বেলারুশ-পোল্যান্ড সীমান্তে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পোল্যান্ড।
Published : 10 Nov 2021, 10:17 AM
মঙ্গলবার পোলিশ প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাভিয়েচকি বলেছেন, বেলারুশের কর্তৃত্ববাদী নেতা পুতিনঘনিষ্ঠ আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো এই সংকটের সূচনা করলেও এর ‘পরিকল্পনা মস্কোতে হয়েছে’।
পোল্যান্ডে ঢোকার লক্ষ্যে তীব্র শীতের মধ্যেই সীমান্তের বেলারুশ অংশে অন্তত ২ হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষা করছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ই্উরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অভিযোগ, মানবাধিকার লংঘনের জন্য তারা বেলারুশের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তার বদলা নিতেই লুকাশেঙ্কো অভিবাসন প্রত্যাশীদের পোল্যান্ড সীমান্তে পাঠাচ্ছে।
ভিডিও ফুটেজে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার একপাশে, বেলারুশ অংশে বিপুল সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীকে দেখা গেছে। তাদের কেউ কেউ বোল্ট কাটার, গাছের গুঁড়ি ও দলবদ্ধ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করছে; অন্যদিকে পোল্যান্ডের সীমান্তরক্ষীরা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালাছে, বেশিরভাগ সময় তারা কাঁদুনে গ্যাস ছুড়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে।
এ অভিবাসন প্রত্যাশীদের অধিকাংশই তরুণ; আছে নারী ও শিশুও। বেশিরভাগই এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে। তারা সীমান্তের কাছে তাঁবু খাটিয়েছেন, একপাশে পোশিল সীমান্তরক্ষী আর অন্যপাশে বেলারুশের রক্ষীদের মাঝে পড়েছেন আটকা।
বেলারুশ-পোল্যান্ড সীমান্তে এখন রাতের বেলায় তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে যায়; সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সেখানে অবস্থান করা অভিবাসন প্রত্যাশী কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।
সীমান্ত পরিদর্শন শেষে মঙ্গলবার পার্লামেন্টের এক জরুরি অধিবেশনে মোরাভিয়েচকি বলেন, “লুকাশেঙ্কো যে ‘আক্রমণ’ চালাচ্ছেন তার পরিকল্পনা হয়েছে মস্কোতে, আর পরিকল্পনাকারী প্রেসিডেন্ট পুতিন।”
রাশিয়া ও বেলারুশের এই দুই নেতা অভিবাসন প্রত্যাশীদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশে বেলারুশের ভেতর দিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে ২৭ দেশের ইইউ জোটকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন, অভিযোগ পোলিশ প্রধানমন্ত্রীর।
সীমান্তের এই সংকটকে ‘নতুন ধরনের’ যুদ্ধ অ্যাখ্যা দিয়ে মোরাভিয়েচকি বলেন, এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
“গত ৩০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম পোল্যান্ডের সীমান্তরক্ষীরা এত নির্মম আক্রমণের শিকার হলো,” বলেছেন তিনি।
সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা পোল্যান্ড সম্ভাব্য ‘সশস্ত্র’ সংঘাত নিয়ে সতর্ক করেছে; বেলারুশ উসকানিমূলক কিছু ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কাও করছে তারা।
ইইউর তিন সদস্য দেশ পোল্যান্ড, লিথুনিয়া ও লাটভিয়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বেলারুশ হয়ে তাদের দেশে ঢোকার চেষ্টা করতে দেখছে।
লিথুনিয়া মঙ্গলবার বেলারুশ সীমান্তে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। পোল্যান্ড সবচেয়ে বেশি অভিবাসন প্রত্যাশীর ভিড় দেখছে কুজনিচা সীমান্ত ক্রসিংয়ে।
বিবিসি লিখেছে, পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিবাসন প্রত্যাশীদের সীমান্ত দিয়ে বেলারুশে ফেরত পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে, যা সত্যি হলে তা হবে আশ্রয়প্রার্থীদের অধিকার সম্বলিত আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন। সাংবাদিক বা ত্রাণ সংস্থাগুলোকেও সীমান্ত এলাকায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
“কেউ আমাদের কোথাও যেতে দিচ্ছে না; না পোল্যান্ডে, না বেলারুশে,” ভিডিও কলে বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন ইরাক থেকে যাওয়া ৩৩ বছর বয়সী শান কুর্দ।
বাগদাদ থেকে রওনা দিয়ে নভেম্বরের শুরুতে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে পৌঁছান তিনি, আর এখন তার বাস পোল্যান্ডের কাঁটাতারের সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরের একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে।
“পালানোর কোনো পথ নেই। পোল্যান্ড আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। প্রতিরাতেই তারা হেলিকপ্টার ওড়াচ্ছে; তারা আমাদের ঘুমাতেও দিচ্ছে না। আমরা ক্ষুধার্ত। এখানে পানি বা খাবার নেই। ছোট ছোট বাচ্চা, বৃদ্ধ, নারী আছে, অনেকগুলো পরিবার আছে,” বলেছেন শান।
ইইউ, নেটো ও যুক্তরাষ্ট্র বেলারুশের বিরুদ্ধে শরণার্থীদের একত্রিত করে পোল্যান্ড সীমান্তে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ এনেছে।
ইউরোপিয়ান কমিশন বলছে, ইইউতে সহজে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে লুকাশেঙ্কো যেভাবে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রলুব্ধ করছেন, তা ‘অমানবিক, গ্যাংস্টার-স্টাইল পদ্ধতি’।
ব্রাসেলস বলছে, বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসা এবং তারপর বিক্ষোভে দমনপীড়ন চালানোর কারণে ইইউ যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, লুকাশেঙ্কোর এই সীমান্ত সংকটের মাধ্যমে তার ‘বদলা নিচ্ছেন’।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা বলছেন, সীমান্তে আটকা পড়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা এখন বেলারুশ ও তাদের ইইউ প্রতিবেশীদের রাজনৈতিক দাবা খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন।
এদিকে বেলারুশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লুকাশেঙ্কো বলেছেন, তিনি সীমান্তে সামরিক উত্তেজনা এড়াতে চান। কেননা, উত্তেজনা বাধলে তাতে রাশিয়াও জড়িয়ে পড়তে পারে।
“আমি পাগল নই, কি ঘটতে পারে তা জানি। কিন্তু আমরা নতজানু হবো না,” বলেছেন তিনি।
বেলারুশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ, সীমান্তে হাজার হাজার সেনা নিয়ে এসে পোল্যান্ড চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
মিনস্কের ভাষ্য, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বৈধভাবেই বেলারুশে এসেছে, তারা সীমান্ত পার হয়ে অন্য কোথাও যেতে চায়। এক্ষেত্রে বেলারুশ কেবল ‘অতিথিপরায়ন দেশের’ ভূমিকাই পালন করছে।
সীমান্ত সংকট ‘দায়িত্বশীলতার’ সঙ্গে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা বেলারুশের প্রশংসা করছে রাশিয়া। মস্কো পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে বলেও জানিয়েছে তারা।