একটি মানচিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে বুধবার সন্ধ্যায় ইউক্রেইনে যুদ্ধরত রুশ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন রাষ্ট্রীয় টিভিতে প্রতিরক্ষমন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে খেরসন শহর থেকে রুশ সেনা সরিয়ে নেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছিলেন।
“খেরসন শহর নিয়ে আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নির্ভর করবে সামরিক-কৌশলগত পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায় তার ওপর, এখন এটা (ধরে রাখা) সহজ নয়,” বলেছিলেন তিনি।
ফেব্রুয়ারির শেষদিকে ইউক্রেইনে সেনা পাঠানোর পর খেরসনই ছিল রাশিয়ার দখলে থাকা সবচেয়ে বড় শহর; রসদ সরবরাহের লাইন খোলা রাখতে অসুবিধার মধ্যে রুশ সেনাদের জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে শহরটি ছেড়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সুরোভিকিন এমনটাই বলেছিলেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আল-জাজিরা।
রুশ জেনারেলের ওই বক্তব্যের পর ক্যামেরা শোইগুর দিকে ঘুরে যায়; তখন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীও সুরোভিকিনের পর্যালোচনার সঙ্গে একমত হন এবং দিনিপার নদীর অপর পাশে সৈন্য সরিয়ে আনার নির্দেশ দেন।
এর কয়েকঘণ্টা পর সেদিন রাত ১১টার দিকে স্থানীয় এক বাসিন্দা আল জাজিরাকে জানান, রুশ সামরিক যানের খেরসন ছাড়ার শব্দ পাচ্ছেন তিনি। ইউক্রেইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিশাল প্রদেশটির প্রশাসনিক এ রাজধানী এখনও টিকে থাকা দুটি সেতুর মাধ্যমে রুশ অধিকৃত ক্রাইমিয়াকে সংযুক্ত করেছে।
সেতুগুলোর একটি আন্তোনিভস্কি সেতু, দিনিপারের নীল পানির ওপর এ মাথা ওমাথা প্রায় এক হাজার মিটার লম্বা সেতুটি। ইউক্রেইনের সবচেয়ে বড় নদী দিনিপার সাবেক সোভিয়েতভুক্ত রাষ্ট্রটিকে দুইভাগে ভাগ করেছে, যার বাম পাশে আছে রুশ ভাষাভাষী অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল, আর ডান পাশে ইউক্রেইনীয় ভাষাভাষীদের পশ্চিমাঞ্চল।
অন্য সেতুটি আছে খেরসনের উত্তরপূর্বে নোভা কাখোভকা বাঁধের ওপর, ওই জলাধার দিনিপারের প্রায় ২০ কিউবিক কিলোমিটার পানি ধারণ করে, যার কিছু অংশ পরে ক্রাইমিয়ার দিকেও পাঠানো হয়।
“আমরা একাধিকবার সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছি,” বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খেরসনের ওই বাসিন্দা।
ইউক্রেইনীয় বাহিনী যেন দ্রুত শহরটিতে প্রবেশ করে সেই প্রত্যাশাও জানান তিনি।
কিন্তু ইউক্রেইনের সেনারা তড়িঘড়ি শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে না। অথচ অগাস্টেই তারা দিনিপারের ডান তীরের কয়েক ডজন গ্রাম ও শহর থেকে রুশ সেনাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল।
ক্রেমলিন হুট করে খেরসন থেকে সেনা প্রত্যাহার করেনি। তারা যে সৈন্য সরিয়ে নিতে যাচ্ছে, কয়েক সপ্তাহ ধরেই তা নিয়ে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল।
“খেরসন থেকে পিছু হটা সম্ভবত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যপট,” কয়েকদিন আগে অনলাইন ম্যাগাজিন মেডুজা ডটআইও-কে এমনটাই বলেছিল ক্রেমলিনের একটি সূত্র।
এই সৈন্য প্রত্যাহারকে কীভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে সে বিষয়ে ক্রেমলিন থেকে রুশ গণমাধ্যমের কাছে যে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল, তাও প্রকাশ করে দেয় অনলাইন প্রকাশনাটি।
এদিকে ইউক্রেইনের সমর বিশেষজ্ঞ ওলেহ ঝানভ ধারণা করছেন, রুশ বাহিনীর পিছু হটা আদতে একটা ফাঁদ। ইউক্রেইনীয় সেনারা সেই ফাঁদে পা দিলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা তার।
