ইনডিপেনডেন্টের বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদন বলছে, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ‘একচ্ছত্র’ সিদ্ধান্ত খুব কম ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী জাতির জন্য ভালো কিছু বয়ে এনেছে।
Published : 19 Feb 2025, 09:15 AM
ইউক্রেইন নিয়ে চলতি সপ্তাহে সৌদি আরবে আলোচনায় বসেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা, যেখানে ‘আলোচ্য’ দেশকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আলোচনায় যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, তারা মেনে নেবেন না।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেইনকে ছাড়াই তাদের সার্বভৌমত্বের আলোচনা কিংবা তাদেরকে সহায়তার বিনিময়ে অর্ধেক খনিজ সম্পদ দাবি করার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, দেশটির প্রতি কিংবা ইউরোপের প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন।
যাদের বিষয়ে আলোচনা, তাদেরকে না রাখার ঘটনা অবশ্য এটাই প্রথম নয়। ইতিহাসে এমন বহু নজির আছে, যেখানে নতুন সীমানা কিংবা আধিপত্যের রেখা টানার সিদ্ধান্তে সেখানকার জনগণের মতামতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরে ইনডিপেনডেন্টের ওই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলছে, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর এমন ‘একচ্ছত্র’ সিদ্ধান্ত খুব কম ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী জাতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পেরেছে।
১৮৮৪ থেকে ১৮৮৫ সালে ইউরোপের দেশগেুলোকে বার্লিনে এক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান জার্মানির তৎকালীন নেতা অটো ভন বিসমার্ক।
পুরো আফ্রিকা মহাদেশ নিজেদের মধ্যে কীভাবে ভাগ-ভাটোয়ারা করবেন, সেটা চূড়ান্ত করতেই ওই সম্মেলন ডাকেন তিনি, যেখানে আফ্রিকা থেকে একজনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ওই সম্মেলনের একটি সিদ্ধান্ত ছিল ‘কঙ্গো ফ্রি স্টেট’ সৃষ্টি, যার নিয়ন্ত্রণে ছিল বেলজিয়াম। পরবর্তী সময়ে ওই অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে লাখ লাখ আফ্রিকানকে জীবন দিতে হয়।
ওই সম্মেলনের পর ‘জার্মান সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকা’ (বর্তমানে নামিবিয়া) প্রতিষ্ঠা করে জার্মানি, যেখানে পরবর্তী সময়ে সংঘটিত হয় বিংশ শতাব্দির প্রথম গণহত্যা।
ইতিহাস বলছে, এমন ‘ভাগ-বাটোয়ারা’ শুধু আফ্রিকার ক্ষেত্রেই ঘটেনি। ১৮৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে একটি সম্মেলন হয়।
ওই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সামোয়া দ্বীপপুঞ্জকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় তারা। সামোয়ানরা বিরোধিতা করলেও তা পাত্তা পায়নি।
সেখানে কোনো ভাগ না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে টঙ্গোয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয় যুক্তরাজ্য।
‘জার্মান সামোয়া’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত নিউ জিল্যান্ডের অধীন ছিল। ‘আমেরিকান সামোয়া’ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই আলোচনায় বসে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। অটোমান সাম্রাজ্যের ভাগ-বাটোয়ার কেমন হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতেই ওই আলোচনায় বসে তারা। ‘শত্রুপক্ষ’ হওয়ায় সেই আলোচনায় অটোমানের কাউকে ডাকা হয়নি।
এরপর গত শতাব্দির গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া জর্জেস-পিকট নিজেদের দেশের স্বার্থে গোপনে মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করেন।
এটি তারা করেন ‘সাইকস-পিকট চুক্তির’ মাধ্যমে, যা ‘হুসেন-ম্যাকমাহন’ চিঠিতে ব্রিটেনের দেওয়া প্রতিশ্রুতির পরিপন্থি ছিল। ওই চিঠিতে তুরস্ক থেকে আরব স্বাধীনতাকে সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল।
সাইকস-পিকট চুক্তিটি বেলফোর ঘোষণায় ব্রিটেনের দেওয়া প্রতিশ্রুতিরও সাংঘর্ষিক ছিল, যেখানে তারা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভূমি তৈরিকে সমর্থন করেছিল।
‘সাইকস-পিকট চুক্তি’ মধ্যপ্রাচ্যে বহু বছরের সংঘাত এবং ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থার সূচনা ঘটিয়েছিল, যার প্রভাব আজও দৃশ্যমান।
১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘মিউনিখ চুক্তিতে’ সই করেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড ডালাডিয়ার, ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনি ও জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার।
হিটলার বাহিনী চেকোস্লোভাকিয়ার জার্মান-ভাষী অঞ্চল সুডেটেনল্যান্ডে আক্রমণ শুরুর পর যুদ্ধের বিস্তৃতি এড়ানোই ছিল এই চুক্তির লক্ষ্য।
ওই চুক্তি করার সময়ও চেকোস্লোভাকিয়ানদের ডাকা হয়নি। ইতিহাসে এই চুক্তি কখনো হিটলারকে ‘তুষ্ট করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা’, কখনো আবার ‘মিউনিখ বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবেও মূল্যায়ন করা হয়।