ছয় দশক আগের পদ্ধতিতে ফিরে বিশ্ব রেকর্ড গড়তে চায় ১৪০ কোটি মানুষের দেশটি।
Published : 13 Dec 2024, 01:14 PM
ভারত নিজেদের এমন এক নির্বাচনি মডেল করতে চাইছে, যেখানে নাগরিকরা একসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য (ফেডারেল) সরকার নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে।
এনডিটিভি লিখেছে, ভারতে এই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতির চেষ্টা এই প্রথম নয়। ১৯৪৭ সালে তারা যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন দেশটির প্রতিষ্ঠাতারা একসঙ্গে সংসদীয় ও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের মডেল পরিকল্পনা করেন। ১৯৫২ সালে প্রথম নির্বাচন থেকে ভারতে এভাবেই ভোট হয়ে আসছিল।
তবে সবকিছু বদলে যায় ১৯৬৭ সালে, যে বছর ভারত শেষবারের মতো 'এক দেশ, এক নির্বাচন' পদ্ধতিতে ভোট দেয়। সেই সময়ে উত্তর প্রদেশ (সাবেক যুক্তপ্রদেশ) ছাড়া সবখানে একসঙ্গে ভোট হয়েছিল; উত্তর প্রদেশে ভোট হয়েছিল চার দফায়।
ওই বছরের ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ হয়। এটি ভারতের চতুর্থ নির্বাচন ছিল এবং ৫২০টি লোকসভা আসন এবং ৩,৫৬৩টি বিধানসভা আসনে সাংসদ ও বিধায়ক নির্বাচনের জন্য ভোটগ্রহণ করা হয়।
এরপর জোট রাজনীতি তুঙ্গে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত দেশটিতে একযোগে ভোটের রীতির অবসান ঘটে। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসই ছিল একমাত্র দল- যারা ভারত শাসন করেছে, কিন্তু ততদিনে তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু; তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী প্রধান শরিকদের চাপের মুখে পড়েন। কংগ্রেস বড় আকারের ‘ক্ষমতাসীন-বিরোধী’ মনোভাবের (ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে ভোট) মুখে পড়ে, পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়। সবমিলিয়ে ১৯৬২ সালে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে যায় ভারত।
এনডিটিভি লিখেছে, ছয় দশক পর ভারত এখন ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ পদ্ধতি ফের চালু করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী নেতৃাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই প্রস্তাবে সায় দিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিল অনুমোদন করেছে। বিলটি পাসের জন্য পার্লামেন্টের চলমান অধিবেশনে তোলা হতে পারে।
দেশে দেশে যুগপৎ নির্বাচন
যুগপৎ ভোট ব্যবস্থা ফেরানোর আগে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্যানেল গঠন করা হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোবিন্দ। অতীতে ভারতে কীভাবে এমন নির্বাচন পরিচালনা হয়েছিল এবং সেই সময়ে ফাঁকফোকরগুলো কী ছিল তাই কেবল এই প্যানেল খতিয়ে দেখেনি; বিশ্বজুড়ে কীভাবে এমন নির্বাচন পরিচালিত হয় তা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণাও চালিয়েছে।
এনডিটিভি লিখেছে, বিশ্বব্যাপী গবেষণার সময় প্যানেলটি সাতটি দেশের উপর নজর দিয়েছিল, যারা সফলভাবে একযোগে নির্বাচন পরিচালনায় সফলতা দেখিয়েছে। এই সাত দেশ হচ্ছে- দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স ও জাপান। ওই প্যানেল তাদের অনুসন্ধান এবং নিজেদের প্রস্তাবিত মডেল চলতি বছরের শুরুতে প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে জমা দেয়।
প্যানেল তার প্রতিবেদনে বলেছে, এ ধরনের নির্বাচনি প্রক্রিয়া রয়েছে- এমন দেশগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের কার্যকারিতা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। সর্বোত্তম আন্তর্জাতিক অনুশীলন শিখতে ও তা গ্রহণ করতে এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে যুগপৎ নির্বাচন পরিচালনাকারী বিভিন্ন দেশের একাধিক মডেল নিয়ে বোঝাপড়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “দক্ষিণ আফ্রিকায় ভোটাররা একইসঙ্গে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভার জন্য ভোট দেন। তবে পাঁচ বছরের চক্রে যে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা প্রাদেশিক নির্বাচন থেকে আলাদাভাবেই অনুষ্ঠিত হয়।”
প্যানেল বলেছে, সুইডেন একটি আনুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা রয়েছে। এর মানে হচ্ছে- একটি রাজনৈতিক দল অ্যাসেম্বিলিতে কতটি আসন বরাদ্দ পাবে তা নির্ভর করে ভোটের হিস্যার ওপর।
“তাদের এমন এক পদ্ধতি রয়েছে- যেখানে পার্লামেন্ট (রিকসড্যাগ), কাউন্টি কাউন্সিল এবং পৌর কাউন্সিলের নির্বাচন একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি চার বছর অন্তর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় রোববার এই ভোট হয়, যেখানে মিউনিসিপ্যাল অ্যাসেম্বলির ভোট হয় প্রতি পাঁচ বছরে একবার, সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় রোববার।”
বিশেষজ্ঞ প্যানেলটি নির্বাচনের জার্মান মডেলও বোঝার চেষ্টা করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জার্মানিতে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগে চ্যান্সেলর নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অনাস্থা ভোটের সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে সম্ভাব্য উত্তরসূরির ইতিবাচক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে পার্লামেন্টে সরকার প্রধানের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করা যায়।
জাপানে প্রথমে ন্যাশনাল ডায়েটে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচিত করা হয়, যাকে অনুমোদন দেন সম্রাট। প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পরামর্শ দিয়েছেন যে- ভারতের উচিত ‘জার্মানি ও জাপানের মতো মডেল গ্রহণ করা’।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের মতো ইন্দোনেশিয়াও ২০১৯ সালে 'এক দেশ, এক নির্বাচন' পদ্ধতি চালু করেছে। প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, এমপি এবং আঞ্চলিক আইনসভার সদস্য এবং পৌর ভোট একই দিনে হয়।
উচ্চ পর্যায়ের প্যানেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'জাতীয় পার্লামেন্টের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ৪ শতাংশ ভোটের প্রয়োজন। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে হলে সারাদেশে পড়া ভোটের অর্ধেকের বেশি যেমন পেতে হয়, তেমনই অর্ধেকরও বেশি প্রদেশের ভোটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ পাওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইন্দোনেশিয়া সফলভাবে যুগপৎ নির্বাচন আয়োজন করেছে। প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, এমপি, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও পৌর নির্বাচনে প্রায় ২০ কোটি মানুষ অংশ নেওয়ার পর এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম যুগপৎ নির্বাচন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
এনডিটিভি লিখেছে, ১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ ভারত এখন বৃহত্তম যুগপৎ নির্বাচন আয়োজন করে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। ২০২৯ সালে সেই আয়োজন হবে কি না- তা এখনও নিশ্চিত নয়। তার আগে প্রস্তাবটিকে পার্লামেন্টে পাস হতে হবে।