রাশিয়া ইউক্রেইনে সামরিক অভিযান শুরুর পর পশ্চিমা নেতাদের মধ্যে যারা কিইভের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, বরিস জনসনের নাম তাদের মধ্যে উপরের দিকেই থাকবে।
Published : 08 Jul 2022, 05:52 PM
ব্রিটিশ এ প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কারণেই যুক্তরাজ্য ইউক্রেইনে অস্ত্র পাঠানোর গুরুত্বপূর্ণ হাব হয়ে উঠেছে। লন্ডন একদিকে নিজেরা যেমন কিইভকে অস্ত্র দিয়েছে, তেমনি মিত্রদের মধ্যে কারা কী কী অস্ত্র দিতে পারে, ইউক্রেইন কাদের কাছ থেকে সহজে অস্ত্র পেতে পারে সে কাজে সমন্বয়ও করে চলেছে।
জনসনের পদত্যাগে ব্রিটেনের এই ভূমিকা বদলে যাবে কিনা, তা নিয়ে এরই মধ্যে কানাঘুষাও শুরু হয়ে গেছে। তবে বিদায়ী টোরি প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেইনে যুক্তরাজ্যের সহায়তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে কিইভকে আশ্বস্ত করেছেন।
বৃহস্পতিবার পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার ৯০ মিনিট পর জনসন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ফোন করেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
তিনি ইউক্রেইনের নেতাকে বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেইনের জনগণের প্রতি যুক্তরাজ্যের অগাধ সমর্ধন রয়েছে। যতদিন প্রয়োজন ব্রিটেন ততদিনই কিইভকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ করবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
“ভলোদিমির, তুমি নায়ক। এই দেশের সবাই তোমাকে ভালোবাসে,” জনসন এমনটাই বলেছেন বলে ফোনের কথোপকথন শোনা তার এক সহযোগী জানিয়েছেন।
রাশিয়া ইউক্রেইনে আক্রমণ শুরুর পর গত কয়েক মাসে যুক্তরাজ্য জেলেনস্কির অন্যতম বড় বন্ধু হয়ে উঠেছিল বলে ব্রিটিশ ও মার্কিন কর্মকর্তারা রয়টার্সকে বলেছেন। লন্ডন কখনও ইউক্রেইনের অস্ত্র কেনায় দালালি করেছে, কখনো অস্ত্র সরবরাহে অংশীদার হয়েছে।
ইউক্রেইনকে যুক্তরাজ্যের এ লাগাতার সহায়তার পেছনের কারিগর যে জনসনই ছিলেন তা বোঝা যাবে টোরি নেতার পদত্যাগের খবরে রয়টার্সকে পাঠানো ইউক্রেইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবার প্রতিক্রিয়ায়ও।
কুলেবা ওই প্রতিক্রিয়ায় জনসনকে ‘ইউক্রেইনের সত্যিকারের বন্ধু’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন।
জনসনের উত্তরসূরী হিসেবে যিনিই ব্রিটেনকে নেতৃত্ব দেবেন, তাকে পূর্বসূরীর ইউক্রেইন নীতি বহাল রাখা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জনসন অবশ্য জেলেনস্কিকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, তিনি আরও মাসকয়েক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকছেন, এই সময়ে ইউক্রেইন আগের মতোই লন্ডনকে পাশে পাবে। কিন্তু রাশিয়া যখন ইউক্রেইন ধীরে ধীরে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে রয়েছে, তখন নতুন কেউ জনসনের মতো দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিইভকে পর্যাপ্ত সহায়তা দেবেন কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত জেলেনস্কির সঙ্গে গড়ে প্রতি ছয়দিনে একবার করে কথা হয়েছে জনসনের। বেশিরভাগ সময় তাদের কথোপকথন শুরুই হয় জেলেনস্কির ‘শপিং লিস্ট’ দিয়ে, যেখানে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট তার এখন কী কী অস্ত্র দরকার তার তালিকা খুলে বসেন, বলেছেন তিন ব্রিটিশ কর্মকর্তা।
এমনই এক আলোচনার প্রেক্ষিতে লন্ডন ও অসলোর মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যাতে যুক্তরাজ্য ইউক্রেইনে মাল্টিপল রকেট লঞ্চার পাঠালে তার বিনিময়ে নরওয়ে তাদেরকে কাছাকাছি ধরনের পুরনো সরঞ্জাম, যেগুলো আধুনিকায়ন করা যাবে, তা সরবরাহ করতে সম্মত হয় বলে জানায় নরওয়ের সরকার।
মে মাসেও ইউক্রেইনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ ডেনমার্কের জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোয় যুক্তরাজ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।
ব্রিটেন এখন পর্যন্ত ইউক্রেইনকে ২৭৪ কোটি ডলার সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পর এটাই সর্বোচ্চ। এই সহায়তার অর্থে কেবল ইউক্রেইনের জন্য অস্ত্র কেনা হচ্ছে, তাদেরকে অন্যান্য যেসব লজিস্টিকস সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তার খরচ আলাদা বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক দেশ ইউক্রেইনে অস্ত্র সরবারহ দিতে রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতার মুখে পড়ায় এবং অনেকের নানান ধরনের লজিস্টিক সহায়তা লাগায় তাদেরকে ইউক্রেইন বিষয়ে এমন অগ্রণী ভূমিকা নিতে হচ্ছে।
“ইউক্রেইনকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে মিত্র ও অংশীদারদের মধ্যে যুক্তরাজ্যই নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে,” বলেছেন পেন্টাগনের মুখপাত্র লেফটেনেন্ট কর্নেল আন্তন সেমেলরোথ।