রুশ সেনারা বেসামরিকের ছদ্মবেশে খেরসনের আবাসিক এলাকায় লুকিয়ে থেকে ইউক্রেইনের সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে পারে।
“ক্যামেরায় মনে হবে, বেসামরিকরা ইউক্রেইনের সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে,” বৃহস্পতিবার টেলিভিশনে এমনটাই বলেছেন তিনি।
ইউক্রেইনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বেশ উদ্বিগ্ন।
“যতক্ষণ পর্যন্ত না খেরসনে ইউক্রেইনের পতাকা উড়ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত রুশ সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে কথা বলা অর্থহীন,” বুধবার টেলিভিশনে দেওয়া মন্তব্যে এমনটাই বলেছেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টের সহযোগী মিখাইলো পোদোলিয়াক।
সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে রুশপন্থি কর্মকর্তারা খেরসনের লাখো বাসিন্দাকে শহরটি ছাড়তে তাগাদা দিয়েছেন, নদীর উভয় তীরের শত শত নৌযান ধ্বংস করে দিয়েছে।
তবে এরপরও অনেকে শহরটিতে থেকে গেছেন।
“আমার মা শহর ছাড়তে রাজি হননি। তিনি এখন তার অ্যাপার্টমেন্টে আলুর বস্তা আর কিছু ম্যাকারনি নিয়ে আছেন,” আল-জাজিরাকে বলেছেন ইউক্রেইনের রাজধানী কিইভের এক বিক্রয়কর্মী আন্তন চেরভেঙ্কো।
খেরসনের আইনপ্রণেতা সেরহি হ্লান অবশ্য বলছেন, পশ্চিমাদের দেওয়া ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ইউক্রেইন যেভাবে দিনিপারের ডান তীরে হামলা চালাচ্ছে তাতে রাশিয়ার জন্য সেখানে সেনা রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়ার সেনারা শিগগিরই পুরো খেরসন ত্যাগ করতে বাধ্য হবে বলেও আশাবাদী তিনি।
“এটা মোটেও ফাঁদ নয়,” বলেছেন হ্লান।
পশ্চিমা অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞও তার সঙ্গে একমত।
“খেরসনের যুদ্ধ শেষ হয়নি। রুশ বাহিনী নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে, ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণ আটকে রাখার বদলে তারা সুন্দরভাবে তাদের সেনাদের নদীর অপর পাশে নিয়ে আসা ও ইউক্রেইনীয় বাহিনীকে দেরি করানোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে,” বুধবার এমনটাই বলেছে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক স্টাডি ফর দ্য ওয়ার।
জার্মান বিশ্লেষক নিকোলাই মিত্রোকিনের আশঙ্কা, শহরটি থেকে রুশ সেনাদের চলে যাওয়ার ফলে দিনিপারের বামপাশ থেকে নির্বিচারে তীব্র গোলাবর্ষণ দেখা যেতে পারে।
বাম তীর থেকে গোলাবর্ষণ করে তারা সহজেই পুরো শহরকে ধ্বংস করে দিতে পারে, যেমনটা তারা খারকিভে করেছে, বলেছেন ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ মিত্রোখিন।
চলতি মাসের শুরুতেই খেরসনের রুশপন্থি প্রশাসন অঞ্চলটির দক্ষিণে হেনিচেস্ক শহরে সরে এসেছে। এরপর হাজার হাজার রুশ সেনা শহরটির বিভিন্ন খালি বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে সেখানকার এক বাসিন্দা।
তাদের উপস্থিতি শহরটির ইউক্রেইনপন্থিদের উপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়েছে; তাদেরকে ‘বেসমেন্ট’ নামে পরিচিত অস্থায়ী কারাগারে রাখা হচ্ছে, বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বাসিন্দা।
“বেসমেন্টে অনেক মানুষ, এমনকী নারীরাও,” বলেছেন তিনি।
ইউক্রেইনের সেনারা রুশ সেনা তাড়ানোর গতি বাড়াবে, এমনকী ক্রাইমিয়াও শিগগিরই মুক্ত হবে বলেই আশাবাদ তার।
“আমার মনে হয়, আমরা খুব তাড়াতাড়িই ইউক্রেইনের ক্রাইমিয়াতে যেতে পারবো,” আল-জাজিরাকে এমনটাই বলেছেন ওই নারী।