তারা আবার দেশে ফিরতে পারবেন, এমনকী আর কখনও দেশে স্থায়ী হতে পারবেন কিনা সেটাও জানেন না। অথচ শামলার স্বামী দেশ থাকতে এবং দেশে থেকে দেশের জন্য কাজ করতে চাইতেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে শামলা বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে শ্রীলঙ্কা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে রাজি করাতে আমার অনেক সময় লেগেছে। কারণ তিনি ওই সব মানুষদের একজন ছিলেন যারা দেশের উপর বিশ্বাস রাখতেন এবং দেশই থাকতে চাইতেন।”

শামলা ও তার স্বামীর মত শ্রীলঙ্কার আরো হাজারো পেশাজীবী দেশ ছেড়েছেন বা ছেড়ে যেতে চাইছেন। যদিও ঠিক কত মানুষ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন তার সঠিক হিসাব নেই।

কিন্তু প্রাথমিকভাব যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে এবং ব্যবসায়ী নেতারা যা ধারণা করছেন, তাতে যে পরিমাণ দক্ষ জনগোষ্ঠী বিদেশে চলে গেছেন বা যাওয়ার চেষ্টা করছেন তা উদ্বিগ্ন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ, দক্ষ জনগোষ্ঠীর অভাব যে কোনো অর্থনৈতিক পুনর্গঠন বিলম্বিত করতে পারে।

শামলা বলেন, গত মার্চ মাস থেকে সংকট ঘণীভূত হতে থাকে। জ্বালানির ভয়াবহ সংকট দেশের অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেয়। সেইসঙ্গে ছিল সরকারের পতনের দাবিতে বিক্ষোভ। যা দৈনন্দিন জীবনকে আরো কঠোর করে তোলে।

‘‘আমরা বুঝতে পারছিলাম, যদি আমরা (তাড়াতাড়ি) দেশ না ছাড়ি তবে আমাদের জন্য সেটা দিন দিন আরো কঠিন হয়ে পড়ছিল।”

শুধু শ্রীলঙ্কা নয় বরং তিউনিসিয়া থেকে হাইতি বা পাকিস্তান, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, প্রতিবাদ ও গণ-অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এমনকি ধনী দেশগুলিও মূল্যস্ফীতির কারণে চাপ অনুভব করছে।

গত মার্চ মাস থেকে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ না থাকায় তারা জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। শুধু জ্বালানি নয় বরং খাদ্য ও ওষুধের মত জরুরি পণ্যও তারা বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে আমদানি করতে পারছে না।

জুলাই মাস থেকে শ্রীলঙ্কায় শুধু স্বাস্থ্য ও কৃষির মত জরুরি সেবা ক্ষেত্রে জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

দেশটিতে খাবারের দাম এখন আকাশছোঁয়া। গত বছরের তুলনায় এ বছর জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ৯০ শতাংশের বেশি। ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ৬০ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি।

শ্রীলঙ্কার অভিবাসীরা বলছেন, তারা সরকারের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের ভয়, ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ ভোটে নির্লজ্জদের পক্ষ নেবে। যা মধ্যবিত্তদের দেশত্যাগে ত্বরান্বিত করছে।

সেখানে চিকিৎসক, সফ্টওয়্যার প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীর মত দক্ষ পেশাজীবীরা উন্নত জীবনের আশায় দেশত্যাগ করছেন। ফলে দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশটিতে দক্ষ জনগোষ্ঠীর অভাব দেখা দেওয়ার উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ইনস্টিটিউট অফ পলিসি স্টাডিজ (আইপিএস) এর মাইগ্রেশন অ্যান্ড আরবানাইজেশন পলিসি রিসার্চের প্রধান বিলেশা বীরারত্নে বলেন, ‘‘সেখানে দক্ষ পেশাজীবীদের দেশ ছাড়া প্রবণতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।”

