ইউক্রেইনে রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযান’ পরিচালনা করার জন্য মস্কো কি নির্দিষ্ট কাউকে কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়েছে? এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
Published : 24 Mar 2022, 07:50 AM
সিএনএন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, রাশিয়ার সামরিক অভিযানের আপাত বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং ধীরগতির পেছনে এটি একটা কারণ হয়ে থাকতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের ধারণা।
যুক্তরাষ্ট্রের দুজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার বরাতে সিএনএন লিখেছে, রাশিয়ার বিভিন্ন সামরিক বিভাগ থেকে যুদ্ধে অংশ নেওয়া ইউনিটগুলোকে ইউক্রেইনের বিভিন্ন অংশে রসদের জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করার বদলে প্রতিযোগিতা করতে দেখা যাচ্ছে। আর সে কারণেই এমন ধরাণা তৈরি হয়েছে যে, কোনো একজন নির্দিষ্ট সেনাপতি হয়ত ইউক্রেইনে রণাঙ্গনের ভেতরে বা কাছাকাছি কোথাও থেকে পুরো বাহিনীকে পরিচালনা করছেন না।
ইউক্রেইনজুড়ে রাশিয়ার সামরিক ইউনিটগুলোর যুদ্ধের ময়দানে কোনো সুনর্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে সমন্বিতভাবে লড়ছে না। বরং, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই যার যার মত করে তারা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন লিখেছে, রুশ বাহিনীর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগেও উল্লেখযোগ্য অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। সৈন্যরা এবং তাদের অধিনায়করা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে অনেক ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিক সেল ফোন এবং অন্যান্য অরক্ষিত চ্যানেল ব্যবহার করছেন। ফলে আড়িপেতে তাদের কথা শোনা সহজ হয়ে যাচ্ছে। পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করতে তা ইউক্রেনীয়দের সাহায্য করছে।
এসব কর্মকাণ্ড থেকে মনে হচ্ছে, অভিযানটি একটি ছাড়া ছাড়া, এবং অনেকক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খল অভিযানের রূপ পেয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা কর্মকর্তাদের অবাক করে তুলছে।
ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সাবেক এক অধিনায়ক ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মার্ক হার্টলিং বলেন, “যুদ্ধ পরিচালনার অন্যতম একটি নীতি হল ‘ইউনিটি অব কমান্ড’ বা ‘নেতৃত্বের ঐক্য’। যার অর্থ হল, কোনো একজনকে সার্বিক নেতৃত্বে থাকতে হবে - গুলির সমন্বয়, সরঞ্জাম পরিচালনা, রিজার্ভ সেনা আহ্বান, অভিযানে নিয়োজিত বাহিনীর বিভিন্ন শাখার সাফল্য (ও ব্যর্থতা) নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী রণনীতির সামঞ্জস্য করতে হবে তাকে।”
ইউক্রেইনের চলমান সামরিক অভিযানের কমান্ডার কে, সে বিষয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কারো নাম উল্লেখ করেনি। এ বিষয়ে সিএনএনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলেও জবাব মেলেনি বলে তাদের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
সামরিক বিশ্লেষক হার্টলিং বলেন, এমনও হতে পারে যে রাশিয়া বিদেশে পরিচালিত এই সামরিক অভিযানের জন্য নীরবে একজন শীর্ষ সমর অধিনায়ককে দায়িত্ব দিয়েছে। যদি তেমন কিছু ঘটে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এখনও সেই ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সিএনএন লিখেছে, এই যুদ্ধ রাশিয়ার অতিরিক্ত সংখ্যক বড় সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যুর জন্যও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ইউক্রেইনীয়দের দাবি, যুদ্ধের এই চার সপ্তাহে তারা এ পর্যন্ত পাঁচজন রুশ জেনারেলকে হত্যা করেছে। তবে এ তথ্য নিরপেক্ষ সূত্র থেকে নিশ্চিত করতে পারেনি সিএনএন।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ডেভিড পেত্রাউস সিএনএনকে বলেছেন, একটি যুদ্ধে এত বেশি জেনারেলের মৃত্যু ‘বিরল ঘটনা’।
রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আঞ্চলিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক জিটিআরকে কোসত্রোমা বৃহস্পতিবার জানায়, ইউক্রেইনের যুদ্ধে রাশিয়ার স্পেশাল এয়ারবোর্ন ইউনিটের অধিনায়ক কর্নেল সের্গেই সুখারেভও নিহত হয়েছেন।
“শেষ কথা হল, তাদের (রুশ) নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে,” বলেন জেনারেল পেত্রাউস।
আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল হার্টলিং বলছেন, এ ধরনের বিশাল সামরিক অভিযান পরিস্থিতি খারাপের দিকেই নিয়ে যায়। এক হাজার মাইলের চেয়ে বেশি বিস্তৃত রণাঙ্গনের জন্য যোগাযোগ রক্ষার জন্য যে বিপুল সামর্থ্য এবং নেতৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গোয়েন্দা সক্ষমতা দরকার, তা ‘রুশদের কাছে নেই’।
ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর আরেক সাবেক অধিনায়ক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেন হজেস বলেন, “আমি (রুশ) নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী বা সেনা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের মধ্যে কোনো সমন্বয় দেখতে পাচ্ছি না।”
