তিন বছরও হয়নি, ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ১৯৮৭ সালের পর কনজারভেটিভদের সবচেয়ে বড় বিজয় এনে দিয়েছিলেন বরিস জনসন।
Published : 08 Jul 2022, 12:55 AM
সেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকেই নিজের দলের পার্লামেন্ট সদস্যদের সমর্থন হারিয়ে বিদায় নিতে হল।
বৃহস্পতিবার ডাউনিং স্ট্রিটে সংবাদ সম্মেলনে এসে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “আমি জানি, অনেকে আছেন, যারা স্বস্তি পেয়েছেন, কেউ কেউ হয়ত আছেন, যারা হতাশ হয়েছেন। আমি আপনাদের বলতে চাই, বিশ্বের সেরা কাজটা ছেড়ে দিতে আমার কতটা দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য।
কিন্তু কীভাবে এই পরিণতিতে পৌঁছালেন জনসন? বিষয়টি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে বিবিসি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স
গত ২৯ জুন পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির তৎকালীন ডেপুটি চিফ হুইপ ক্রিস পিনচার লন্ডনে একটি ‘সংরক্ষিত’ ক্লাবে যান এবং তার ভাষায়, সেদিন তিনি ‘অনেক বেশি পান করেছিলেন’ এবং সে কারণে ‘নিজেকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিলেন’।
কী করেছিলেন পিনচার? সেখানে দুইজন পুরুষকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। এর জের ধরে তার বিরুদ্ধে কয়েক বছরের পুরোনো একগাদা যৌন অসদাচরণের অভিযোগও বেরিয়ে আসে।
তাতে নতুন করে চাপে পড়েন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, যাকে আরও অনেক কেলেঙ্কারি সামলে টিকে থাকতে হচ্ছিল। জনসন যে পিনচারের বিষয়গুলো জানার পরও তাকে কনজারভেটিভ ডেপুটি চিফ হুইপ করেছিলেন, সে জন্য নিজের দলের এমপি ও মন্ত্রিসভার সদস্যরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রকাশ্যে।
প্রথমে ডাউনিং স্ট্রিটের তরফে ওই অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, ফেব্রুয়ারিতে যখন এমপি পিনচারকে ডেপুটি চিফ হুইপ করা হয়েছিল, তখন তার বিরুদ্ধে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’গুলোর বিষয়ে জানতেন না জনসন।
বিবিসি লিখেছে, এরপরেও প্রধানমন্ত্রী ওই অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন যদিও এটা প্রমাণ হয়েছে যে তিনি পিনচারের অতীত সম্পর্কে জানতেন।
৪ জুলাই বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী জনসন পিনচারের বিরুদ্ধে তোলা অন্তত একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিষয়ে জানতেন। পরদিনই সাবেক সরকারি কর্মকর্তা লর্ড ম্যাকডনাল্ড জানান, তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে পিনচারের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
এরপর জনসন স্বীকার করেন, ২০১৯ সালে পিনচারের বিষয়ে তাকে জানানো হয়েছিল। সব জেনেও পিনচারকে ডেপুটি চিফ হুইপের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষমা চান তিনি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স
এর আগে এ বছরের এপ্রিলেই প্রধানমন্ত্রীকে জরিমানা গুণতে হয়েছে ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যজুড়ে কড়া লকডাউনের বিধিনিষেধ কার্যকর থাকা অবস্থায় জন্মদিনের উৎসব আয়োজন করে নিয়ম ভাঙার কারণে। তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যাকে পদে থাকা অবস্থায় আইনভঙ্গের জন্য জরিমানা দিতে হয়েছে।
২০২০ সালেই কোভিড-১৯ মহামারী ঠেকাতে প্রথমবার আরোপিত লকডাউনের সময় ডাউনিং স্ট্রিটের বাগানে মদের পার্টি করে কেলেঙ্কারির জন্ম দেন প্রধানমন্ত্রী জনসন। পরের বছর গণমাধ্যমে ওই খবর প্রকাশ হওয়ার পর এ নিয়ে তিনি ক্ষমাও চান।
লকডাউনের বিধি ভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে ডিসেম্বরে হাউজ অব কমনসে তিনি দাবি করেছিলেন, “১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে সব ধরনের নির্দেশনা পুরোপুরিভাবে মেনে চলা হয়েছে।”
