সময়টা পাকিস্তানের জন্য নজিরবিহীন। রাগ, হতাশা, আশা- সবকিছুই জড়িয়ে আছে এই নির্বাচনের সঙ্গে।
Published : 31 Jan 2024, 08:19 PM
পাকিস্তান নজিরবিহীন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাগ, হতাশা, আশা-প্রত্যাশা সবকিছুই জড়িয়ে আছে এই নির্বাচনের সঙ্গে। এবছর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। টানা তৃতীয়বারের মতো বেসামরিক সংসদে ভোট দিতে চলেছে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির ২৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সেদেশের প্রতিটি নির্বাচনেই মূল ভূমিকা পালন করে আসছে সেনাবাহিনী। পাকিস্তানই প্রথম রাষ্ট্র যেখানে কোনও প্রধানমন্ত্রীই তাদের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। দেশটিতে সামরিক শাসন এবং একনায়কত্বের দীর্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এ এক সুখবরই হওয়ার কথা।
কিন্তু আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির ভোট এখনও হতে চলেছে সেই চিরাচরিত সামরিক হস্তক্ষেপের ছায়াতেই। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোন নির্বাচনই বিতর্ক ছাড়া হয়নি।
কিন্তু এবারের নির্বাচন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বিশেষত, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারান্তরীন; তিনি নির্বাচনে দাঁড়াতে অপারগ থাকায়, আবার একইসময়ে আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে আবার রাজনৈতিক মঞ্চে উঠে আসার প্রেক্ষাপটে। তিনি যেসব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন সবই ধুয়ে গেছে।
ভারতের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ পাকিস্তান। ইরান এবং তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের সঙ্গে দেশটির গোলযোপূর্ণ বিশাল সীমান্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক অম্ল-মধুর। আর চীনের সঙ্গে আছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। তাই এই পারমাণবিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ক্ষমতায় কে বসবেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
কয়েকবছর ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা দখল নিয়ে কোন্দলে জড়িত থেকেছেন। তারা সর্বশেষ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে উৎখাত করেছেন ২০২২ সালে এবং তার প্রশাসনের জায়গায় বসিয়েছেন একটি জোট সরকারকে।
এরপর সেই জোট সরকারের জায়গায় আবার গতবছর অগাস্টে বসানো হয়েছে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। যে সরকারের নির্বাচন করার কথা ছিল নভেম্বর নাগাদই। কিন্তু তা না করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কালক্ষেপনের পর কর্মকর্তারা এই বিলম্বের জন্য দেশে আদমশুমারি চলার অজুহাত দেখিয়েছেন। এখন হতে চলেছে সেই নির্বাচন।
অনেকের মতে পাকিস্তানে এখন প্রয়োজন স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকার। ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মতো বিষয়গুলো মোকাবেলা করার জন্যই কেবল নয়, বরং আর্থিক ত্রাণ সহায়তা এবং বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতেও স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন।
২০১৩ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিলেন নওয়াজ শরিফ। তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালে নির্বাচনে দাঁড়াননি। কারণ, তিনি কারাগারে ছিলেন এবং লন্ডনে কয়েক লাখ পাউন্ডের অ্যাপার্টমেন্ট থাকা নিয়ে দুর্নীতি কেলেঙ্কারির কারণে তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
ছয়বছর পর লন্ডনে নির্বাসনে কটিয়ে শরিফ আবার পাকিস্তানে ফিরেছেন। নওয়াজের পাকিস্তান মুসলিম লিগ নওয়াজ (পিএমএল)-এন পার্টি তার ভাইয়ের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে ২০২২ সালে ইমরানের ক্ষমতাচ্যুতির পর।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসতে থাকার এই সময়ে গত দুই মাসেই নওয়াজ শরীফকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তিও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর আজীবন রাজনীতি থেকে তাকে নিষিদ্ধ রাখার আজ্ঞা এখন অসাংবিধানিক বলে গণ্য হচ্ছে।
অনেকের ধারণা, ইমরানের ক্ষমতাচ্যুতির পর নওয়াজ শরিফের সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগের সমর্থন পাওয়াটা চতুর্থবারের মতো তার দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভবনার দ্বার খুলেছে।
কিন্তু নওয়াজ শরিফ ভাল করেই জানেন, সেনাবাহিনী মুখ ফিরিয়েও নিতে পারে। ২০১৩ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সামরিক বাহিনীর সুনজর পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।
দেশকে সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত করা, বৈদেশিক ও নিরাপত্তানীতি প্রণয়ন এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে গিয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল তাকে। ১৯৯৯ সালে তার দ্বিতীয় মেয়াদও শেষ হতে পারেনি সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে।
আর এবার দেখা যাচ্ছে ঠিক বিপরীত চিত্র। সাবেক ক্রিকেট তারকা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবারের ভোটে থাকছেন না। কারণ, তিনি এবার নির্বাচনের সময়টিতেই কারাগারে আছেন। তার সমর্থকরা বলছেন, ইমরানকে ষড়যন্ত্র করে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে’ জেলে পাঠানো হয়েছে।
