মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে যে তালেবান আড়াই দশক আগে আফগানিস্তানের ক্ষমতা নিয়েছিল; বিদেশি সৈন্যদের আক্রমণে পাঁচ বছরের মধ্যে ক্ষমতা হারাতে হলেও নতুন নেতৃত্বের অধীনে দুই দশক পর আবার দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
Published : 16 Aug 2021, 12:57 AM
গত কয়েক সপ্তাহে একের পর এক শহর দখলের পর রোববার তালেবান কাবুলের দখল করার পর কট্টর এই ইসলামী সংগঠনের বর্তমান নেতাদের নাম আসছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে।
এই নেতাদের মধ্যে প্রয়াত মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা ইয়াকুবের নাম আসছে; যদিও তালেবানের শীর্ষনেতারা বরাবরেই অপ্রকাশ্য থেকেই তৎপরতা চালান।
হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা
তালেবানের বর্তমান শীর্ষনেতা হিসেবে হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকে মনে করা হয়। বাহিনীতে তার পরিচয় ‘বিশ্বাসীদের নেতা’। রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় যে কোনো বিষয়েই তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
২০১৬ সালে তৎকালীন নেতা মোল্লা মানসুর আখতার যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হওয়ার পর আখুন্দজাদা নেতৃত্বে আসেন। তার বয়স আনুমানিক ৬০ বছর।
এর আগে আখুন্দজাদা বড় ধরনের নেতা ছিলেন না, মূলত ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবেই বাহিনীতে ছিলেন। ২০১৬ সালের আগে ১৫ বছর তাকে পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুচলাক শহরের একটি মসজিদে তাকে ইমামতি করতে দেখেছেন অনেকে।
আল কায়দার শীর্ষনেতা আইমান জাওয়াহিরির আশীর্বাদই তাকে তালেবানের শীর্ষনেতার আসনে বসিয়েছে বলে মনে করা হয়।
ন্যাটো বাহিনীর হামলা, মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর কোনঠাসা থাকা অবস্থায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামলে তালেবানকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন আখুন্দজাদা।
মোল্লা ওমরের মতো তার সম্পর্কেও খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ইসলামী বিভিন্ন দিবসে বিবৃতি আর বার্তার খবরগুলোই কেবল আসে।
মোল্লা বারাদার
অন্য অনেক আফগানদের মতো গত শতকের ৭০ এর দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই বারাদারের লড়াইয়ের হাতেখড়ি। জনশ্রুতি আছে, সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি মোল্লা ওমরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন।
২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর দলটির যে ক্ষুদ্র দল তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইর সঙ্গে সমঝোতা করতে চিঠি দিয়েছিল, সেই দলে বারাদারও ছিলেন বলে মনে করা হয়।
২০১০ সালে পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন বারাদার। কিন্তু ২০১৮ সালে কাতারে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে আলোচনা গতিশীল করতে ওয়াশিংটনের চাওয়ায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
পরে তালেবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন বারাদার। চুক্তিপত্রে তালেবানের পক্ষে সইটিও তিনি করেন।
সিরাজউদ্দিন হাক্কানি
সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ের ‘মুজাহিদ’ নেতা জালালুদ্দিন হাক্কানীর ছেলে হলেন সিরাজউদ্দিন হাক্কানি। তিনি একইসঙ্গে তালেবানের উপপ্রধান, আবার হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান।
বলা হয়, আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযানের সময় যুক্তরাষ্ট্রই এই হাক্কানি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল এবং সোভিয়েত বাহিনীর উপর দুর্ধর্ষ নানা হামলায় জড়িয়ে আছে এই উপদলের নাম। পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনীর উপরও সমানে হামলা চালিয়েছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক।
গত কয়েক বছরে কাবুলে যে কয়টি বড় ধরনের আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছে, তা হাক্কানি নেটওয়ার্কেরই চালানো বলে মনে করা হয়। আফগান কর্মকর্তাদের হত্যা, বিদেশি সৈন্যদের অপহরণের অভিযোগও রয়েছে এই দলটির বিরুদ্ধে।
মোল্লা ইয়াকুব
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা ইয়াকুব বর্তমানে তালেবানের উপপ্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। তার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর।
তিনি বাহিনীর সামরিক শাখার প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন। যুদ্ধের কৌশল ঠিক করা, অভিযান পরিচালনা করা তার কাজের অংশ।
বাহিনীতে শ্রদ্ধার পাত্র মোল্লা ইয়াকুব, তা অনেকটা তার প্রয়াত বাবার কারণে। যে কারণে দলে বিভেদ কিংবা কোন্দলের সময় ঐক্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান তিনি।
তবে দল পরিচালনায় তার ভূমিকা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশ্লেষকদের মনে। অনেকে মনে করেন, তাকে পদে রাখা অনেকটা লোক দেখানো।
শের আব্বাস স্তানিকজাই
দুই দশক আগে তালেবানের সরকারের উপমন্ত্রী ছিলেন শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই। তিনি গত এক দশক ধরে কাতারের দোহায় থাকছেন। সেখানে তালেবানের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনয় তালেবানের প্রতিনিধি দলে ছিলেন তিনি। তালেবানের হয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালান তিনি।
আব্দুল হাকিম হাক্কানি
নানা আলোচনায় তালেবানের নেতৃতব দেন আব্দুল হাকিম হাক্কানি। দলের ধর্মীয় কাউন্সিলের প্রধান তিনি। বলা হয়, নিজের বাহিনীতে আখুন্দজাদা যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন, সে হলেন হাকিম হাক্কানি।
তালেবান নেতারা কোথায়-কীভাবে থাকেন, তা জানা যায় খুবই কম। তাদের নেতা মোল্লা ওমরের ক্ষেত্রেও তাই ছিল। ২০১৩ সালে মোল্লা ওমরের মৃত্যু হলেও তা দুই বছর গোপন ছিল।
তালেবানের জন্ম অর্ধ শতক আগে সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। পশতু ভাষায়, তালেবান শব্দের অর্থ ছাত্ররা।
বলা হয়, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তালেবান গড়ে তোলায় ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, আর তাতে সহায়তা করে পাকিস্তান। তালেবানের প্রতিষ্ঠাও হয়েছিল পাকিস্তান সীমান্তবর্তী শহরে।
সোভিয়েত সৈন্যদের আফগানিস্তান ত্যাগের পর আফগানিস্তানে গোত্রে গোত্রে কোন্দলের মধ্যে ১৯৯৬ সালে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে।
এক চোখ নষ্ট থাকা মোল্লা ওমর পরে আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনেন।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী আক্রমণ শুরু করে আফগানিস্তানে। তাতে ক্ষমতা হারিয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। এরমধ্যে শুধু আত্মঘাতী কিংবা আচমকা হামলার মাধ্যমেই তাদের অস্তিত্বের খবর পাওয়া যেত।
তবে বিদেশি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর যখন যুক্তরাষ্ট্রও তার বাহিনী ফিরিয়ে নিচ্ছে, তখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দলটি।
একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী দখল করে তালেবান যখন কাবুলের দুয়ারে, তখন রোববার আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এরপর প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে তালেবান। ফলে আফগানিস্তানে আবার শরিয়াহ আইন ফিরে আসছে।