রানির সাবেক স্বামী-সন্তানও ছিলেন রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে

ব্রিটিশ রাজপরিবারের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2023, 03:14 PM
Updated : 6 May 2023, 03:14 PM

তালাক হওয়া এক নারীকে বিয়ে করতে চাওয়ায় সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন এক রাজা। অবশ্য ৯ দশক আগের সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই।

এবারের ব্রিটিশ রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে দৃষ্টিভঙ্গিগত বড় পরিবর্তন দেখা গেল। নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা দুজনেরই বিচ্ছেদের ইতিহাস যেমন আছে; তেমনই রানির সাবেক স্বামী অ্যান্ড্রু পার্কার বোলসকে অনুষ্ঠানে দেখে চমকেছেন অনেকেই।

১৯৫৩ সালে যখন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মুকুট লাভ করেন, তখন বছরে প্রায় ৩০ হাজার তালাকের ঘটনা ঘটত। আর তালাক হওয়া ব্যক্তিদের রাজ পরিবারের সান্নিধ্যে যাওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না। সেসময় যুদ্ধ নায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন পিটার টাউনসেন্ডের সঙ্গে প্রিন্সেস মার্গারেটের প্রেম চলছিল; তাদের পরিণয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় টাউনসেন্ডের বিচ্ছেদের ইতিহাস থাকায়।

রাজভক্তরা এ কথা মনে করতে চাইবেন যে, ১৯৬১ সালে রানি রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও ফার্স্ট লেডি জ্যাকুলিন কেনেডি আমন্ত্রণ জানালেও জ্যাকুলিনের বোনকে দাওয়াত দেননি। কারণ ফার্স্টলেডির বোন লি বউভিরের বিচ্ছেদের ইতিহাস ছিল।

কিন্তু ৮৩ বছর বয়সী অ্যান্ড্রু পার্কার বোলসের ক্ষেত্রে তেমনটা হল না, যিনি সবসময় নিজের মতো করে চলেন। তিনি তার সাবেক স্ত্রীর জীবনের সূচির অংশ হয়ে গেছেন, আছেন রাজপরিবারের সংস্পর্শে।

২০০৬ সালে অ্যান্ড্রু ও ক্যামিলার মেয়ে লরা লোপেজের বিয়েতে অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন প্রিন্স চার্লস। সেসময় তাদের ছেলে টম পার্কার বোলসকে দেখা গিয়েছিল চার্লসের পাশে।

রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে অ্যান্ড্রু তার দুই ছেলে-মেয়ে, পাঁচ নাতি-নাতনিসহ অংশ নেন বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক পোস্ট। নাতি-নাতনিরা হলেন ললা, ফ্রেডি, লুইস, গুস লোপস ও এলিজা।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণকারী রাজা তৃতীয় চার্লসের আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয় শনিবার। এদিন রাজার সঙ্গে তার স্ত্রী ক্যামিলাও রানির মুকুট পরেন।

Also Read: ক্যামিলা এখন রানি

Also Read: বন্ধুর পথ পেরিয়ে যুক্তরাজ্যের নতুন ‘কুইন কনসর্ট’ ক্যামিলা

অ্যান্ড্রু-ক্যামিলা-চার্লসের পাশাপাশি চলা

১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে অ্যান্ড্রু পার্কার বোলস নামের এক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে ক্যামিলার এক ধরনের ভাঙা-গড়ার সম্পর্ক চলছিল। এর মধ্যেই ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে উইন্ডসরে একটি পোলো ম্যাচে তরুণী ক্যামিলার সঙ্গে তাৎকালীন প্রিন্স চার্লসের প্রথম দেখা হয়। তখনই দুজনের বন্ধুত্ব হয়ে যায়।

কিন্তু সময়টা ঠিক ছিল না। ১৯৭১ সালে চার্লস রয়্যাল নেভিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তাকে সে সময় বিদেশে অবস্থান করতে হয়েছিল। আর ওই সময়টাতেই ক্যামিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন অ্যান্ড্রু পার্কার বোলস। ক্যামিলাও তা গ্রহণ করেন।

