তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের কী?

প্রথম দফা ভোটে ফল আসেনি; তাই দ্বিতীয় দফা ভোটের মুখে এরদোয়ান।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 03:22 AM
Updated : 21 May 2023, 03:22 AM

প্রথম রাউন্ডে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে এক সপ্তাহের মধ্যে ফের ভোট দেবেন তুরস্কবাসী।

নির্বাচনে যে জিতবে, তার উপর নির্ভর করবে তুরস্কের ভিন্ন রকমের ভবিষ্যৎ; ফলে বিশ্ব এ নির্বাচনের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে বলে লিখেছে বিবিসি।

তুরস্কের আলোচিত নির্বাচন, তার ফল নিয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা বিশ্লেষণ করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যমটি।

তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান দুই দশক ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। পূর্ব ও পশ্চিমের সঙ্গেও সম্পর্ক ধরে রেখেছেন। কিন্তু তার কর্তৃত্ববাদী শাসন কিছু মিত্রের সঙ্গে মন-কষাকষিও তৈরি করেছে।

নির্বাচনে এরদোয়ানের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিসদারোগলু তুরস্কে গণতন্ত্র ফেরানো এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও বিশ্ব মঞ্চে তার অবস্থান এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তার সক্ষমতা নিয়ে তুরস্কেই কারও কারও সংশয় রয়েছে। যেখানে এরদোয়ান এই দুই ক্ষেত্রে বিশ্বে নিজেকে ‘ট্রেডমার্ক’ করে তুলেছেন।

গত ১৪ মে ভোটের প্রথম রাউন্ডের আগের জরিপগুলো দেখাচ্ছিল, দুই প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হবে। কিন্তু ভোট গণনার পর এরদোয়ান এই ভবিষ্যদ্বাণী উড়িয়ে দেন। ভোটে এগিয়ে তিনি এমন অবস্থানে রয়েছেন, যেটি উল্টানো তার প্রতিপক্ষের জন্যও কঠিন হবে।

তুরস্কের সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিলের (ওয়াইএসকে) পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রথম রাউন্ডে এরদোয়ান বা তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিসদারোগলু কেউই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। ভোটের প্রাথমিক ফলে এরদোয়ান ৪৯ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং কিলিসদারোগলু ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

ফলে পরবর্তী ভোটের গুরুত্ব কতটা, তা বাখ্যা করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক সাবেক প্রধান ব্যারনেস অ্যাশটন বলেন, “তুরস্ক এমন একটি দেশ, যাকে আমি ‘সুইং স্টেট’ হিসাবে বর্ণনা করে থাকি।

“তুরস্কের গণতন্ত্র আর এই অঞ্চলে তার অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু ঘটে, তা ইউরোপ, এশিয়া ও অবশ্যই সমস্ত বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা আমরা সকলেই মোকাবেলা করছি৷ ফলে এই নির্বাচন সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।”

Also Read: এরদোয়ানের ভোট নিয়ে কেন বাইডেনের মাথাব্যথা?

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে মূল্যবান কূটনৈতিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে তুরস্ক। যুদ্ধরত দেশ দুটির মধ্যে প্রাথমিক আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সাফল্য দেখিয়েছে ইউক্রেইনের গুরুত্বপূর্ণ শস্য রপ্তানি চুক্তিতে সমঝোতা করে। এর ফলে কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেইনের শস্য রপ্তানির পথ খুলেছে।

এছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের শি জিনপিং পর্যন্ত সকলের সঙ্গে যোগাযোগের পথ খোলা রাখায় নিজেকে গর্বিতও ভাবতে পারেন এরদোয়ান।

ইস্তাম্বুলের ওয়েজিন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইভরেন বাল্টা বলেন, “পশ্চিমের অংশ হওয়ার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা তুরস্কের সবসময়ই ছিল। এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন একে পার্টির দুই দশকের মেয়াদেও এটি পরিবর্তন হয়নি।”

কিন্তু তুরস্কের আন্তর্জাতিক জোটগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে জানিয়ে বাল্টা বলেন, “আমরা যাকে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বলি, সেই ধারণা অনুসরণ করেছে তুরস্ক। এই ধারণার মানে, দেশগুলো একের অধিক দেশের সঙ্গে জোটবদ্ধ কিংবা একাধিক নিরাপত্তা ছাতার তলে চলে আসতে পারে।”

তুরস্কের একাধিক সম্পর্ক ও সেগুলো পরিচালনার করার সক্ষমতা মূল্যবান হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে; যদিও সেই চিত্র সবসময় সুখকর নয়।

উদাহরণস্বরূপ নেটো সামরিক জোটের কথাই ধরা যাক, যেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী রয়েছে তুরস্কের। এর অন্য সদস্যরা মনে করে, এই সামরিক জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন যুক্ত হলে পুরো ব্লকের নিরাপত্তা শক্তিশালী হবে।

কিন্তু এখানে তুরস্কই একমাত্র ভিন্নমত দিয়েছে। ফিনিশদের সদস্যপদ লাভ করিয়ে দিয়ে সুইডেনের সদস্যপদ হওয়ার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে তুরস্ক।

তুরস্ক বলছে, তার বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সাল থেকে লড়াই করে আসা কুর্দি বিদ্রোহী গ্রুপ ‘পিকেকে’ এর কয়েক ডজন সুইডিশ বিদ্রোহীকে সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তারা নেটোতে সুইডেনের সদস্যপদে সমর্থন দেবে না।

আঙ্কারা পলিসি সেন্টারের লন্ডন প্রতিনিধি সেলিন নাসি মনে করেন, তুরস্কে এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন নেটোর সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করতে পারে।

