দুই দশক আগেও মধ্য চিলির পেনুলাস লেক ছিল ভালপারাইসো শহরের পানির প্রধান উৎস, সেখানে যে পরিমাণ পানি ছিল, তা দিয়ে অনায়াসে অলিম্পিক-আকারের ৩৮ হাজার সুইমিং পুল ভরে ফেলা সম্ভব ছিল। এখন সেখানে দুটি পুলের সমান পানিও নেই।
Published : 14 Jun 2022, 07:11 PM
ব্যাপক খরায় পানি শুকিয়ে লেকের তলার মাটি ফেটে গেছে। তলানিতে পড়ে আছে মাছের কঙ্কাল; অন্য প্রাণিগুলো পানি খুঁজছে হন্যে হয়ে।
১৩ বছরের দীর্ঘ খরায় প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমে গেছে। এক সময় গ্রীষ্ম ও বসন্তে ওই এলাকায় বরফ গলা জলের মূল ভাণ্ডার ছিল আন্দিজ পর্বতমালার তুষার। কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সেই তুষার আর দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না, দ্রুত গলে যাচ্ছে, কিংবা সরাসরি বাষ্পে পরিণত হচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম তামার খনিতেও হানা দিয়েছে খরা। লিথিয়াম ও কৃষিকাজের জন্য পানির ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পানির সরবরাহ ধরে রাখার জন্য রাজধানী সান্তিয়াগোকে অভূতপূর্ব পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে।
৫৪ বছর বয়সী আমান্দা ক্যারাসকোর বাড়ি পেনুলাস লেকের কাছেই। জীবনে অনেকবার পানির সংকট দেখলেও এখনকার মত পরিস্থিতিতে তাকে আর পড়তে হয়নি।
লেকে একসময় পেজেরি মাছ ধরার কথা স্মরণ করে ক্যারাসকো বলেন, “আমি এরকম কখনও দেখিনি। আগেও পানি কমে গেছে অনেক সময়, কিন্তু এখনকার মত নয়। ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা করতে হবে, তিনি যেন দয়া করে জল দেন।”
“এখন যে দশা হয়েছে, সেটাকে বড়জোর একটা ডোবা বলা যায়। আপনি যদি শুধু ভেবে দেখেন যে কয়েক দশক আগেও পেনুলাস ছিল বৃহত্তর ভালপারাইসো এলাকার পানির একমাত্র উৎস ছিল, আপনি বুঝতে পারবেন, পরিস্থিতি কতটা গুরুতর।”
গবেষণা বলছে, চিলির এ অবস্থার কারণ বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তন, যা আবহাওয়া চক্রকে বদলে দিচ্ছে।
সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরের নিম্নচাপের ঝড় শীতকালে চিলিতে বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে। তাতে জলাধারাগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং আন্দিজ পর্বতমালাকে বরফে ঢেকে দেয়।
সমুদ্রের তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা নিয়ে একটি সমীক্ষা অনুসারে, চিলি উপকূলে সমুদ্রের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় ঝড়ের আগমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অ্যান্টার্কটিক আবহাওয়া নিয়ে পরিচালিত একটি সমীক্ষাও বলছে, ওজোন স্তর ক্ষয়, গ্রিনহাউস গ্যাস এবং চলমান বিরূপ আবহাওয়া চিলি থেকে ঝড়কে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
‘ওয়াটার টাওয়ার’
আন্দিজ পর্বতমালাকে ওই অঞ্চলের জন্য একটি ‘ওয়াটার টাওয়ার’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “আন্দিজ পানির শূন্যতা পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে না; অর্থাৎ, বসন্তে বরফ গলে যাচ্ছে, কিন্তু নদী, জলাশয় বা জলাধার ভরাটের জন্য খুব অল্প পানিই সেখান থেকে আসছে।”
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও পানি বিশেষজ্ঞ মিগুয়েল লাগোস গ্রীষ্মে জল সরবরাহের পরিমাণ যাচাইয়ে তুষার এলাকা পরিমাপ করতে সান্তিয়াগো থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পূর্বে লেগুনা নেগ্রা স্টেশনে গিয়েছিলেন।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, “সেখানে কিছুই ছিল না। এত কম তুষারপাতের ঘটনা এবং এমন উষ্ণ পরিবেশ পেয়েছি এবার, শীতের মধ্যেই তুষার গলে গিয়েছিল।”
তুষারপাতের সময় নিচের স্তরের ওপর আরেকটি নতুন স্তর তৈরি হয়, যা নিচের স্তরকে দীর্ঘ সময় ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু উষ্ণ আবহাওয়া এবং কম তুষারপাতের ফলে উপরের স্তর হয় দ্রুত গলে যাচ্ছে, না হয় সরাসরি বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘ঊর্ধ্বপাতন’।
২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ক্লাইমেটোলজির এক সমীক্ষায় ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চিলির খরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, আবহাওয়ার পরিবর্তন হলে ভবিষ্যতে খরার মাত্রা কমাতে পারে। কিন্তু সেটা অনেকাংশে নির্ভর করবে মানুষ কার্বন গ্যাস নিঃসরণ করে জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলা কতটা কমাবে, তার নির্ভর করবে।
গাণিতিক মডেল এবং ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, আবালেইর মত কৃষি শ্রমিকদের জন্য হয়ত দুর্ভাগ্যই অপেক্ষা করছে, কারণ আগামী ৩০ বছরে পানির পরিমাণ এখনকার চেয়েও ৩০ শতাংশ কমে যাবে।
বিশেষজ্ঞ মিগুয়েল লাগোস বলেন, “আজ আমরা যাকে খরা বলি, একসময় সেটাই এখানে স্বাভাবিক বলে মনে হবে।”
সান্তিয়াগোর দক্ষিণে আরেকটি শুকিয়ে যাওয়া লেকের নাম লেগুনা দে আকুলিও। স্থানীয় ক্যাম্প সাইট ম্যানেজার ফ্রান্সিসকো মার্টিনেজ বলেন, শত শত মানুষ সেখানে ছোট নৌকা নিয়ে ভ্রমণে বের হত, কিংবা সাঁতার কাটতে যেত এক সময়। এখন সেখানে জং ধরা পিয়ার, পুরনো নৌকা পড়ে আছে।
“এখন সেখানে কোনো পানি নেই, মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রাণিগুলো মারা যাচ্ছে, আমাদের কিছুই করার নেই।”