Published : 29 Apr 2025, 08:55 PM
ওয়াশিংটন ডিসির রেবার্ন হাউজ অফিস ভবনে ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক কংগ্রেস ব্রিফিংয়ে উঠে এসেছে মিয়ানমারে চলমান মানবিক ও ধর্মীয় সঙ্কটের প্রসঙ্গ।
‘বার্মা: মানবিক সংকট এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক এই ব্রিফিংয়ে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে মানুষের সুরক্ষায় নানা চ্যালেঞ্জ এবং গত ২৮ মার্চের ভয়াবহ ভূমিকম্পের বিপর্যয় নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
‘বার্মা রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (বিআরআই) অন্যান্য এডভোকেসি গ্রুপগুলোর সহযোগিতায় এই ব্রিফিং আয়োজন করেছে। ব্রিফিংয়ের বক্তারা ছিলেন: মার্কিন সিনেটর চাক গ্রাসলি ও ক্রিস ভ্যান হোলেন, বার্মার জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দুয়া লাশি লা, বার্মার আইনসভা পাইডাংসু হ্লুটাও এর প্রতিনিধিত্বকারী কমিটির চেয়ারম্যান অং কাই ন্যুন,
ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের সদস্য সুসি গেলম্যান, উইমেন্স পিস নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক ওয়াই ওয়াই নু এবং বার্মা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী জো তুম হমুং।
সুসি গেলম্যান মিয়ানমারের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, যেমন: জান্তা সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা, বিভিন্ন ধর্ম থেকে জনগণের সুরক্ষা এমনকি নতুন মার্কিন প্রশাসনের আওতায় মিয়ানমারের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন।
ওদিকে, উইমেন্স পিস নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক ওয়াই ওয়াই নু মিয়ানমারের মানুষের জন্য সাহায্যের আহ্বান জানান। বিশেষ করে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য।
মিয়ানমারে চলমান মানবিক সংকট এবং জান্তা সরকারের সামরিক নীপিড়নের বিষয়টিতেও ব্রিফিংয়ে আলোকপাত করা হয়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার‘ফোর-কাট’ নীতি দেশজুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে এনেছে। সাধারণ মানুষের বাড়িঘর আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়েছে, মানবিক সহায়তা আটকে গেছে। এতে ১ কোটি ৭৬ লাখের বেশি মানুষ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৪ হাজারের বেশি মানুষ সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে।
সম্প্রতি মার্চ মাসের ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেশটির মধ্যাঞ্চলে অন্তত ৩,৯০০ জনের মৃত্যু হয় এবং বিপুল অবকাঠামো ধ্বংস হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
মার্কিন সেনেটর চাক গ্রাসলি বলেন, চীন সরকারের সমর্থন থাকা মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীকে থামানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ধর্মের ওপর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আক্রমণের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
একইসঙ্গে ব্রিফিংয়ে উপস্থিত সবার সামনে মিয়ানমার জান্তার ধর্মীয় উপাসনালয়, বিশেষ করে গির্জা ও মসজিদ ধ্বংসের ছবি তুলে ধরে তিনি বলেন, তাদের (জান্তা) যদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের নিশানা করার কোনও কৌশল থেকে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত এইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের পাশে দাঁড়ানো।
চলমান এই পরিস্থিতিকে অবহেলা না করলে যুক্তরাষ্ট্র বার্মা জিতে নিতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। গ্রাসলি আরও বলেন, বার্মার জান্ত সরকার কেবল দেশের এক তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি জিতে নেওয়ার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানেই আছে।
তাছাড়া, মিয়ানমারকে কাজে লাগিয়ে ভারত মহাসাগরে চীনকে পদাঙ্ক ফেলার সুযোগ করে দেওয়া উচিত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গ্রাসলি। ব্রিফিংয়ের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল বার্মায় (মিয়ানমার)মানবিক সংকট এবং ধর্মীয় স্বাধীনতায় চ্যালেঞ্জের বিষয়টি।
মিয়ানমারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়, রোহিঙ্গা মুসলিম এবং চীন খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতন এখনও চলমান। দেশটিতে চলমান সহিংসতার কারণে ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমস (ইউএসসিআইআরএফ) বার্মাকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
মার্কিন পণ্ডিত রেভারেন্ড এলিজা ব্রাউন বলেন, জান্তা সরকার মিয়ানমারে ব্যাপটিস্ট চার্চগুলোকে নিশানা করছে। মিয়ানমারে ১৭ লাখ ব্যাপ্টিস্ট এবং ৫ হাজারের বেশি গির্জা রয়েছে, যেগুলোর বড় অংশ সেনা বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে।
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে পাম সানডেতে চিন রাজ্যের মিনডাত ব্যাপ্টিস্ট চার্চেও বোমা হামলা হয়েছে। অথচ ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারে ব্যাপটিস্ট চার্চের দ্রুত প্রসার ঘটছিল।
আর এখন সেগুলোই নির্মম হামলার শিকার হচ্ছে। ব্রাউন বলেন, “ধর্মীয় ও নাগরিক স্বাধীনতা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সামরিক জান্তা বাহিনী খ্রিস্টানদের, বিশেষত ব্যাপ্টিস্টদের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান চালাচ্ছে। আমরা মিয়ানমারের খ্রিষ্টান, রোহিঙ্গা মুসলিম এবং সব মানুষকে নিয়েই চিন্তিত।”
মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দুয়া লাশি লা বলেন, ভূমিকম্পের আগেই দেশের মানুষ গভীর মানবিক সংকটে ছিল। তিনি জান্তার হাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন এবং গণতান্ত্রিক ফেডারেল ইউনিয়নের লক্ষ্যে আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরেন।
ব্রিফিংয়ে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলাসহ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার ওপরও আলোকপাত করা হয়।
বিভিন্ন অ্যাডভোকেসি গ্রুপ বার্মার আর্থিক খাতকে লক্ষ্য করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানাচ্ছে, যাতে সামরিক বাহিনীর তহবিল সরবরাহ বন্ধ করা যায়। মার্কিন সেনেটর গ্রাসলি বলেন, বার্মা অ্যাক্ট বাস্তবায়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
সাংবাদিকের এক প্রশ্রে জবাবে তিনি বলেন, “আমার উদ্বেগ হল, পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, মানুষ মরছে, কিছু একটা হওয়া দরকার।” মার্কিন সেনেটর ভ্যান হলেনও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি বার্মা অ্যাক্ট কার্যকর করা এবং সামরিক জান্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিয়ানমার ও দেশটির সামরিক জান্তা সরকার নিয়ে ওয়াশিংটনের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়।