ক্ষমতায় ইমরানের উত্থান এবং পতন দু’য়ের দায়ই সেনাবাহিনীর ওপর বর্তেছে। ইমরানের বিরোধীরা ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রক্সি হিসাবে কাজ করার অভিযোগ করেছিল। আর তার সমর্থকদের অভিযোগ, ইমরানের জেল হওয়ার পেছনে সেনাপ্রধানের হাত আছে।
নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) সমর্থন দিয়েছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তারা সূক্ষ্মভাবে জনগণের সামনে ইমরান খানের জনপ্রিয় ভাবমূর্তি তুলে ধরে এবং তাকে ন্যায়পরায়ণ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল।
অপরদিকে, নওয়াজ শরিফকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে চিত্রিত করার পর দুর্নীতির মামলা থেকে বাঁচতে তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসন গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু ইমরান খান ক্ষমতায় আরোহণের পরই সেনাপ্রধানের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে তার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিরোধ শুরু হয়। অবশেষে ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ক্ষমতায় আনা হয় নওয়াজ শরিফের ভাই শেহবাজ শরিফকে।
এই ক্ষমতাচ্যুতির পর ইমরান খান প্রকাশ্যে সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করেন। যার জেরে সামরিক বাহিনী তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে। যদিও এসব অভিযোগ জোরালভাবেই অস্বীকার করেছেন ইমরান খান।
কিছু কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, ইমরানের সমর্থন সম্প্রতি কয়েক বছরে এত কমেছিল যে ২০২৩ সালে নির্বাচন হলে তিনি জেলে থাকুন আর নাই থাকুন, হেরে যেতেন।
তবে তারপরও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গ্যালপ জরিপের প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, ইমরান এখনও জাতীয়ভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। যদিও গত ছয়মাসে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে এনেছেন নওয়াজ শরিফ।
সামরিক বাহিনী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে সব মামলা বাতিল করে আসন্ন নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ পরিষ্কার করেছে। তাকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে পছন্দের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। নওয়াজ শরিফকে সামনে আনার বিষয়টি একরকম পরিষ্কার।
আর ইমরান খানের দলকে যে প্রচার চালানোর সুষ্ঠু সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না তা নিয়ে উদ্বেগটাও বাস্তব। পিটিআই- এর অনেক নেতাই জেলে আছেন কিংবা দল ছেড়ে গেছেন। দলটির প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসাবে দাঁড়াতে হচ্ছে। অন্য অনেকেই আবার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলটির ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এতে অশিক্ষিত অনেক মানুষই ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কা পছন্দ করতে ঝামেলায় পড়বে।
এসবকিছু ছাড়াও নির্বাচনের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকী থাকতেই পাকিস্তানের আদালত এরই মধ্যে তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে থাকা ইমরানকে আরও দুটো মামলার একটিতে ১০ বছর এবং অপরটিতে ১৪ বছরের জেল দিয়েছে।
ফলে দেখা যাচ্ছে সেই পুরোনো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি; জনগণের সামনে নওয়াজ শরিফের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে ইমরান খানকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে চিত্রায়ন। বহু বছর পেরিয়ে যেন এখন একে অপরের বিপরীতেই অবস্থান করছেন এই দুই নেতা।
পাকিস্তানের ২০২৪ সালের নির্বাচনের দিকে যারা নজর রেখেছেন, তাদের কাছে মনে হতে পারে, ৬ বছর আগের তুলনায় পরিস্থিতির বেশিকিছু পরিবর্তন হয়নি।
বহু প্রার্থী অযোগ্য ঘোষিত হয়েছে, জেল হয়েছে, জোর করে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সাংবাদিকরা হয়রানি, হামলার শিকার হয়েছে, গণমাধ্যম আছে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়। আর কেবল স্যোশাল মিডিয়াগুলোই বিচারবিভাগ-সামরিক বাহিনীর সখ্যতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আছে। যে বাহিনী দৃশ্যত বাছাই করা একজন নেতাকে সমর্থন দিচ্ছে।
এসব দিক থেকে পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি মনে হলেও অন্য আরও অনেক দিক থেকে দেখতে গেলে বলা যায়, এখন পরিস্থিতি বরং আরও বেশি খারাপ হয়েছে। পাকিস্তানের বিশৃঙ্খল রাজনীতি, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ভেঙে পড়া অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি থেকে মুক্তি চাইছে জনগণ।
নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীর জন্য রাজনৈতিক লড়াইের তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ নিশ্চিত করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ফলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যিনি ক্ষমতায় আসীন হবেন, তাকে করণীয় অনেক কিছুরই মুখোমুখি হতে হবে।
সূত্র: বিবিসি।