তামিল টাইগারদের পরাজিত করে তিন দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে একসময় ছিলেন জাতীয় বীর; তিনিই এখন দেশের সবচেয়ে ধিকৃত খলনায়ক।
Published : 12 Jul 2022, 01:52 AM
এক দশকের বেশি সময় শ্রীলঙ্কা শাসন করেছে রাজাপাকসে পরিবার, বৈরী সময় আর ভুল সিদ্ধান্তের বলী হয়ে ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। সেই দায় মাথায় নিয়ে প্রতাপশালী এই রাষ্ট্রনেতাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হল প্রবল গণবিক্ষোভের মধ্যে।
কয়েক মাস ধরে টানা বিক্ষোভে গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে। বিক্ষোভকারীরা তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাদের জনপ্রিয় স্লোগান হয়ে উঠেছিল ‘গোটা, গো হোম’। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন গোটাবায়া রাজাপাকসে।
এরমধ্যে শনিবার রাজধানী কলম্বোতো রীতিমত লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। ঝড়ো বিক্ষোভে হাজারো মানুষ গোটাবায়ার বাসভবনে ঢুকে পড়ে, খবর আসে, পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। গভীর রাতে তার পদত্যাগে রাজি হওয়ার খবর আসে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বুধবার ইস্তফা দেবেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। এরপর নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ২০ জুলাই পার্লামেন্টে ভোট হবে বলে জানিয়েছেন স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে।
মোটামুটি দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী- দুই পদেই তিনি ছিলেন। গোটাবায়া রাজনীতির দৃশ্যপটে আসেন পরে, আর সেটা ভাইয়ের হাত ধরেই।
২১ বছর বয়সে গোটাবায়া শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দুই দশক সেখানে চাকরি করেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন। সময়ের আগেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করেন।
২০০৫ সালে বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলে দেশের রাজনীতিতে গোটাবায় পদার্পণ ঘটে। সে সময় তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মাহিন্দা। স্বাধীনতাকামী লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলমের (এলটিটিই) দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের অবসান ঘটানোই ছিল তার মিশন।
শ্রীলঙ্কার উত্তরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে আসছিল তামিল টাইগার্সরা। অনেক সম্ভাবনার পরও শ্রীলঙ্কার লাভের গুঁড় খেয়ে নিচ্ছিল গৃহযুদ্ধ।
তবে শ্রীলঙ্কা সরকার সে সময় বলেছিল, বিদ্রোহীরা হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, তারা মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে।
সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা গোটাবায়াকে যুদ্ধের নায়ক হিসাবে দেখেন। তবে অনেকে আবার তাকে হত্যা, নির্যাতন এবং সরকারের সমালোচকদের গুম করাসহ যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেন, যদিও সেসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গোটাবায়া।
২০১৫ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্ষমতা হারালে গোটাবায়াও পদত্যাগ করেন। কিন্তু ২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে মুসলমান জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৫০ জনের মৃত্যুর পর ফের রাজনীতির মাঠে ফেরেন চরমপন্থার বিরুদ্ধে কঠোর হিসাবে পরিচিত রাজাপাকসেরা।
দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে না থাকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে মাহিন্দা সরে দাঁড়ালে রাজাপাকসের পরিবার ও শ্রীলঙ্কার পডুজানা পার্টির পক্ষে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন গোটাবায়া।
২০১৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর গোটাবায়া তার আগের সরকারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, গৃহযুদ্ধের সময় তার তৈরি করা একটি বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হয়েছে, যার ফল হিসেবে সংগঠিত হতে পেরেছে জঙ্গিরা।
বোমা হামলার এক সপ্তাহ পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন ঘোষণার সময় রয়টার্সকে গোটাবায়া বলেছিলেন, আগের সরকার জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়নি।
“তারা জাতিগত মৈত্রীর কথা বলছিল, তারপর তারা মানবাধিকারের কথা বলেছিল, তারা ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলেছিল।”
২০১৯ সালের নভেম্বরের ভোটে বিপুল ব্যবধানে জয় পান গোটাবায়া। জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে গোটা শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিত্ব করার প্রতিশ্রুতি দেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি মামলা দায়ের হলে তার প্রচারে সামান্য প্রভাব পড়েছিল। তার বিরুদ্ধে এক সাংবাদিককে অপহরণ ও খুনের অভিযোগ ছিল।
এ ছাড়া আরেক মামলায় তামিল সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও সেগুলোকে ভিত্তিহীন দাবি করেছেন গোটাবায়।
২০২০ সালের অগাস্টে পার্লামেন্টে গোটাবায়ার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেড়ে দুই-তৃতীয়াংশে উন্নীত হয়। প্রেসিডেন্ট পদে দুই মেয়াদের সীমাসহ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত করার আইন বাতিলের অনুমতি মেলে।
মহামারীর প্রভাব এবং শুল্ক কমানোর মাশুল শ্রীলঙ্কাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে হাজারো মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়।
জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রান্নার তেল-গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের সংকটে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের জীবন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়। এই দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয় প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবারের ওপর।
দেশকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলার জন্য এপ্রিলের শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে এবং তার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে বিরোধীরা। মাহিন্দার পতনের পর প্রধানমন্ত্রী পদে পুরনো মিত্র রনিল বিক্রমাসিংহেকে এনেছিলেন গোটাবায়। এরপর তারও পদত্যাগ দাবি শুরু করে বিক্ষোভকারীরা।
থেমে থেমে চলা বিক্ষোভের মধ্যে শনিবার হাজারো বিক্ষোভকারী নিরাপত্তাকর্মী, পুলিশ, টিয়ারশেল ও ফাঁকা গুলি উপেক্ষা করে ঢুকে পড়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে। গোটা কলম্বোতে তৈরি হয় টালমাটাল পরিস্থিতি।
তার তিন দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দেশ ছেড়ে পালাতে হল জনরোষ থেকে বাঁচতে, কারণ নতুন সরকার এলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে, এমনকি তামিল হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও আনা হতে পারে তার বিরুদ্ধে।