বিবিসি যে প্রমাণ পেয়েছে তার ভিত্তিতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত বলেছেন, ৮ বছরের শিশু হত্যায় আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলেই মনে করছেন তিনি।
Published : 02 May 2024, 08:48 PM
গত বছর ২৯ নভেম্বর বিকালে কয়েকজন ফিলিস্তিনি বালক অধিকৃত পশ্চিম তীরের রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। যেখানে তারা প্রায়ই একসঙ্গে মিলে খেলত।
কয়েক মিনিট পরই ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে তাদের দুইজন- বাসিল (১৫) ও আদম (৮)-এর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সামরিক দখলদারিত্বে থাকা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণ নিয়ে তদন্তের অংশ হিসেবে বিবিসি দুই বালককে হত্যার ওই দিনে কী ঘটেছিল তা খুঁজে বের করেছে।
বিবিসি তাদের অনুসন্ধানে মোবাইল ফোন, সিসিটিভি ফুটেজ, ইসরাইলি সেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য,ঘটনাস্থলের বিস্তারিত তদন্ত-সহ সব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। এতে বেরিয়ে এসেছে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ।
বিবিসি বলেছে, আমরা যে প্রমাণ পেয়েছি তা খতিয়ে দেখে জাতিসংঘের মানবাধিকার ও সন্ত্রাস-বিরোধী বিশেষ দূত বেন সৌল বলছেন, ৮ বছর বয়সী বালক আদম হত্যা ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলেই মনে হচ্ছে।
আরেক আইন বিশেষজ্ঞ ড. লরেন্স হিল-কথর্ন গুলি চালানোকে ‘নির্বিচারে প্রাণঘাতী শক্তির ব্যবহার’ বলেছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনী ‘ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস’ (আইডিএফ) বলেছে, তারা মৃত্যুর এ ঘটনা পর্যালোচনা করছে। তবে তারা বলছে, “গুলি কেবল তখনই করা হয় যখন তাৎক্ষণিক কোনও হুমকি থাকে বা গ্রেপ্তারের জন্য অন্য বিকল্প আর কোনও পথ থাকে না।”
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলার পর কয়েক মাসে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে সহিংসতা বেড়েছে।
ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভাঙচুর, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের অস্ত্রের ভয় দেখানো, এলাকা ছেড়ে পাশের দেশ জর্ডানে চলে যেতে বলা এবং সশস্ত্র এক ফিলিস্তিনির লাশ ছিন্নভিন্ন করার প্রমাণও পেয়েছে বিবিসি।
২৯ নভেম্বরের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বাসিল একটি হার্ডওয়্যারের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং দোকানের শাটার বন্ধ। যখন ইসরায়েলি সেনারা আসে, তখন পশ্চিম তীরের জেনিন শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড হলেও সেখানে গাজার মতো হামাসের শাসন নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, জেনিন শরণার্থী শিবিরের খুব কাছ থেকে ইসরায়েলি সেনা অভিযানের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ফুটবল পাগল ও লিওনেল মেসির বড় ভক্ত আদম তার ১৪ বছর বয়সী বড় ভাই বাহার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তায় মোট নয় জন ছেলে ছিল, সবাইকেই সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছিল। এ ক্যামেরাতেই পরে কী ঘটেছিল তার প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়।
কয়েকশ’ মিটার দূরে অন্তত ছয়টি ইসরায়েলি সাঁজোয়া যানের বহর মোড় ঘুরিয়ে ছেলেদের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এতে ছেলেরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কয়েকজন ছেলে দৌড়ে সরে যেতে শুরু করে।
ঠিক সে সময়েই একটি মোবাইল ফোনের ফুটেজে দেখা যায়, একটি সাঁজোয়া গাড়ির দরজা সামনের দিক থেকে খুলে যায়। এর ভিতরে থাকা সেনা সরাসরি বালকদের দেখতে পাচ্ছিলেন। রাস্তার মাঝখানে চলে গিয়েছিল বাসিল। সেনাদের থেকে ১২ মিটার দূরে ছিল আদম। সে দৌড়াচ্ছিল।
এরপরই অন্তত ১১টি গুলির শব্দ হয়। ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে বিবিসি দেখতে পায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এসব গুলি আঘাত হেনেছে। চারটি গুলি একটি ধাতব খুঁটিতে আঘাত করে, দুটি হার্ডওয়্যার স্টোরের শাটারে, একটি গুলি পার্ক করে রাখা একটি গাড়ির বাম্পারের ভিতর দিয়ে চলে যায়। আরেকটি গুলি আঘাত করে সিঁড়ির হাতলে।
বিবিসি’র হাতে আসা মেডিকেল রিপোর্টে দেখা যায়,বাসিলের বুকে আঘাত করেছে দুটি গুলি। আরেকটি গুলি আদমের মাথার পিছনে আঘাত করেছে। তার বড়ভাই বাহা তার দেহকে টেনে নেওয়ার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করছিল।
এতে আদমের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। আর একটি এম্বুলেন্সের জন্য চিৎকার করছিল বাহা। কিন্তু এম্বুলেন্স আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বাহা বলে, আদম ও তার বন্ধু বাসিল তার সামনেই মারা যায়।
বিবিসি-কে কান্নায় ভেঙে পড়ে বাহা বলেছে, 'আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম, আমি নিজের কথাও ভাবছিলাম না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম। তাকে ডাকছিলাম, আদম, আদম। কিন্তু সে কোনও উত্তর দিচ্ছিল না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল।”
গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে বাসিলকে হাতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে থাকতে দেখা যায়। সেটি কী ছিল তা স্পষ্ট নয়। পরে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস আইডিএফ একটি ছবি শেয়ার করে বলে সেটি বিস্ফোরক ডিভাইস ছিল।
ঘটনাস্থলের তদন্ত থেকে পাওয়া প্রমাণ বিবিসি মানবাধিকার আইনজীবী, যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারী, সন্ত্রাস-বিরোধী বিশেষজ্ঞ এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য নিরপেক্ষ সংস্থার সদস্যসহ বেশ কয়েকজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞেকে দিয়েছে। কেউ কেউ পরিচয় প্রকাশ না করে এ বিষয়ে তাদের বিশ্লেষণ জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন যে, ঘটনাটি তদন্ত করা উচিত এবং কেউ কেউ বলেছেন, এইঘটনায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ও সন্ত্রাস দমন বিষয়ক বিশেষ দূত বেন সৌল বলেছেন, বাসিলের হাতে বিস্ফোরক থাকলে সেক্ষেত্রে আইনসঙ্গতভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা যেত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
কিন্তু “আদমের ক্ষেত্রে এটি ইচ্ছাকৃতভাবে, নির্বিচারে বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামলা এবং যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন বলেই প্রতীয়মান হয়”, বলেন তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ল’-এর সহ-পরিচালক ড. লরেন্স হিল কর্থন বলেন, সেনাবাহিনী সাঁজোয়া যানে ছিল। এমনকী যদি সেখানে হুমকিও থাকত তাহলেও তাদের সরে যাওয়া উচিত ছিল। পরে তারা পরিকল্পনা করে গ্রেপ্তার করতে পারত। তা না করে তারা নির্বিচারে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করেছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।”