ভোট শেষ, রায়ের অপেক্ষায় তুরস্ক

এদিন কোনও প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে আগামী ২৮ মে শীর্ষ দুই প্রার্থীকে নিয়ে হবে রানঅফ ভোট।

রয়টার্স
Published : 14 May 2023, 05:33 PM
Updated : 14 May 2023, 05:33 PM

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে, এবার রায় জানার অপেক্ষা। ২০ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা রিসেপ তায়িপ এরদোয়ানের ভাগ্য এই ভোটের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে।

শক্তিশালী ভূমিকম্প অর্ধলক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার তিন মাস পর তুরস্কের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হয়েছে রোববার।

কেবল প্রেসিডেন্টই নন,  বরং স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলা ভোটে তুর্কিরা নতুন পার্লামেন্ট ও এর ৬০০ এমপিও ঠিক করবেন। রাত নয়টার আগে ভোট গণনার ফলাফল প্রকাশ করা শরু হবে না বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

রোববারের ভোটে এরদোয়ানের প্রধান প্রতিপক্ষ কামাল কিলিসদারোগলু,  ‍জয়ী হলে যিনি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০১৬ সালে ব্যর্থ এক অভ্যুত্থানচেষ্টার পর এরদোয়ান প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করেছিলেন।

কিলিসদারোগলুর পেছনে বিরোধীদের যে জোট আছে, সেটি বেশ বড় হওয়ায় তার জয়ের সম্ভাবনা প্রবল হলেও এরদোয়ানের সঙ্গে তার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলেই মনে হচ্ছে।

এমন এক সময়ে তুরস্কের প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ভোটারকে তাদের নেতা বেছে নিতে হচ্ছে, যখন অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশা মোকাবেলায় দেশটির বেশিরভাগ মানুষই খাবি খাচ্ছেন।

তবে ভোট দানে ভোটারদের উৎসাহে কোনো কমতি ছিল না। বিবিসি জানায়, রোববার ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ভোটকেন্দ্রগুলোর সামনে ভোটারদের লম্বা লাইন পড়ে যায়।

গত ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ভূমিকম্পে রাজধানী আঙ্কারাসহ তুরস্কের ১১টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আঙ্কারায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ এখনো নিজ বাড়িঘরে ফিরতে পারেননি। বিবিসি জানায়, ১০০টির বেশি বাসে করে অস্থায়ী নিবাস থেকে তাদের আঙ্কারায় আনা হয়, যেন তারা ভোট দিতে পারেন।

৭৪ বছর বয়সী কিলিসদারোগলু আঙ্কার একটি স্কুলে ভোট দেন। ভোটাদের ভিড়ে পূর্ণ ওই কেন্দ্রে তিনি স্লোগান দেন, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’। সে সময় একজন ভোটার তাকে ‘গ্রান্ডপা’ বলে ডেকে ওঠেন। তরুণদের মাঝে এই ‘গ্রান্ডপা’ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।

সীমা নামে এক তরুণী কিলিসদারোগলুকে স্বাগত জানাতে তার এক বন্ধুকে নিয়ে ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। তিনি বলেন, ২০ বছরের বেশি পর পরিবর্তন আসতে চলেছে, এটা ভেবেই তিনি চরম আনন্দিত।

সরকারি হিসাবে তুরস্কে মূল্যস্ফীতি ৪৪ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। যদিও প্রকৃত অবস্থা এর চেয়েও বেশি ভয়ানক বলে দাবি অনেকের। তিন মাস আগের জোড়া ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির ১১টি প্রদেশের দশা সবচেয়ে খারাপ। এসব এলাকায় এরদোয়ানের ভোট কমবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

আঙ্কারার এক চশমার দোকানে থাকা বুরাক ওন্ডার জানান, কেউই এখন আর চশমা কিনছে না।

“লোকজন এমনকী ছাড়ের কথাও জিজ্ঞেস করছে না, কারণ ছাড় পরবর্তী দামও তারা দিতে পারবে না,” বলেছেন তিনি।

পুরনো ধাঁচের অর্থনীতি ত্যাগ করে সুদের হার কমানোয় দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে, অথচ পার্শ্ববর্তী ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে সুদের হার বাড়িয়েছে।

