জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে ক্ষয়ক্ষতি, তার ক্ষতিপূরণ ছাড়ে ধনী দেশগুলো নানা ছুতো করে এক ধরনের বেইমানি করছে বলে সরব হচ্ছে গরিব দেশগুলো।
Published : 17 Jun 2022, 01:37 AM
মিসরে আসছে নভেম্বরের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের (কপ২৭) এর আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচিতে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে আলোচনা রাখার আশা করছে তারা।
তার আগে বৃহস্পতিবার জার্মানির বনে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনার চূড়ান্ত দিনে এই বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে রাখা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।
বৈঠকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, ধনী দেশগুলো কয়েকশ বছর ধরে যেসব ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ করে আসছে তারই জের টানতে হচ্ছে গরিব দেশগুলোকে।
তারা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য তাদের অর্থ দরকার, কারণ ধনী দেশগুলোর তুলনায় তাদের বেশি ভুগতে হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতিও তাদের কম।
গত বছর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন কপ২৬ এ দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো ও উন্নয়নশীল দেশগুলো কার্বন নির্গমন কমাতে রাজি হয়েছিল এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে যে ধনী দেশগুলো এর জন্য একটি ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া চালু করবে।
কিন্তু বনের আলোচনায় তারা অভিযোগ করছে, এই বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।
পরিবেশ বিষয়ক থিংক ট্যাংক ই৩জি-র অ্যালেক্স স্কট বলেন, “(উন্নয়নশীল দেশগুলো) ছাড় দেওয়ার বিষয়ে রাজি হয়েছিল এই বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যে (ধনী) দেশগুলো আলোচনা শুরু করবে এবং ক্ষয়ক্ষতি মেটাতে কীভাবে অর্থায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা যায় তা দেখবে।
“কিন্তু এখানে আমরা তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। বরং এখানে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে আলোচনা করা হচ্ছে যে আমরা কিছু সমস্যা কীভাবে নিজেরাই সমাধান করতে পারি।”
অনেক অংশগ্রহণকারীর জন্যই, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতি।
কোস্টা রিকার পরিবেশবাদী গোষ্ঠী অ্যাসোসিয়েশন লা রুতা দেল ক্লিমার আদ্রিয়ানা ভাসকুয়েজ রদ্রিকেজ বলেন, “এরইমধ্যে আমরা ২৫ বছর ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে আলোচনা করে পার করেছি। আমাদের অনেক পরিবার আছে যারা বাড়িঘর হারিয়েছে, তাদের ফসল হারিয়েছে, এবং একই সময়ে, আমরা ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছি।”
উন্নয়নশীল দেশগুলো বলে আসছে যে বর্তমানে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করছে, তার কারণ মূলত ধনী দেশগুলোর ঐতিহাসিকভাবে কার্বন নির্গমন করে আসা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার একটি দায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এই বক্তব্য মানতে রাজি না। তাদের আশঙ্কা হচ্ছে, তারা যদি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়, তাহলে তাদের দশক এমনকি শতকের জন্য লাখ লাখ ডলার পরিশোধের একটি দায়ে আটকা পড়তে হবে।
এ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য ক্ষয়ক্ষতির ওপর গ্লাসগো আলোচনা শুরু করা হয়, যাদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের বনের বৈঠকে।
গরিব দেশগুলো আশা করছে মূলত কারিগরি ওই বৈঠক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নভেম্বরে মিসরের শারম এল-শেখে অনুষ্ঠেয় কপ২৭ সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
কিন্তু, এখন পর্যন্ত, সেটা করা হয়নি, যেহেতু বেশকিছু দেশ এর বিরোধিতা করছে।
যদি কোনো ধরনের অগ্রগতি না হয়, সেক্ষেত্রে আসন্ন কপ২৭ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা বিষয়ে ঐক্যে একটি বড় ধাক্কা আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে অনেক অংশগ্রহণকারী।
ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশগুলোর জোটের (এওএসআইএস) প্রধান মধ্যস্ততাকারী রাষ্ট্রদূত কনরড হুন্ট বলেন, “এটা হবে বেদনাদায়ক। এখানে কতোটুকু অর্জন হয়েছে? খুব বেশি না, আমি মনে করি, আরও অনেক বেশি কিছু অর্জন করার আছে। আমি কি খুশি? না আমি খুশি নই।”
কূটনীতিকদের চেয়ে আরও বেশি কড়া ভাষায় কথা বলেছেন পরিবেশবাদীরা।
সিএএন ইন্টারন্যাশনালের তাসনিম এসোপ টুইট করেছেন, “ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে বেইমানি করেছে ধনী দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যরা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে অর্থায়নের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। বনের সমঝোতা আলোচনায় যা হচ্ছে তা নিয়ে আমরা খুবই হতাশ।”
কয়েকজন সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক দূত জন কেরির প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়েছেন। বনের এই আলোচনা শুরুর সময় জন কেরি বিবিসিকে বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ অনেক বেশি কমানো না গেলে বিশ্ব ‘রসাতলে’ যাবে।
করপোরেট অ্যাকাউন্টেবিলিটির রোজ জ্যাকসন বলেন, “’গ্লোবাল সাউদে’র দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পৌছানোর চেষ্টা করেছে যাতে তারা যে ক্ষয়ক্ষতি করেছে তার ক্ষতিপূরণ দেয়। অথচ জলবায়ু সংকট নিয়ে কোনো দায় বা পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাষ্ট্র দেরি করেই চলেছে। বিশ্ব ‘রসাতলে’ যাচ্ছে না, বরং তারাই রসাতলে নিচ্ছে।”
বিবিসি লিখেছে, বন আলোচনার আর একদিন বাকি আছে, তাই এখনও কিছুটা আশা আছে যে মিসরে আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে হয়ত ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জায়গা করে নেওয়ার মতো সমঝোতা হতে পারে।