সরকারি পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, রেকর্ড অনুযায়ী ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রথম ছয় মাসে যথাক্রমে ৪০ হাজার ৫৮১ জন এবং ৩০ ‍হাজার ৭৯৭ জন দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে এরই মধ্যে এক লাখ ১৩ হাজার ১৪০ জন দেশ ছেড়েছেন।

এ সংখ্যা নিশ্চিত হতে রয়টার্স থেকে শ্রীলঙ্কার অভিবাসন কর্মকর্তার কাছে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। কিন্তু দেশটির পাসপোর্ট অফিসগুলোর সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি বলছে তারা দেশ ছাড়তে কতটা মরিয়া।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের প্রথম পাঁচ মাসে দুই লাখ ৮৮ হাজার ৬৪৫টি পাসপোর্ট ইস্যু হয়। যেখানে গত বছর এই সময়ে ৯১ হাজার ৩৩১টি পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছিল।

বিদেশে কর্মসংস্থান:

দক্ষ জনগোষ্ঠী ধরে রাখতে শ্রীলঙ্কার আইটি কোম্পানিগুলো যারা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ, কোয়ান্টাস এয়ারওয়েজ বা বোয়িংয়ের মত বড় বড় বিদেশি কোম্পানিকে বিভিন্ন সহায়তা পরিষেবা দিয়ে থাকে তারা স্থানীয়ভাবে তাদের কর্মীদের বিদেশি মুদ্রায় বেতন দিতে শুরু করেছে।

এ ধরণের আউট সোর্সিং বিশেষ করে প্রযুক্তিখাতে পাওয়া এই বেতন শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি বড় উপায় বটে। কিন্তু এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় দেশের চাহিদা মেটাতে খুব একটা সাহায্য করতে পারছে না বলে জানান এই শিল্পের নেতারা।

কলম্বো ভিত্তিক সফ্টওয়্যার কোম্পানি ‘ডব্লিউএসওটু’ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জীব বীরাভারানা বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে ৮৫০ জন পূর্ণকালীন কর্মী আছেন। এ বছর তাদের ১০ শতাংশ কাজের জন্য বা লেখাপড়ার জন্য বিদেশে চলে যাবে।

‘‘যখন আমরা তাদের (কর্মীদের) জিজ্ঞাসা করি কে কে যেতে চায়, অর্ধেকের বেশি কর্মী বলেছে তারা বিদেশে চলে যেতে চায়। আগামী ছয় ‍মাস পর আমরা এর আসল প্রভাব বুঝতে পারব।”

দক্ষ কর্মীদের ধরে রাখতে কোম্পানিটি কর্মীরা বিদেশে যা উপার্জন করবে তার সঙ্গে কর্মীদের বেতন সমন্বয় করতে চেষ্টা করছে। ফলে কোম্পানির আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে অন্যান্য খাত ব্যয় কমাতে হচ্ছে।

‘‘আমরা যতজন কর্মীকে সম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করছি।”

বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে গত জুন থেকে শ্রীলঙ্কা সরকারও ‘ওয়ার্ক অ্যাবরোড’ প্রকল্প চালু করেছে। এর মাধ্যমে তারা সরকারি খাতের ব্যয়ও কমাতে চাইছে।

তাই সরকারি চাকুরিজীবীদের বিনা বেতনে পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় ছুটি নিয়ে বিদেশে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে শ্রীলঙ্কায় তাদের নামে করা ব্যাংক একাউন্টে তাদের আয়ের একটি অংশ পাঠাতে হবে।

এর ‍মাধ্যমে সরকার বাড়তি রেমিটেন্স পাবে। আর কর্মীরা বর্তমান বেতনের পরিবর্তে ভবিষ্যতের পদোন্নতি ও অবসরভাতার সুবিধা অর্জন করবে।

প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ২০১৮ সালে দেশটি ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রেমিটেন্স পায়। যা শ্রীলঙ্কার মোট জিডিপির ৮ শতাংশ।

দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যান্য বড় ক্ষেত্রগুলো হলো তৈরি পোশাক খাত, আইটি, চা, নারকেল, রাবার, মশলা রপ্তানি এবং পর্যটন।