রাশিয়ার সেনা নেতৃত্ব কাঠামোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ধারণা আছে কিনা সে বিষয়ে ভেতরের কোনো তথ্য জানা নেই হজেসের।
‘মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে অবগত’ যুক্তরাষ্ট্রের এক সূত্র সিএনএনকে বলেছে, “নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সব পর্যায়েই রুশরা এই অভিযানে ব্যাপক জটিলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে হয়ত ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধেরও ভূমিকা রয়েছে।”
যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাদের সঙ্গে তাদের কমান্ডারদের যোগাযোগ প্রায়ই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, এমন খবরও পশ্চিমা কর্মকর্তারা দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে অবগত আরেক সূত্র সিএনএনকে বলেছে, মাঠে থাকা রুশ সেনারা তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অভিযান চালাচ্ছে ঠিক, কিন্তু (যদি কিছু ভুল হয়) তা জানানোর কোনো উপায় তাদের নেই।
আর সে কারণেই অনেক রুশ সেনাকে তাদের ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ফেলে চলে যেতে দেখা গেছে বলে পশ্চিমা কর্মকর্তাদের ধারণা।
‘থমকে যাওয়া অভিযান’
সিএনএন লিখেছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেইনে সেনা অভিযান শুরু করার পর এখন পর্যন্ত খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
রুশ বাহিনী ইউক্রেইনের বিভিন্ন শহরে বোমা ও গোলাবর্ষণ করে আবাসিক বাড়িঘর, হাসপাতাল, দোকান, বিপনী ও বিদ্যালয় গুঁড়িয়ে দিলেও ইউক্রেনীয়দের শক্ত প্রতিরোধের মুখে দৃশ্যত তাদের স্থল বাহিনীর গতি থমকে গেছে, যার কারণ একটি ‘কৌশলগত ভুল’ বলে মনে করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা।
ইউক্রেইনের আকাশ এখনও পুরোপুরি রুশদের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং তারা কিইভসহ কোনো বড় শহরেরই পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি।
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন সিএনএনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অনেকগুলো ভুল পদক্ষেপ দেখতে পেয়েছে। মস্কো যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে সংকটে আছে। কৌশলগত গোয়েন্দা সক্ষমতা ব্যবহারেরও ভালো কোনো নমুনা তারা দেখেননি, এমনকি আকাশ দখলের সামর্থ্যের সঙ্গে ভূমিতে সেনা পরিচালনার দক্ষতার মধ্যেও কোনো সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সরকারের বাইরের বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়া সম্প্রতি সিরিয়ায় এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় সেনা অভিযান পরিচালনা করলেও ইউক্রেইনের মত বিশাল ও পূর্ণ-মাত্রার সামরিক অভিযান তারা আগে পরিচালনা করেনি, যেখানে একাধিক পর্যায়ে নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের সমন্বয় দরকার হয়।
হজেস জানান, রাশিয়ার বার্ষিক সামরিক মহড়া এর আঞ্চলিক সামরিক বিভাগগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মত নিয়মিত ‘যৌথ’ সামরিক মহড়া করে না।
“এত বিশাল সামরিক অভিযান পরিচালনার মত অভিজ্ঞতা তাদের নেই। অনেক দশক পেরিয়েছে যখন তারা এই মাত্রায় অভিযানের মহড়া করত। তারা সিরিয়া ও ক্রিমিয়ায় যা করেছে, এবারের অভিযানের তুলনায় তা নগণ্য।”
পুতিনের ভরসা গোপনীয়তায়
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তা এমন ধারণাও দিচ্ছেন যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সার্বিক অভিযানের বিষয়ে এতটাই গোপনীয়তা বজায় রেখেছিলেন যে তার নিজের সামরিক কমান্ডাররাও অভিযান শুরুর কয়েক মিনিট আগ পর্যন্ত পুরো অভিযানের বিষয়ে জানতে পারেননি। আর সেটাই হয়ত রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন অংশের সমন্বয়কে বাধাগ্রস্ত করেছে।
ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে অভিযান শুরুর সপ্তাহখানেক আগে একজন জ্যেষ্ঠ ইউরোপীয় কর্মকর্তা বলেছিলেন, “মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে (রুশ) প্রতিরক্ষা বিভাগের অনেকের কাছেই স্পষ্ট ছিল না, আসলে মূল পরিকল্পনা কী, এবং প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মনে হয়েছে, বাস্তবায়নের জন্য এটা খুবই কঠিন একটি পরিকল্পনা।”
কেন্দ্রীয় সমন্বয় না থাকায় রুশ বাহিনীর জন্য রসদ পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়ছে বলে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য।
তাদের বরাতে সিএনএন লিখেছে, রণাঙ্গনে থাকা সেনাদের পর্যাপ্ত খাবার, জ্বালানি ও গোলাবারুদ পৌঁছাতে মস্কোর সমস্যা হচ্ছে। যুদ্ধে তাদের সৈন্য হারানোর সংখ্যাও বাড়ছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সেনা নিহত হওয়ার ঘাটতি পূরণে বিদেশি ভাড়াটে সেনা ও দেশের অন্য প্রান্ত থেকে সেনা আনছে মস্কো।
হজেস বলেন, যুদ্ধের রঙ্গমঞ্চ পরিচালনায় একজন কেন্দ্রীয় অধিনায়ক ছাড়া সীমিত সম্পদের কৌশলগত বরাদ্দ কঠিন হয়ে যায়। এটাই যৌথ বাহিনীর একজন অধিনায়কের মূল দায়িত্ব, অগ্রাধিকার চিহ্নিত করে তাকে ঠিক জায়গায় সম্পদ বরাদ্দ করতে হয়।