বিশ বছরের যুদ্ধের পর আফগানিস্তান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে মার্কিন ও ন্যাটো সেনাদের। যাদের তারা পরাস্ত করতে গিয়েছিল, সেই তালেবান গোষ্ঠী দ্রততার সঙ্গে আবারও দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের দখল নিচ্ছে।
Published : 13 Jul 2021, 11:31 PM
যুদ্ধ কতটা বদলেছে আফগানিস্তানকে? সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে সেখানে? তারই জবাব খোঁজা হয়েছে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে।
তালেবান কি ফিরে আসছে?
২০০১ সালে কট্টরপন্থি ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবানকে বল প্রয়োগ করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। এরপর গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও সহিংসতা চালিয়ে যায় তালেবান যোদ্ধারা। সেই গোষ্ঠী আবারও ধীরে ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করায় সংঘাতে জড়ায় আরও বেশি মার্কিন ও ন্যাটো সেনা।
যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাদের আফগানিস্তান থেকে তুলে নেওয়া শুরু করার পর আবারও অনেক জেলার দখল নিয়েছে তালেবান, আবারও চালু করছে তাদের কঠোর শরিয়া আইন।
গত ১২ জুলাই পর্যন্ত পাওয়া তথ্য যোগ করে দেশটির যেসব অঞ্চল তালেবান এবং যেসব অঞ্চল সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে তার একটি চিত্র তুলে ধরেছে বিবিসি।
২০ বছরের যুদ্ধে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সীমান্তে দুই পক্ষেরই কয়েক হাজার সেনার মৃত্যু হয়েছে। এই সংঘাতে যৌথ বাহিনীর বিমান হামলা এবং তালেবান হামলায় বেসামরিক লোকও মারা গেছে।
২০২০ সালে আফগানিস্তানে আহত বেসামরিক নাগরিকদের ৪৩ শতাংশই ছিল নারী ও শিশু।
যুদ্ধের কারণে পালিয়েছে কত লোক?
বছরের পর বছর ধরে সংঘাতে লাখ লাখ মানুষ তাদের ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। কিছু মানুষ পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে অথবা আরও দূরে কোথাও আশ্রয়ের সন্ধান করছে। অনেকে গৃহহারা ও বাস্তুচ্যুত হয়ে আফগানিস্তানেই আছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে লাখো মানুষ।
সংঘাতের কারণে গত বছর ৪ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১২ সাল থেকে ৫০ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা বলছে, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যায় বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে আফগানিস্তান।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগ বলছে, ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ খাদ্য নিরপত্তার অভাবে সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে আফগানিস্তানে।
মেয়েরা এখন স্কুলে যেতে পারবে?
তালেবান গোষ্ঠীর পতনে নারী অধিকার এবং শিক্ষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং অগ্রগতি হয়েছে আফগানিস্তানে। ১৯৯৯ সালে সেখানে মাধ্যমিক স্কুলে কোনো ছাত্রী ছিল না। প্রাথমিকে ছাত্রী সংখ্যা তখন ছিল মাত্র ৯ হাজার।
সেই অবস্থা থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ২৪ লাখ মেয়ে স্কুলে আসে। এখন তা বেড়ে ৩৫ লাখ হয়েছে। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্বিবিদ্যালয়গুলোতেও এখন এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী নারী।
তালেবান গোষ্ঠী নিজেদের ‘নারী শিক্ষার বিরোধী নয়’ দাবি করলেও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, তালেবান নিয়ন্ত্রণে থাকা মাত্র কয়েকটি এলাকায় বয়ঃসন্ধি পেরুনো কোনো মেয়ে স্কুলে যাওয়ার অনুমোদন পায়।
আফগানিস্তানে নারীরা এখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অংশ নিচ্ছে, রাজনীতি করার পাশাপাশি তারা ব্যবসারও চেষ্টা করছে।
২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি আফগান নারী নিজের ব্যবসা শুরু করেছেন। তালেবান শাসনে এসব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল।
আফগান সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী, পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে অন্তত ২৭ শতাংশ আসন হবে নারীদের। দেশটিতে এখন ২৪৯টি আসনের মধ্যে ৬৯টি আসন নারীদের, যা বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন সংখ্যার চেয়ে কিছুটা বেশি।
অবকাঠামোগত অনেক সঙ্কট থাকলেও আফগানিস্তানে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৮৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে যা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করছে ৪৪ লাখ মানুষ।
দেশটির ৬৮ শতাংশ মানুষের হাতে এখন মোবাইল ফোন আছে। তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মাঝে মাঝেই সেখানে মোবাইল ফোন সেবা দারুণভাবে ব্যহত হয়।
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি মূলত ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, আর্থিক খাতে আস্থার অভাব এবং আর্থিক বিষয়ে শিক্ষা না থাকাই এর কারণ।
অবশ্য ব্যাংকগুলো আশা করছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যাংক হিসাবধারী প্রাপ্তবয়স্ক আফগান নাগরিকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
রাজধানী কাবুলে পাহাড় ঘেঁষে রয়েছে সারি সারি ইট-পাথরের তৈরি ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ি। নগরীর বাড়ন্ত জনসংখ্যার সঙ্গে উঁচু ভবনের সংখ্যা বেড়ে গত ২০ বছরে নগরীর দিগন্তরেখাতেও পরিবর্তন এসেছে।
তালেবান পতনের পরের বছরগুলোতে কাবুলে দ্রুত নগরায়ন হয়েছে। প্রত্যন্ত জেলাগুলোতে যুদ্ধ চলায় লোকজন নগরমুখী হয়েছে। এছাড়া ১৯৯০ সালে তালেবান শাসন থেকে পালিয়ে যারা পাকিস্তান এবং ইরানে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকে ফিরে এসেছেন।
আফিম অর্থনীতি
বিশ্বে আফিম থেকে তৈরি মাদক সবচেয়ে বেশি আসে আফগানিস্তান থেকে। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের আনুমানিক হিসাবে যুক্তরাজ্যে যাওয়া প্রায় ৯৫ শতাংশ হেরোইনেরই উৎস আফগানিস্তান।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে পপি চাষ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। দেশটির ৩৪টির প্রদেশের মধ্যে মাত্র ১২টি পপি চাষ মুক্ত রয়েছে।
আফিম চাষ নির্মূল করতে একটি প্রকল্পের মাধ্যেম চাষিদের ডালিম এবং জাফরান চাষে উৎসাহিত করার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পরও পরিস্থিতি এমন রয়ে গেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবই আফগানিস্তানে পপি চাষ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ বলে মনে করা হয়।