রাজাপাকসে পরিবার: নন্দিত বীরেরা যেভাবে ধিকৃত খলনায়ক

বছরখানেক আগেও তারা পেয়ে আসছিলেন বীরের মর্যাদা, যারা দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি ফিরিয়েছেন শ্রীলঙ্কায়; সেই রাজাপাকসে পরিবারই এখন যেন গণশত্রু, সব সংকটের গোড়া।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2022, 03:29 AM
Updated : 14 May 2022, 03:29 AM

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রান্নার তেল-গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের সংকটে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের জীবন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয়েছে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও তার পরিবারের ওপর।

দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে রাজাপাকসে পরিবারের জন্য পাশার দান কীভাবে উল্টে গেল, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।  

দেশকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলার জন্য এপ্রিলের শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে এবং তার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে বিরোধীরা। এ সপ্তাহে সেই বিক্ষোভ চরমে পৌঁছায়।

রাজাপাকসেদের সমর্থকেরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করলে সহিংসতা শুরু হয়। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৯ জন, আহত হয় দুইশর বেশি মানুষ।

এর জেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। আগুন দেওয়া হয় তাদের পৈতৃক বাড়িতে। ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনেও হামলা করে এবং তা দখল করে নেয়।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ৭৬ বছরের মাহিন্দা রাজাপাকসে সেখান থেকে পালিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। শ্রীলঙ্কার একটি আদালত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

মাহিন্দা রাজাপাকসেকে (বাঁয়ে) কেউ কেউ বলতেন সম্রাট, তিনিই ছোট ভাই গোটাবায়া রাজাপাকসেকে এনেছিলেন রাজনীতিতে, যিনি এখন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। ছবি: রয়টার্স

সব মিলিয়ে মাহিন্দা রাজাপাকসের জন্য এ এক চরম অবমাননাকর পরিস্থিতি, যিনি এবার প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার আগে দুই বার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

কিন্তু তার এই বিদায় প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিকে দমাতে পারেনি। ৭২ বছর বয়সী গোটাবায়া রাজাপাকসে এই সঙ্কটের সময় প্রধানমন্ত্রিত্ব তুলে দিয়েছেন তাদের পরিবারের আস্থাভাজন রনিল বিক্রমাসিংহের হাতে, যিনি এর আগে চারবার এ দায়িত্বে ছিলেন। এবার তিনি একটি প্রস্তাবিত সর্বদলীয় মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দেবেন।   

বিবিসি বলছে, গোটাবায়া এখন পর্যন্ত পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করে এলেও, কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাহী ক্ষমতার কিছু অংশ পার্লামেন্টের ওপর ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছেন।

কিন্তু তবু তার ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি সুতোয় ঝুলছে। অনেকের ধারণা, তার বিদায়ও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কঠিন এই সময়ে শ্রীলঙ্কার কোনো সরকারের পক্ষেই আরও রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য নেই। খাদ্য ও জ্বালানি সংকট এবং পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ ক্ষোভে ফুঁসছে।

মাহিন্দা রাজাপাকসে হয়ত ভাবতেও পারেননি, মাত্র বছরখানেকের মধ্যে পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধে চলে যাবে। ছবি: রয়টার্স

তারপরও এক দশকের বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসা রাজাপাকসে পরিবারের জন্য এ পতন অনেকটাই নাটকীয়।

বেশিরভাগ সিংহলীর কাছে মাহিন্দা রাজাপাকসে এক সময় ছিলেন একজন যুদ্ধজয়ী নায়ক। কারণ, ২০০৯ সালে তিনি প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী তিন দশক ধরে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটায়। তামিল বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশের উত্তরের জাফনা প্রদেশ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

বিবিসি লিখেছে, ওই যুদ্ধ জয়ের পরপর আয়োজিত বিজয় প্যারেড এবং বিপুল জনসমাবেশে তাকে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গেও তুলনা করা হত।

অভিজ্ঞ রাজৈনিতক বিশ্লেষক কুসাল পেরেরা বলেন, “স্বাধীনতা-উত্তর শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতায় পরিনত হয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। এমনকি অনেকে তাকে সম্রাট মাহিন্দা বলেও সম্বোধন করেছে।”

কুসাল পেরেরা ২০০৭ সালে তার লেখা ‘রাজাপাকসে: দ্য সিংহালা সেলফি’ বইতে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের ভূমিকা এবং কীভাবে মাহিন্দা নিজেকে ক্ষমতার শীর্ষে তুলে এনেছিলেন তা তুলে ধরেন।

মাহিন্দার বাবা একজন পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। তরুণ মাহিন্দা ধীরে ধীরে বিরোধী দলীয় নেতা থেকে নিজেকে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে তুলে আনেন।

এক বছর পরে মাহিন্দা রাজাপাকসে যখন প্রথমবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে বসলেন, তিনি ছোট ভাই গোটাবায়াকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।

এর আগে শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মোটামুটি নিভৃত অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন সেদেশের রাজনীতিতে অচেনা মুখ- গোটাবায়া। বড় ভাইয়ের আমলে মন্ত্রিসভায় ওই নিয়োগ তার জন্য ছিল এক বিশাল অর্জন।

গোটাবায়া দেশে ফেরেন এবং ভাইয়ের রাজনৈতিক পথচলার সঙ্গী হন। দ্রুতই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘নিষ্ঠুর’ হিসেবে পরিচিত অর্জন করেন।

এরপর দ্রুত অন্যান্য ভাই ও স্বজনেরা রাজাপাকসের সরকারে অংশগ্রহণ করেন। তবে মাহিন্দাই ছিলেন এ সবকিছুর কারিগর, যিনি শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।