বিষয়টি নিয়ে এখন তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে একটি কমনস-কমিটি। তারা জানার চেষ্টা করছে, প্রধানমন্ত্রী জেনেশুনে পার্লামেন্টকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স
বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অনেক দেশের মত যুক্তরাজ্যেও চলতি বছর মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বেড়েছে, অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ সূচক উঠেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশে।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার অনেকগুলো কারণই ছিল জনসনের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কথা বলা যায়। ওই যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক মাত্রায় অবরোধ আরোপ করায় জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় জ্বালানি তেলের ওপর থেকে শুল্ক কমানোসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও এপ্রিলে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়, কর বাড়ানোর ফলে স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা খাতে ব্যয় নিশ্চিত করা যাবে। নতুন কর হারে ব্রিটেনে ৩৪ হাজার পাউন্ডের বেশি আয়ের জন্য আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হচ্ছে।
পার্লামেন্টের বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা স্যার কির স্টারমার এপ্রিলে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছিলেন, সরকার শ্রমজীবীদের ওপর কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওয়েন প্যাটারসন বিতর্ক
২০২১ সালের অক্টোবরে হাউজ অব কমনস কমিটি তৎকালীন কনজারভেটিভ এমপি ওয়েন প্যাটারসনকে ৩০ দিনের জন্য বহিষ্কারের সুপারিশ করে। কমিটি জানায়, ওয়েন প্যাটারসন লবি বা তদবির করতে গিয়ে বিধি ভঙ্গ করেছেন। তিনি কিছু কোম্পানিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যারা তাকে অর্থ দিয়েছেন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কনজারভেটিভরা প্যাটারসনের বিরুদ্ধে এই বহিষ্কারাদেশ স্থগিত রাখার পক্ষে ভোট দেয় এবং তার বিরুদ্ধে তদন্ত কীভাবে পরিচালিত হয়েছে তা অনুসন্ধানে আরেকটি নতুন কমিটি গঠন করে।
শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদের মুখে ওয়েন প্যাটারসন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে প্রধানমন্ত্রী জনসন স্বীকার করেন যে এই বিষয়টি সামাল দিতে গিয়ে তিনি ‘দুর্ঘটনা ঘটিয়ে’ বসেছিলেন।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স
‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ বা ‘ব্রেক্সিট কার্যকর করা হোক’ - এই সরল নীতির ওপর ভর করে সবশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করেছিলেন বরিস জনসন।
অথচ তারপর থেকে ডাউনিং স্ট্রিটে মনোযোগে ঘাটতি ও নতুন ভাবনা-চিন্তার অভাব দেখা দেয় বলে জনসনের সমালোচকদের ভাষ্য।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা, যিনি এখন তার প্রধান সমালোচকে পরিণত হয়েছেন, সেই ডমিনিক কামিংস বারবার অভিযোগ করে আসছেন যে প্রধানমন্ত্রী একটি নিয়ন্ত্রণহীন ‘শপিং ট্রলি’তে পরিণত হয়েছেন।
বাকি সমালোচকেরাও প্রধানমন্ত্রীর দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে আদৌ তার কোনো দর্শন আছে কিনা।
কনজারভেটিভ এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জেরেমি হান্ট জুন মাসে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ‘একাগ্রতা, দক্ষতা ও লক্ষ্যের’ অভাবে ভুগছেন।
জনসনের বিরুদ্ধে আস্থা ভোটের আগে দেওয়া বক্তব্যে জেরেমি হান্ট ওই অভিযোগ তোলেন, যা পরে আরও বেশি আওয়াজ পেতে শুরু করে।
বরিস জনসন সরকার গঠনের পর থেকে ব্রিটেনের বিভিন্ন উপনির্বাচনেও কনজারভেটিভদের পরাজয় অব্যাহত রয়েছে।
অবশ্য এখন কনজারভেটিভ এমপিদের জন্য এসব বিষয় আর উদ্বেগের কারণ ঘটাচ্ছে না। তারা রায় জানিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকেও বিদায় নিয়েছেন বরিস জনসন।