তিনি চার্লসকে জিজ্ঞাসা করার জন্য অপেক্ষা করলেন না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ক্যামিলার বন্ধু-বান্ধবদের ধারণা, নিজেকে রানির আসনে দেখার কথা তিনি হয়ত ভাবেননি।

ওদিকে চার্লস প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, এমন বোধ হয়ত করেও থাকতে পারেন। কিন্তু তারপরও একে অপরের জীবনের অংশ হয়ে ছিলেন। একই সামাজিক আবহে তারা একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। ক্যামিলার স্বামী অ্যান্ড্রুর সঙ্গেও চার্লস সদ্ভাব রেখে চলতেন।

এই মেলামেশার মধ্যেই ১৯৮১ সালে চার্লস বিয়ে করেন ডায়ানাকে। কিন্তু বিয়ের পরও ক্যামিলাকে ভুলতে পারেননি চার্লস। গোপনে ক্যামিলা ও চার্লসের প্রেম নিয়ে সে সময় অনেক কানাঘুষাও হয়। পরে ডায়ানা প্রকাশ্যেই যেমন এই প্রেম নিয়ে কথা বলেছিলেন, তেমনি ১৯৯৪ সালে চার্লসও স্বীকার করেছিলেন ক্যামিলার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা।

এ ঘটনা নিয়ে চার্লস ও ক্যামিলা দুইজনেরই বিবাহিত জীবন ভাঙনের দিকে যেতে থাকে। ১৯৯৫ সালে অ্যান্ড্রু পার্কার বোলসের সঙ্গে ক্যামিলার বিচ্ছেদ হয়। এর এক বছর পরই ডায়ানার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় চার্লসের।

১৯৯৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানার মৃত্যুর পর সমালোচনার ঝড় সামাল দেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেও চালর্স ও ক্যামিলার একে অপরের প্রতি টান থেকেই গিয়েছিল। ধীরে ধীরে জনসমক্ষে একসঙ্গে উপস্থিত হতে শুরু করেন তারা।

১৯৯৯ সালে প্রথম রিজ হোটেল থেকে দুইজনকে একসঙ্গে চলে যেতে দেখা যায়। সেটাই প্রকাশ্যে আসার শুরু। এর ছয় বছর পর ছোট্ট একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা বিয়ে করেন।

বিবিসি লিখেছে, ক্যামিলাকে মেনে নিতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অনেক সময় লেগেছিল। কিন্তু রানি তার শেষ সময়গুলোতে দ্ব্যর্থহীনভাবেই ক্যামিলার সমর্থনে কথা বলতেন। তবে ক্যামিলাকে ‘রানি’ উপাধি দেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক ছিল।

স্বামী চার্লস রাজা হলে ক্যামিলার আপনা থেকেই রানি হওয়ার কথা। কিন্তু ক্ল্যারেন্স হাউজ থেকে ২০০৫ সালের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ক্যামিলা রানি নয় বরং ‘প্রিন্সেস কনসর্ট’ হিসাবে পরিচিত হবেন। কারণ, সে সময় রাজপরিবারের কেউ কেউ মনে করতেন, জনগণ হয়ত ক্যামিলার রানি উপাধি এখনও মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়, যে উপাধি আদতে পাওয়ার কথা ছিল ডায়ানার।

কিন্তু বছরের পর বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্যামিলার প্রতি রাজপরিবার-সহ আমজনতার মনোভাব নরম হয়েছে। ২০১৫ সালে সিএনএন পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি চার জনে একজন ব্রিটিশ ক্যামিলাকে আগের চেয়ে বেশি পছন্দ করছেন এবং তার রানি উপাধি পাওয়া নিয়ে বিরোধিতা করা মানুষের সংখ্যাও কমেছে।

তবে ক্যামিলাকে ‘রানি’ উপাধি দেওয়া নিয়ে বিতর্কটি পরে সমাধা করেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। গত বছরের শুরুর দিকে রানি বলেছিলেন, তিনি চান ছেলে চার্লস রাজা হলে ‘কুইন কনসর্ট’ হিসেবেই পরিচিত হোন ডাচেস অব কর্নওয়াল ক্যামিলা। রানির ওই এক কথাতেই পরে বিষয়টি নিয়ে সব বিতর্কের অবসান হয়।