বীরারত্নে বলেন, দক্ষ জনগোষ্ঠী ‘শাঁখের করাতের মত’। তারা বিদেশে চলে গেলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়বে। কিন্তু যদি অনেক বেশি মানুষ চলে যায়, তবে দেশে আত্মীয়-স্বজন না থাকার কারণে তাদের অর্থ পাঠানো হ্রাস পেতে পারে।

‘‘এছাড়া, অপরিকল্পিত ভাবে এবং অতিরিক্ত পরিমাণে দক্ষ কর্মী যদি বিদেশে চলে যায় তবে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পুনর্গঠন কার্যক্রমের উপরও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

উদ্বেগ:

জ্বালানি সংকট থেকে তৈরি হওয়া বিশৃঙ্খলা, এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়া, প্রতিদিনের লোডশেডিং অথবা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারা ইত্যাদি কারণে মূলত শ্রীলঙ্কার দক্ষ পেশাজীবীরা দেশ ছাড়ছেন।

গত মার্চে দিনের প্রায় অর্ধেক সময় শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুৎ থাকত না।

শামলা বলেন, ‘‘দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ এবং প্রসব-পরবর্তী বিষন্নতার সঙ্গে আমাকে রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে। কখন বিদ্যুৎ থাকবে সেই অনুযায়ী আমি আমার কাজের পরিকল্পনা করতাম।

‘‘কিন্তু যখন সিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং না হয়ে উল্টাপাল্টা সময়ে বিদ্যুৎ চলে যেত আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তাম এবং আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে যেতাম।”

পরিবহনের অভাবে শামলার ছেলে ঠিকমত স্কুলে যেতে পারত না। বাড়িতে সে ‘খুবই অশান্ত এবং ক্ষুব্ধ’ হয়ে যেত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলম্বোর একজন চিকিৎসক বলেন, তার অনেক সহকর্মী চিকিৎসক এবং নার্স এরই মধ্যে বিদেশে চলে গেছন। অনেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

‘‘সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন দক্ষ চিকিৎসাকর্মী গড়ে তুলতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। বিশেষত অস্ত্রোপচার এবং জরুরি বিভাগের জন্য।

‘‘যেভাবে এ খাতের দক্ষ লোকজন দেশ ছাড়ছেন তাতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এর বড় প্রভাব পড়তে যাচ্ছে।”

চারিদিকে নিরাশা:

তবে শুধু অর্থনৈতিক কারণেই শ্রীলঙ্কার দক্ষ পেশাজীবীরা দেশ ছাড়ছেন বিষয়টা তেমন নয় বলেই মনে করেন ৩১ বছরের একজন ‘ইক্যুইটি রিসার্চ অ্যানালিস্ট’। যিনি আগামী অক্টোবরে যুক্তরাজ্য চলে যাচ্ছেন।

বৌদ্ধ অধ্যুষিত শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওই ব্যক্তি বর্তমানে কলম্বোতে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, তিনি শ্রীলঙ্কার মানুষদের ‘উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন’।

‘‘আমরা আবার তাদের মধ্যে (রাজনীতিবিদদের) সবচেয়ে খারাপদের জন্য ভোট দিতে যাচ্ছি, কারণ জাতীয়তাবাদী অনুভূতি দিন দিন প্রবল হচ্ছে।”

শামলা বলেন, তার জন্য দেশছাড়া খুবই কঠিন ছিল।

তিনি বলেন, ‘‘আমার খুব খারাপ লাগছে। কারণ আমি দেশের স্বাধীন শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছি। কিন্তু এখন আমি আমার নিজের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারব না।

‘‘যদি আমরা এখানে থাকতাম। আমি জানি না আমার ছেলে একই মানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেত কিনা। তাই আমাদের সন্তানদের একটি সুন্দর জীবন দিতে আমাদের এটা বেছে নিয়ে হয়েছে।”