ছবি: রয়টার্স

বিবিসি লিখেছে, সাম্প্রতিক এই সহিংসতার আগ পর্যন্ত ভাইয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংকট সামলেছেন। কিন্তু সম্প্রতি সেই সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়, বিশেষ করে গোটাবায়া ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে মাহিন্দাকে পদত্যাগের আহ্বান জানানোর পর।

বিবিসি লিখেছে, পদত্যাগের এই আহ্বান মাহিন্দার মত একজনের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদাকর, যিনি ছোট ভাইকে ডেকে এনে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, নিশ্চিতভাবেই তিনি এভাবে বিদায় নিতে চাননি।

কুসাল পেরেরা বলেন, “আদতে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। ব্যাপক যুব আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, যে আন্দোলন তিনি ঠিকভাবে সামলাতে পারেননি। তার বয়স হয়ত আর তাকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ দেবে না।”

মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল তার বাবা ও চাচার মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

তবে প্রেসিডেন্ট ও (সাবেক) প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নীতির প্রশ্নে যে মতভেদের জায়গা তৈরি হয়েছিল, সে কথা মাহিন্দা পদত্যাগ করার আগে বিবিসিকে বলেছিলেন নামাল।

তার ভাষায়, তার বাবা সবসময় কৃষক ও গণমানুষের পক্ষে থাকতে চেয়েছেন, অথচ গোটাবায়া রাজাপাকসের দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো আলাদা।

“তিনি (ক্ষমতাসীন) এসএলপিপির কট্টর সমর্থকদের চেয়ে পরিবর্তনশীল ভোটারদের বিষয়ে বেশি আগ্রহী।”

ছবি: রয়টার্স

মাহিন্দার বিদায়ে সকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা হয়ত খুশি হয়েছে, কিন্তু গোটাবায়ার পদত্যাগের দাবি থেকে তারা পিছু হটেনি। গোটাবায়াকেও বড় ভাইয়ের পথ অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে তারা, যদিও রাজাপাকসেদের সমর্থকেরা তা নাকচ করে আসছে।

শ্রীলঙ্কার সাবেক গণমাধ্যম বিষয়ক মন্ত্রী নালাকা গোদাহেবা বিবিসিকে বলেন, “বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার হয়ত খুবই যৌক্তিক কারণ আছে, সেটা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু তার মানে এই না যে তাকে পদত্যাগ করতে হবে।”

বিবিসি লিখেছে, ২০১৯ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া গোটাবায়া এখন সমর্থন হারিয়ে পরবর্তী কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ঘনিষ্ঠদের ভাষ্য, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার আগ্রহ তার তার নেই। তবে দেশকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজে তিনি নেতৃত্ব দিতে চান।

দেশজুড়ে রাজাপাকসে-বিরোধী মনোভাব তীব্র হওয়ায়, গোটাবায়ার হাতে খুব বেশি বিকল্প হয়ত নেই। কোনঠাসা হয়ে পড়া একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পরিচিত, ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলে শেষ পর্যন্ত হয়ত তিনি সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিতে পারেন।

ছবি: রয়টার্স

বিবিসি লিখেছে, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের প্রতি নিপীড়নমূলক আচরণ, গণমাধ্যমের ওপর প্রাণঘাতি হামলা চালানোর অভিযোগ থাকার পরও গত কয়েক বছর ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন রাজাপাকসেরা। বেশিরভাগ সিংহলী তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি।

কিন্তু এখন পুরো দেশ ভুগছে, জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে বিক্ষোভ আদিবাসী গোষ্ঠী এবং সিংহলীদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে এবং এমনকী তারা সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষেও বক্তব্য দিতে শুরু করেছে।

মানবাধিকার আইনজীবী ভবানী ফনসেকা বলেন, “আর্থিক সংকট আসলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে দুর্দশায় ফেলেছে এবং হঠাৎই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমার মনে হয় রাজাপাকসেরা এতদিন তাদের সব অন্যায় সহ্য করে যেতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন সাধারণ মানুষের মধ্যে এতটা ক্ষোভ দেখে অবাক হয়ে গেছে।”

তবে রাজাপাকসেরা এত সহজে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে দাড়াবে না। তারা শুধু তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়, বরং নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত থাকবে।

সম্ভবত এ বিষয়টিই অভিজ্ঞ বিরোধী দলীয় রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনের কাজ করেছে। কারণ ধারণা করা হয়, রাজাপাকসেদের সঙ্গে তার ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে।

ছবি: রয়টার্স

তবে প্রেসিডেন্টের এ পদক্ষেপ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের অনেকে; আসলে তাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছে।

বিবিসি লিখেছে, শ্রীলঙ্কার জন্য একটি স্থিতিশীল সরকার ছাড়া বিদেশি ঋণ পুনর্গঠন বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে দরকষাকষি কঠিন হবে। আর পরবর্তী সরকার দ্রুত এ উদ্যোগ নিতে না পারলে সেদেশে আরও বেশি বিদ্যুৎহীন পরিস্থিতি ও জ্বালানি সংকট দেখা দেবে।

কলম্বোর বাসিন্দা চান্দনি মানেল বলেন, “দেশ যেই চালাক, আমরা শুধু চাই আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো যাতে পূরণ করা হয়। আমাকে দুই সন্তান ও পরিবারের ভরনপোষণ করতে হয়। রাজনীতিকরা তাদের সম্পদের ওপর টিকে থাকতে পারবেন, কিন্তু আমরা আর পারছি না।”