চশমার দোকানের কয়েক দরজা পরে, ওই সড়কেই দোকান থাকা রহিমাকে দেখা যায় সব পণ্যের ওপর নতুন মূল্যতালিকা টানাতে। এই কাজ তাকে এখন প্রায় প্রতিদিনই করতে হচ্ছে।

“লোকজন আসে আর জিজ্ঞেস করে, কেন সবসময়ই দাম বাড়ছে। তারা কোনো কিছু না কিনেই চলে যায়,” বলেন তিনি।

কেবল রহিমাই নন, তার ১৯ বছর বয়সী মেয়ে সুদেনুরও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার ইচ্ছা ক্রীড়াবিজ্ঞান পড়া, কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি, তাতে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে বলে আশঙ্কা তার।

তার মতো প্রথমবার ভোটার হওয়ার সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ; এদের রায় রোববারের ভোটে বড় ব্যবধান গড়ে দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জার্মানি, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশে থাকা প্রায় পৌনে দুই কোটি ভোটার এরই মধ্যে তাদের ভোট দিয়ে দিয়েছে। এবার প্রবাসী ভোটের হার ৫৩ শতাংশ, যা নতুন রেকর্ডও গড়েছে।

তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের পক্ষে এবার ভোট দেওয়াটা কষ্টকর হয়ে গেছে। অনেকেই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু ভোট দেওয়া যাবে কেবল নিবন্ধিত এলাকা থেকেই।

ভূমিকম্প পরবর্তী সরকারি তৎপরতা ও পুনর্বাসন এবার নির্বাচনী প্রচারণায় দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। সবার ওপরে ছিল অর্থনীতি।

রোববারের ভোটে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে শীর্ষ দুই প্রার্থীকে নিয়ে আগামী ২৮ মে হবে রান-অফ ভোট।

প্রেসিডেন্টের পদের লড়াইয়ে নামা চার প্রার্থীর মধ্যে মুহররম ইনসে তিন দিন আগে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন; তবে তার আগেই ব্যালট ছাপা শেষ হয়ে যাওয়ায় তার নাম বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

শনিবার প্রচারের শেষ পর্যায়ে কিলিসদারোগলু আধুনিক সেক্যুলার তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

আর ৬৯ বছর বয়সী এরদোয়ান প্রচার শেষ করেন ইস্তাম্বুলের হায়া সোফিয়ায় মাগরিবের নামাজ পড়ে।

তুরস্কের নির্বাচনের দিকে মুসলিম বিশ্ব তাকিয়ে আছে, নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে একে সমাবেশে এ নেতা এমনটা বলেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে।

এ তিনজনের বাইরে ব্যালটে থাকা অন্য নামটি উগ্র-জাতীয়তাবাদী সিনান ওগানের।

তুরস্কে এখন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বেশি হওয়ায় সবার চোখ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে থাকলেও আইন প্রণয়ের গুরুত্ব থাকায় পার্লামেন্ট নির্বাচনও হেলাফেলার নয়।

তুরস্কের সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে পার্লামেন্টে আসন পেতে হলে প্রাপ্ত ভোটের ন্যূনতম ৭ শতাংশ লাগে, যে কারণে বেশিরভাগ দলই জোট করে নির্বাচনে নামে।

এরদোয়ানের একে পার্টিও পিপলস অ্যালায়েন্স নামে একটি জোটের সদস্য, যেখানে জাতীয়তাবাদী এমএইচপি ও আরও দুটি দল রয়েছে।

কিলিসদারোগলুর মধ্য-বামপন্থি রিপাবলিকান পিপলস পার্টির সঙ্গে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স জোটে আছে জাতীয়তাবাদী গুড পার্টি ও আরও চারটি ছোট দল।

কুর্দিঘনিষ্ঠ এইচডিপি তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহৎ বিরোধীদল, তারা অন্য একটি জোটের সদস্য হলেও নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিল গ্রিন লেফট নাম নিয়ে।

শুধু তুর্কিরাই নয় বরং পুরো বিশ্ব গভীর মনযোগে তুরস্কের ভোটের ফলাফলের অপেক্ষায় আছে। এরদোয়ান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র।

যদি এরদোয়ান হেরে যান তবে তা ক্রেমলিনকে খানিকটা হলেও বিচলিত করবে। তবে এরদোয়ানের হার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনসহ অনেক ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে। এরদোয়ানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বেশ জটিল।