অবশ্য এত কিছুর পরও ইউক্রেইন তাদের চাহিদা অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র পাচ্ছে না বলে অভিযোগও করছে। কিইভ বলছে, তাদের ভাণ্ডারে থাকা সোভিয়েত আমলের অস্ত্রশস্ত্র সব ফুরিয়ে এসেছে। রাশিয়া যেখানে প্রতিদিন কামানের ২০ হাজার গোলা ছুড়ছে, ইউক্রেইন মারতে পারছে কেবল ৬ হাজারের মতো।
রাশিয়ার সমপরিমাণ গোলা ছুড়তে গেলে যুক্তরাজ্যের এখনকার গোলার মজুদও কয়েকদিনের ভেতর শেষ হয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোকে দ্রুতই ইউক্রেইনে অস্ত্র সরবরাহ দ্বিগুণ অথবা তা কমিয়ে কিইভকে মস্কোর সঙ্গে দরকষাকষিতে বসতে চাপ দেওয়ার যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে।
যুক্তরাজ্যে এখন যে অর্থনৈতিক সংকট, জীবন যাত্রার খরচ যেভাবে বাড়ছে তাতে ইউক্রেইন যুদ্ধে সহায়তা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে জনগণের সমর্থন পাওয়া দিন দিন দুরূহ হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের বিষয়েও জনগণ প্রথম দিকে সমর্থন দিয়েছিল, কিন্তু পরের দিকে তাদের মোহভঙ্গ হয় বলে অতীতে বিভিন্ন জনমত জরিপে উঠে এসেছিল।
গত কয়েক মাসে জনসনের সরকারকে দেশের ভেতর নানান ঝুটঝামেলায় পড়তে দেখা গেলেও বিদেশের বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থান ছিল বেশ দৃঢ়।
জনসনকে নিজেকে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন উইনস্টন চার্চিলের মতো দৃঢ়চেতা নেতা হিসেবে। মে-তে ইউক্রেইনের পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধকে ইউক্রেইন মনে রাখবে ‘সেরা সময়’ হিসেবে, যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন চার্চিল।
গত মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি ইউক্রেইনকে পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে ভাসিয়ে দিতে চান, যেন রাশিয়া ভবিষ্যতেও ইউক্রেইনে হামলার কথা কল্পনায়ও না আনে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পশ্চিমা এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ইউক্রেইন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য জড়ো করার চিত্র উপগ্রহের ছবিতে দেখে যুক্তরাজ্য গত বছরের এপ্রিলেই ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণের বিষয়টি আঁচ করতে পারে।
এরপর গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই যুক্তরাজ্যের অল্প ক’জন কর্মকর্তা কী করে কিইভকে সহায়তা করা যায় তার ছক কষতে শুরু করেন। রাশিয়ার হামলা শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্রিটেন ইউক্রেইনকে ট্যাংকবিধ্বংসী এনএলএডব্লিউ সরবরাহ শুরু করে বলে পরে যুক্তরাজ্যের সরকারি তথ্যেও দেখা যায়।
রাশিয়ার অভিযানের শুরুর দিকে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধে এসব এনএলএডব্লিউ বেশ কাজে এসেছিল বলে মনে করেন ইউক্রেইনের কর্মকর্তারা।
যুক্তরাজ্যকে এ সহায়তার জন্য টুইটারে ধন্যবাদও জানিয়েছিল তারা। উইলিয়াম শেকসপিয়ার ও জেমস বন্ডের ছবি দিয়ে টুইটারে তারা লিখেছিল, “ধন্যবাদ যুক্তরাজ্য।”
রাশিয়া আক্রমণ শুরু করল যুক্তরাজ্য ইউক্রেইনকে আরও অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দিতে শুরু করে বলে জানান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ দুটি সূত্র। এপ্রিল থেকে ৪০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে জার্মানির স্টুটগার্টে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি থেকে ইউক্রেইনের অস্ত্র পাঠানোর কাজ শুরু হয়।
জনসন জেলেনস্কির কাছ থেকে কী কী অস্ত্র লাগবে তা জানার পর ব্রিটেন সেসব অস্ত্রের খোঁজে প্রায় এক ডজন দেশে সামরিক অ্যাটাশে পাঠায় বলে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়।
সামরিক অ্যাটাশেরা যেসব দেশে গেছেন সেসব দেশগুলোর কোনো কোনোটি রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচিত, বলেছে সূত্রটি। ইউক্রেইনের সেনারা সোভিয়েত আমলের অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হওয়ায় ব্রিটেন অনেক দেশের কাছে থেকে সোভিয়েত আমলের পুরনো অস্ত্রশস্ত্র কেনার চেষ্টাও চালিয়েছে।
ইউক্রেইন নিয়ে জনসনের এই দৌড়ঝাঁপ দেশের বাইরে তার ও যুক্তরাজ্যের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে বলে গত মাসে হওয়া এক জনমত জরিপে দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানডা ও জাপানের প্রায় ৭ হাজার মানুষের মধ্যে চালানো এই জরিপে নেতৃস্থানীয় পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেইনকে সহায়তায় যুক্তরাজ্যের ভূমিকাই সেরার স্বীকৃতি পেয়েছে।
আর ইউক্রেইনে জনসনের জনপ্রিয়তা তো তুলনাহীন। কিইভের একটি ক্যাফেতে একটি অ্যাপল ডেজার্টের নামকরণ করা হয়েছে বরিস জনসনিয়াক; ওদেসার একটি রাস্তার নাম দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নামে, ইউক্রেইনের পতাকার রঙে যোদ্ধা জনসনের একটি প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে কিইভের কেন্দ্রস্থলের একটি জাদুঘরেও।