কিলিসদারোগলু তুরস্কে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এস৪০০ নিয়ে তথাকথিত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন; যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে তাদের এফ-৩৫ ফাইটার জেট প্রোগ্রামের সঙ্গে পরস্পরবিরুদ্ধ বলে মনে করে। ২০১৯ সালে তুরস্ককে এফ-৩৫ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন এরদোয়ানের প্রতিপক্ষ কিলিসদারোগলু এই পদক্ষেপ পুনরায় চালুর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।

সেলিন নাসি বলেন, “এখনকার পরিস্থিতিতে তুরস্ক একটি মিত্র; কিন্তু নেটোর প্রতি তার আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের কথা মনে করুন।

“আমরা একটি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসেছি। সেখানে (বালি) একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তুরস্ককে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটি নেটোতে তুরস্কের দ্ব্যর্থক অবস্থান তুলে ধরে। এই সন্দেহ আর সিদ্ধান্তগুলো কাটিয়ে উঠতে আমি মনে করি, এস৪০০ সমস্যা দ্রুত সমাধান করা দরকার। আর সেটি যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই ভালো।

”নেটোর পরে তুরস্কের জন্য আরেকটি বিষয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ১৯৯৯ সালে এর সদস্য হিসেবে তুরস্কে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার বিষয়ে তুর্কি সরকারের রেকর্ড সমালোচনার পর তুরস্কের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়।

বিবিসি লিখেছে, কিলিসদারোগলু ও বিরোধীরা জানিয়েছেন, এই বিষয়গুলো তারা আবার ঠিক করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তা কি আসলে সহজ লক্ষ্য হবে?

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রধান উপদেষ্টা ইলনুর সেভিক অবশ্য সেটি মনে করেন না। তার মতে, বিরোধীদলীয় নেতা (কিলিসদারোগলু) ছেলে ভোলানো কথাবার্তা বলছেন।

ইলনুর সেভিক বলেন, “ইইউ সর্বদা আমাদের পূর্ণ সদস্য হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। তিনি (কিলিসদারোগলু) বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে তিন মাসের মধ্যে এমন পরিবেশ তৈরি করবেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুর্কিদের ভিসামুক্ত চলাচলের অনুমতি দেবে। এগুলো নির্বোধের মতো কর্থাবার্তা।”

খানিকটা কাব্যিক ভঙ্গিতে ফাইক টুনে বলেন, “আমি ইইউ ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ককে একটি অসম্ভব প্রেমের গল্প হিসেবে দেখব।”

কিলিসদারোগলু বিরোধী জোটের অন্যতম সদস্য ডেমোক্র্যাট পার্টির ডেপুটি চেয়ার টুনের ভাষ্য, “অবশ্যই তুরস্ক অনেক ভুল করেছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা অন্য কোনো বিষয়ের মত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া হোমওয়ার্ক সম্পূর্ণ করেনি তুরস্ক। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে যদি তারা ইইউর মান শতভাগ ধরতে পারে, তাহলে ইইউ বা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।”

Also Read: এরদোয়ানের ভাগ্য এখন সিনান ওগানের হাতে?

১৪ মে প্রথম দফার ভোটের পর থেকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হিসেবে তুরস্কে ৩ লাখ ৬০ হাজার সিরীয় শরণার্থীর মর্যাদা এখন মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। মূল প্রচারে উভয় পক্ষই এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যতটা সম্ভব সিরিয়ান শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

কিন্তু রান-অফ ভোট (২৮ মে) ঘনিয়ে আসায় শরণার্থী প্রসঙ্গটি মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। তুরস্কের প্রত্যেকেই এই বিষয়ে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে দাঁড়াতে চায়।

বিবিসি জানিয়েছে, এটি তুরস্কে অবস্থান করা সিরিয়ানদের জন্য একটি উদ্বেগজনক মুহূর্ত। তদের ভয়, এমন একটি দেশে তারা ফিরে যেতে চলেছে যে, সেটি এখনও অনিরাপদ। এই বিষয়টি বিশ্বের অন্যান্যদেরও মাথাব্যথা তৈরি করতে পারে। যদি তুরস্ক শরণার্থীদের প্রতি তাদের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, তবে বিশ্বের অন্যদের এই সমস্যাটি মিটমাট করা লাগতে পারে।

মানবাধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে তুরস্কের অতীতের ভালো-মন্দের ইতিহাস পশ্চিমাদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক জটিল করে তুলছে। বিরোধীরা জোর দিয়ে বলছে, তারা জয়ী হলে এই বিষয়গুলো তারা ভালো করার চেষ্টা করবে। তাদের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম বার্তা হল, তুরস্কে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা।

আঙ্কারা পলিসি সেন্টারের সেলিন নাসি বলেন, “কোনো ভিন্ন সরকারের অধীনে যদি আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কোনো উন্নতি দেখতে পাই, তাহলে সেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্কের ভাবমূর্তি উন্নত করবে।

“এরদোগানের বিজয়ের মানে এও, রাজনৈতিক বন্দিরা কারাগারেই থাকবে।”

প্রেসিডেন্ট বাছাইয়ে তুর্কিরা তাদের পছন্দের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখছেন। দেশের অর্থনৈতিক সংগ্রামের মত ঘরোয়া সমস্যাগুলোর বেশিরভাগ ভোটারদের মনের মধ্যে রয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে বিশ্বে তুরস্কের অবস্থান কারও কারও কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতে পারে। তবে এর পরবর্তী বিবেচনার বিষয় হতে পারে, তুর্কি পরবর্তী নেতা যে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করবেন, তা দেশের কয়েক দশকের ভবিষ্যত স্থিতিশীলতা ও সাফল্য নির্ধারণ করবে।